আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কায় আশপাশের দেশগুলোও উৎকণ্ঠায়। ইতিমধ্যে আক্রান্ত দেশগুলোতে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সারা বিশ্বে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারিভাবে ৯০ দিনের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বিশেষ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বি
মান, নৌ ও স্থলবন্দরগুলোতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ দপ্তর থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এ ভাইরাসের ঝুঁকি নেই। তবু আগাম সতর্কতা গ্রহণে সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে সরকারের এই সতর্কতামূলক পদক্ষেপের আড়ালে এবোলা ভাইরাস ইস্যুতে চলছে অনৈতিক বাণিজ্যের ধান্ধা। তৎপর হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য সেক্টরে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা। এমনকি ওষুধ সরবরাহকারী কিছু প্রতিষ্ঠানও তোড়জোড় শুরু করেছে। এমন সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও এজেন্টরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করে চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছেন বিভিন্ন কাজ বাগিয়ে নিতে। কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থগত পথে বিভিন্ন প্রজেক্ট তৈরিতে প্রভাবিত করছেন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে জানান, অনেক বছর ধরেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পের কিছু কিছু প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা অধিদপ্তরের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে না করে বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কম্পানির মাধ্যমে আউটসোর্সিং ভিত্তিতে টেন্ডারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। আগে কেবল নির্দিষ্ট কিছু এনজিও এসব কাজ করলেও কিছুদিন ধরে সরাসরি কিছু বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনী বা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ দিয়ে এসব কাজ করানো হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে কাজ করানোর জন্য দাতা সংস্থাগুলোরও পরামর্শ রয়েছে। এ সুযোগে ডাক্তারসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কর্মকর্তা-প্রতিনিধিদের নিয়ে ইস্যুভিত্তিক ট্রেনিংয়ের মতো কাজও করছে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে এক ধরনের অসন্তোষ রয়েছে কর্মকর্তাদের মধ্যে। ঠিক এমনভাবেই এবার এবোলা ভাইরাস ইস্যু নিয়ে দেশে আলোচনা শুরু হতে না হতেই কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মরিয়া হয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে এ ইস্যুতে প্রচারণা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ কর্মশালার মতো কাজের প্রজেক্ট তৈরির জন্য। তারা রীতিমতো তদবিরও শুরু করেছে। কেউ কেউ প্রভাব খাটাতেও পিছিয়ে নেই। অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তারা জানান, এসব চক্র কেবল অধিদপ্তরেই সীমাবদ্ধ নেই; তারা মন্ত্রণালয়েও একইভাবে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। ফলে মন্ত্রণালয় থেকে অধিদপ্তরকে প্রভাবিত করার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। তারা এইডস/এইচআইভি, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, অটিজমসহ অন্যান্য ইস্যুতে যেভাবে সরকারের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছে, এবোলা ইস্যুতেও শুরু থেকেই এমন বাণিজ্যের জন্য লবিং শুরু করেছে। বিশেষ করে কার আগে কে কাজ বাগিয়ে নেবে তা নিয়ে ভেতরে ভেতরে চলছে জোর প্রতিযোগিতা। স্বাস্থ্যসচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন অবশ্য জানালেন যে তিনি এমন বাণিজ্যিক তৎপরতার কোনো খবর জানেন না। কালের কণ্ঠকে গতকাল তিনি বলেন, ‘যা হওয়ার সবটাই সরাসরি সরকার থেকে করা হবে। তাই এমন কোনো বাণিজ্যের সুযোগ থাকবে বলে মনে হয় না।’ এমন পরিস্থিতির মধ্যেই সরকার দেশে এবোলা ভাইরাস প্রতিরোধে ৯০ দিনের সতর্কতা জারি করেছে। এ সময় সারা দেশের আন্তর্জাতিক বিমান, স্থল ও নৌবন্দরে বিশেষ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর অংশ হিসেবে বন্দরগুলোতে একটি সমন্বিত শক্তিশালী মেডিক্যাল টিম কাজ করবে। তারা সন্দেহজনক কাউকে পেলে এবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করবে। এ ছাড়া কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২০ শয্যাবিশিষ্ট একটি পৃথক ওয়ার্ড খোলা হচ্ছে। এবোলা উপসর্গ বহনকারী রোগী পেলে তাকে তাৎক্ষণিক ওই হাসপাতালে পাঠানো হবে। গতকাল সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এবোলা ভাইরাস প্রতিরোধ-সংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় এ জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশের জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেন, এবোলা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকার সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যেন কোনোভাবেই দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রেখে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে কেবল সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশের আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোতে নিয়োজিত মেডিক্যাল টিমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেনাবাহিনী, বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। তাঁদের কর্মপরিধি ও কার্যক্রম তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্যসচিবের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি কেন্দ্রীয়ভাবে কাজ করবে। কমিটিতে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্যসচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক, বিএমএর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান প্রমুখ। এদিকে এবোলা সম্পর্কে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিরাময় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবোলা ভাইরাস সরাসরি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। আক্রান্ত মানুষের হাঁচি-কাশি, রক্ত পরিসঞ্চালন, শারীরিক মেলামেশা, এমনকি আক্রান্ত কারো শরীর স্পর্শ করলে ঘামের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে সাধারণত বাতাস কিংবা অন্য কোনোভাবে এটা ছড়ানোর সুযোগ নেই। তিনি জানান, এবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর, রক্তক্ষরণ, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি, ডায়রিয়া ও বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়। সাধারণত আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে ২১ দিনের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দৃশ্যমান হয়। এবোলা প্রতিরোধে এখনো কোনো ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হয়নি বলেও জানান তিনি। আক্রান্ত দেশগুলোর পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা জানান, শুরুতে এবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৯০ শতাংশই মারা যায়। সচেতনতা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে এখন তা কমে ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে আগে থেকেই এ ভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসকদের ধারণা দেওয়া আছে। কিছু কিছু ট্রেনিংয়েও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আফ্রিকার দেশগুলোতে যাওয়া-আসা কম থাকায় এখানে এই ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি কম। তবু আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
No comments:
Post a Comment