দুর্নীতিবাজ চক্রের কারসাজিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে দেয়া বিনামূল্যের কৃষিসামগ্রী দেশের সাধারণ কৃষকদের হাতে পৌঁছাচ্ছে না। কিছু অসাধু কর্মকর্তা ভুয়া বিল-ভাওচার করে এসব কৃষিসামগ্রী লোপাট করছে। আবার কোনো কোনো েেত্র কৃষিসামগ্রী না কিনে এবং সরবরাহ না করে পুরো অর্থই আত্মসাৎ করছে। এ ধরনের অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সম্প্রতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে একটি প্রকল্পের যাবতীয় কাগজপত্র জব্দ করে পরিকল
্পনা কমিশন। পরিকল্পনা কমিশনের একজন উপপরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘কৃষি প্রকৌশল প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্পের কার্যক্রমে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। প্রকল্পের কাজ মূল্যায়নে মাঠপর্যায়ে গেলে অভিযোগের সত্যতা স্পষ্ট হয়। তাই সার্বিক কার্যক্রম মূল্যায়নের প্রয়োজনে প্রকল্পের ব্যয় ও সরবরাহসংক্রান্ত কাগজপত্র কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে পরিকল্পনা কমিশনে নিয়ে আসা হয়। বিষয়টি নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলেই দেখা যাবে কোথায় কী অনিয়ম হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হলে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির মাধ্যমে মূল্যায়ন হয়। জানা যায়, ২০০৯ সালে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নেয়া ‘কৃষি প্রকৌশল প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের তৃণমূলপর্যায়ের কৃষক, ফল ও সবজিচাষিদের সুবিধার্থে সেচকার্যক্রম ও খাল খননের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ ছাড়া সরাসরি সুবিধা দেয়ার জন্য ৬২টি জেলার ১১২টি উপজেলার কৃষকদের (প্রতি উপজেলায় ২০ জনকে) মধ্যে একটি করে প্রায় ১২ হাজার টাকা মূল্যের হ্যান্ডশাওয়ার বিনামূল্যে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়; কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মাত্র ২০ উপজেলার কৃষকদের মধ্যে হ্যান্ডশাওয়ার বিতরণ করলেও অবশিষ্ট ৯২ উপজেলার কৃষকদের মধ্যে তা বিতরণ না করে সেই টাকা লোপাট করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ফল ও সবজিগাছে ওষুধ স্প্রের মাধ্যমে পোকা-মাকড় দমন কাজে ব্যবহার করার জন্য অত্যাধুনিক হ্যান্ডশাওয়ার কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ না করেই এবং কৃষিসামগ্রী না কিনেই ভুয়া বিল ভাউচার জমা দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এই অনিয়ম-দুর্নীতিতে প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা পর্যন্ত জড়িত ছিলেন। এদের সাথে যোগসাজশ ছিল খামারবাড়ির কিছু মতাধর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার। টেলিফোনে জানতে চাইলে মাদারীপুর সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জানান, ২০০৯ সালে তার পদায়ন হয়েছে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত কখনো কেন্দ্র (খামারবাড়ি) থেকে কোনো হ্যান্ডশাওয়ার কৃষকদের মধ্যে বিতরণের জন্য তার অফিসে এসেছে বলে মনে পড়ে না। প্রায় একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছ থেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলার কয়েকটি উপজেলায়ও হ্যান্ডশাওয়ার দেয়া হয়নি। বিষয়টি এরই মধ্যে কর্তৃপকে জানানো হয়েছে। বিনামূল্যে হ্যান্ডশাওয়ার বিতরণ ছাড়াও এই প্রকল্পের আরো কিছু অনিয়ম ধরা পড়েছে। প্রকল্পের সমাপনী কর্মশালা না করেই ভুয়া স্বার দিয়ে এক লাখ টাকার বিল তুলে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা কৃষি অফিসগুলোয় কাগজ-কলমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় স্টেশনারিসামগ্রী না কিনেই ভুয়া ভাওচার দিয়ে ১৬ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ২০টি খাল খননের জন্য দুই কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল; কিন্তু নির্দিষ্ট খালগুলোর প্রয়োজনীয় খননের মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ শেষ করেই অর্থ তুলে লুটপাট করা হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর এলাকা শেরপুরের একটিমাত্র খালের সংস্কার হয়েছে ঠিকমতো। অন্য কোনো খালেই ঠিকমতো খনন করা হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের বাড়ির সামনের একটি খালও ঠিকমতো খনন করা হয়নি। সার্বিক অনিয়ম-দুর্নীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি প্রকৌশল প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন জানান, প্রকল্পের মেয়াদের শেষ দিকে কয়েক মাস দায়িত্ব ছিল তার। এ সময়ে তার জানা মতে তেমন কোনো অনিয়ম হয়নি। এখন প্রকল্পটি শেষ হয়েছে। তবে তিনি জানান, প্রকল্পের কাজ কেমন হয়েছে, মাঠে কী প্রভাব পড়েছেÑ এসব মূল্যায়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment