মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর সংশোধনী চূড়ান্ত করেছে সরকার। এটি অনুমোদনের জন্য অচিরেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। সংশোধনীর খসড়াটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলে তা সংসদে পাস করাতে হবে। সংশোধনীর চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো সংগঠনের নির্বাহী কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিট
ি, আঞ্চলিক কমিটি বা স্থানীয় কমিটির কোনো সদস্য যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করলে সে জন্য ওই ব্যক্তির শাস্তির পাশাপাশি সংগঠনও দায়ী হবে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা যাবে। বর্তমান নামে তো সংগঠনটি কার্যক্রম চালাতেই পারবে না, এমনকি ভবিষ্যতে অন্য কোনো নামেও কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা। জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এরই মধ্যে সংশোধিত আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই এটি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।’ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করেছে সরকার। জামায়াতের আরো কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই সব রায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন অপরাধে জামায়াতের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও উঠে এসেছে। এসব অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীরও বিচার করার দাবি উঠেছে গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন স্তরে। আইনের খসড়া সংশোধনীতে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ও বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া প্রসঙ্গে বিদ্যমান আইনের ১০ অনুচ্ছেদে উপধারা (১)-এর পর (১ক) নামে আরেকটি উপধারা যুক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অন্য কোন ধারায় যা-ই থাকুক না কেন, ধারা ৯-এর উপধারা (১)-এর আওতায় কোন সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা যাবে। ২২ ধারার রুলস অব প্রসিডিউর অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন, তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া পরিচালনার পর রায় দিতে পারবে।’ সংশোধিত আইনের খসড়ায় রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে দায়ী করার প্রক্রিয়া সম্পর্কিত একটি বিধান যোগ করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনের ৪ ধারার উপধারা (১) প্রতিস্থাপন করে এটি করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনের ৪-এর (১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘ধারা ৩ অনুযায়ী কিছু লোক কোন অপরাধ সংঘটিত করলে ওই অপরাধের জন্য প্রত্যেকেই আলাদাভাবে এমনভাবে দায়ী হবেন, যাতে তিনি একাই অপরাধটি করেছেন।’ এ উপধারা প্রতিস্থাপন করে সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘ধারা ৩-এ বর্ণিত কোন অপরাধ (ক) কিছু লোক দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকলে, তাদের প্রত্যেকেই ওই অপরাধের জন্য এমনভাবে দায়ী হবেন, যাতে তিনি একাই অপরাধটি করেছেন; (খ) কোন সংগঠনের নির্বাহী কমিটির কোন সদস্য, অথবা কেন্দ্রীয় কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি অথবা স্থানীয় কমিটির কোন সদস্য বা কর্মী (ওই অপরাধ) সংঘটিত করে থাকলে সংগঠনটি নিজেও ওই অপরাধের জন্য দায়ী হবে; এবং এসব কমিটির সদস্যও একইভাবে এমনভাবে দায়ী হবেন, যাতে তিনি একাই ওই অপরাধটি করেছেন।’ বিদ্যমান আইনের ২০ ধারার (২) উপধারায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বা অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে অন্যান্য শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সংশোধিত আইনের খসড়ায় এই উপধারা প্রতিস্থাপন করে ২(ক) ও ২(খ) উপধারা করা হয়েছে। ২(ক) উপধারায় ব্যক্তির ক্ষেত্রে একই শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তবে ধারা ২০-এর ২(খ) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন সংগঠনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হলে ট্রাইব্যুনাল তা নিষিদ্ধ করে নিজস্ব নাম বা অন্য কোন নামে ভবিষ্যৎ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ বা অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এরূপ অন্য কোন শাস্তির রায় দিতে পারবেন। এ ছাড়া ৪ ধারার ১(খ) উপধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সদস্যও শাস্তি ভোগ করবেন।’ খসড়া সংশোধনীতে বিদ্যমান আইনের ২১ ধারার উপধারা (১)-এ ‘ব্যক্তি’র সঙ্গে ‘অথবা সংগঠন’ যোগ করা হয়েছে। আর বর্তমান আইনের ৩ ধারার ২ উপধারায় ‘রেসপনসিবিলিটি’ শব্দটির পরিবর্তে ‘অর অর্গানাইজেশনাল রেসপনসিবিলিটি’, ধারা ৯-এর উপধারা (১) ও (২)-এ বিদ্যমান ‘একিউজড পারসনস’-এর বদলে ‘একিউজড পারসনস অর অর্গানাইজেশন’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনের ১০(ক) ধারার উপধারা (২)-এ দুইবার এবং ১২ ধারায় দুইবার উল্লিখিত ‘পারসন’ শব্দের পর উভয় স্থানে ‘অর অর্গানাইজেশন’ শব্দ যোগ করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদ্যমান আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিচারের ক্ষেত্রে যেসব স্থানে পারসন বা ব্যক্তির কথা উল্লেখ রয়েছে, সেখানে অর্গানাইজেশন বা সংগঠন শব্দটি জুড়ে দেওয়ার ফলে বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে যেভাবে ব্যক্তির বিচার করা সম্ভব হচ্ছে, একইভাবে অভিযুক্ত কোনো সংগঠন বা দলেরও বিচার করা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করতে আইনটি সংশোধন করার পরই এ সম্পর্কে মন্তব্য করা যাবে। এদিকে সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে যুদ্ধাপরাধবিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাপ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কোনো সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের বিচারের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ব্যক্তির বিচার হওয়া উচিত। সামাজিক পুনর্মিলন ও শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে কোনো দলের বিচার হওয়া উচিত নয়।’ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভের পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে পরাজিত জার্মান নাৎসি বাহিনীর বিচার করা হয়েছে। ওই বিচারে নাৎসি বাহিনীর কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করা হয়। নাৎসি বাহিনীর কেউই তখন থেকে অন্য কোনো নামে সংগঠন বা দলের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি।
No comments:
Post a Comment