পরিকল্পিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় রাজধানী ঢাকার সড়কে চাপ পড়ছে বেশি, ৯৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে, আদর্শ নগরীতে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হবে। সেখানে ঢাকা
য় আছে মাত্র ৯ শতাংশ। ফলে সড়কে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে অতিষ্ঠ হয় নগরবাসী। সময়মতো মেলে না যানবাহন। বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, ঢাকায় ৭২টি ইন্টারসেকশনে দিনে যাত্রীদের নষ্ট হয় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা। এ অবস্থায় অচল ঢাকাকে সচল করতে রাজধানীবাসীর জন্য সুখবর হয়ে আসছে মেট্রো রেল। ইতিমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন মিনিট ৩০ সেকেন্ড পরপর আসবে ট্রেন। গতি হবে ঘণ্টায় ৩২ কিলোমিটার। এ গতিতে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে লাগবে ৩৭ মিনিট। ২০১৯ সাল নাগাদ ঢাকায় দেখা যাবে এই ট্রেন। প্রথম ধাপে দিন-রাত মিলিয়ে নির্ধারিত গন্তব্যে আসা-যাওয়া করবে ২৪টি ট্রেন। মূল রাস্তা থেকে ১৩ মিটার উচ্চতায় পিলারের ওপর পাতা রেললাইনের ওপর দিয়ে চলবে হালকা গড়নের ট্রেনগুলো। মাটির নিচে ও ওপরে হালকা বা ভারী ট্রেনের চলাচল ব্যবস্থা বা মেট্রো রেল বর্তমানে চালু আছে ৫৫ দেশের ১৪৮টি নগরীতে। সড়কের ওপর চাপ কমিয়ে নিরাপদ ও দ্রুত গণপরিবহনের এই জনপ্রিয় ব্যবস্থা ভারতের দিল্লি, মুম্বাই ও কলকাতায়ও চালু আছে। ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ২০২৪ সালের মধ্যে তিনটি পথে মেট্রো রেল চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো, উত্তরা-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-খিলগাঁও হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত, গুলশান-মিরপুর-মোহাম্মদপুর-ধানমণ্ডি-তেজগাঁও-রামপুরা-বাড্ডা-বারিধারা হয়ে গুলশান পর্যন্ত এবং উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে পল্লবী হয়ে রোকেয়া সরণি-খামারবাড়ী-ফার্মগেট-হোটেল সোনারগাঁও-শাহবাগ-টিএসসি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে পর্যন্ত। এর মধ্যে শেষের পথটিতে মেট্রো রেল স্থাপনের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ২০১৯ সাল নাগাদ এ পথেই চলাচল করবে স্বপ্নের সেই ট্রেন। বাকি দুই পথে এখনো সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি। তবে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সর্বশেষ সমীক্ষানুসারে, ঢাকায় পরিবহনের চাহিদা বাড়ায় তিনটি রুটে মেট্রো রেল দ্রুত নির্মাণের পাশাপাশি আরেকটি পথ চালু করতে হবে। জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী-উত্তরা-বিমানবন্দর সড়ক-প্রগতি সরণি-মালিবাগ-আউটার রিং রোড-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-নারায়ণগঞ্জ রুটে চালু করতে হবে মেট্রো রেল। জাইকা ২০৫০ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে সমীক্ষা করেছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, মেট্রো রেল চালু হলে ঢাকা শহরের অচল অবস্থার কিছুটা হলেও অবসান হবে। এসটিপির সুপারিশগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। এসব সুপারিশ সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় নতুন মহাপরিকল্পনা করতে হবে। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার মেট্রো রেল প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদন পায়। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেল চালু হলে দুই দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। থাকবে ১৬টি স্টেশন। ২০.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে জাইকা দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের জানান, সংসদের আগামী অধিবেশনেই মেট্রো রেল বিল-২০১৪ উত্থাপন করা হবে। এ অধিবেশনেই বিলটি পাস হবে বলে তিনি আশাবাদী। ট্রেন চলবে ২৪টি : প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মেট্রো রেল ব্যবস্থায় প্রথম ধাপে ট্রেন চলাচল করবে ২৪টি। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলবে ট্রেনগুলো। প্রতি ট্রেনে থাকবে ছয়টি বগি। একটি ট্রেনে এক হাজার ৬৯৬ জন যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। এর মধ্যে বসে যেতে পারবেন ৯৪২ জন, অন্যরা দাঁড়িয়ে যেতে পারবেন। একটি স্টেশনে ট্রেন অবস্থান করবে ৪০ সেকেন্ড। যাত্রীরা ফুটপাত থেকে সিঁড়ি, এসকেলেটর কিংবা লিফটে উঠতে পারবেন ট্রেনে। মেট্রো রেলের প্রতিটি পিলারের ব্যাস হবে দুই মিটার, ভূমিস্থ অংশের ভিত্তি হবে তিন মিটার ও উচ্চতা হবে ১৩ মিটার। একটি পিলার থেকে আরেকটির দূরত্ব হবে ৩০ থেকে ৪০ মিটার। পিলারের ওপরে দুটি লাইন থাকবে এবং লাইনগুলোর প্রস্থ হবে প্রায় ৯.১ মিটার। ট্রেন কেনার দরপত্র জানুয়ারিতে : গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর মেট্রো রেল প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। জাপানের নিপ্পন কোয়াই কম্পানি লিমিটেডের নেতৃত্বে ছয়টি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা শহরে যানবাহনের জরিপ শেষ করেছে। ১৬টি স্টেশনের নকশাও তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, মেট্রো রেল প্রকল্পে আটটি দরপত্র আহ্বান করা হবে। এর মধ্যে আগামী জানুয়ারিতে ২৪ সেট ট্রেন ও ১৪৪টি কোচ কেনার দরপত্র আহ্বান করা হবে। সব দরপত্রের আগেই এই দরপত্র আহ্বান করতে হবে। কারণ, ট্রেন ও কোচ তৈরিতে তিন বছর লেগে যাবে। এরপর ভূমি উন্নয়নের দরপত্র ডাকা হবে। বর্তমানে প্রকল্প এলাকা উত্তরা তৃতীয় পর্বে মাটি পরীক্ষা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের দিয়েও বারবার মাটির নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ কারণে ভূমি উন্নয়ন দরপত্র আহ্বানে সময় লাগবে। প্রকল্প এলাকায় ভায়াডাক্ট ও ১৬টি স্টেশন নির্মাণের জন্য চারটি দরপত্র আহ্বান করা হবে জুন থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পরপর ভায়াডাক্ট থাকবে। ডিপো অবকাঠামো নির্মাণের দরপত্র আহ্বানে এক বছর লেগে যাবে। তবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ইলেকট্রিক্যাল-মেকানিক্যাল লাইন স্থাপনে দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। চলছে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ : প্রকল্পের উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশ ঘুরে দেখা গেছে, এখন উত্তরা, পল্লবী ও রোকেয়া সরণির চারটি অংশে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ চলছে। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর রোকেয়া সরণিতে (কাজীপাড়া) শুরু হয়েছে ভু-তাত্ত্বিক জরিপ। রাস্তার মধ্যস্থলে সড়কদ্বীপের ওপর বেষ্টনী দিয়ে যন্ত্র বসিয়ে এ জরিপ চলছে। জরিপ করছে ডেভেলপমেন্ট কন্সট্রাকশন্স লিমিটেড। কাজীপাড়ায় গেলে দেখা যায়, শ্রমিকরা যন্ত্র দিয়ে মাটির নমুনা সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করছেন। এসব নমুনা থেকে পরে মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করা হবে। প্রকল্প এলাকা উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশে টপোগ্রাফিক ও ট্র্যাফিক সার্ভে ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরু করেছে। মেট্রো রেলের উত্তরা তৃতীয় পর্ব ও মতিঝিল- এই দুটি প্রান্তের মধ্যে উত্তরায় তৃতীয় পর্বে গত ১১ জুন ডিপো নির্মাণের পাইলিং উদ্বোধন করা হয়েছিল। প্রকল্প কর্মকর্তা মোফাজ্জেল হোসেন জানান, সব ধরনের জরিপকাজের পাশাপাশি আটটি দরপত্র আহ্বান করা হবে। পাশাপাশি চলবে ভূমি উন্নয়নকাজ। এরপর অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হবে। প্রকল্প কর্মসূচি থেকে জানা গেছে, পরামর্শক নিয়োগ শেষে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষ করা হবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মধ্যে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রকল্পের মূল বাস্তবায়নকাজ শুরু হবে। ডিপো নির্মাণের জন্য রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্ব এলাকায় ২২ হেক্টর জমি নির্বাচন করা হয়েছে। রাজউকের প্রকল্প থেকে চলতি মাসেই জমির মূল্য পরিশোধ করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। লাগবে মাত্র ৩৭ মিনিট : উত্তরা থেকে পল্লবী হয়ে মতিঝিল রুটে মেট্রো রেল স্থাপন হলে চলাচলে লাগবে মাত্র ৩৭ মিনিট। মেট্রো রেলের চূড়ান্ত রুট অ্যালাইনমেন্ট হলো- উত্তরা তৃতীয় ধাপ-পল্লবী, রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে (চন্দ্রিমা উদ্যান-সংসদ ভবন) খামারবাড়ী হয়ে ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। এ রুটের ১৬টি স্টেশন হচ্ছে- উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর সেকশন-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক। ট্রেন চালানোর জন্য বিদ্যুৎ নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে। ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩.৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর জন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁ ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকবে। চালু হবে তিন ধাপে : উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথটির প্রথম ধাপ চালু হবে পল্লবী থেকে সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত। এই ১১ কিলোমিটার রেলপথ চালুর পরিকল্পনা রয়েছে ২০১৯ সালের মধ্যে। দ্বিতীয় ধাপে সোনারগাঁও হোটেল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ৪.৪০ কিলোমিটার পথ চালুর পরিকল্পনা রয়েছে ২০২০ সালে। তৃতীয় পর্যায়ে পল্লবী থেকে উত্তরা পর্যন্ত ৪.৭ কিলোমিটার চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছে ২০২২ সালে। আগামী অধিবেশনেই বিল পাস : সংসদের আগামী অধিবেশনেই মেট্রো রেল বিল-২০১৪ পাস হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন গতকাল বুধবার এ তথ্য জানান। গতকাল বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনে কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে মেট্রো রেল বিল-২০১৪ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা মনে করেন, বিলটি পাস হলে প্রকল্পের কাজে জবাবদিহিতা বাড়বে। এ ছাড়া যেসব অসংগতি থাকবে সেগুলোও বেরিয়ে আসবে। ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে বিলটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। জানুয়ারিতে অধিবেশন শুরু হলে বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করা হবে। আগামী অধিবেশনেই বিলটি পাস হবে বলে তিনি আশাবাদী। বৈঠকে কমিটির সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, এ কে এম এ আউয়াল (সাইদুর রহমান), নুরুজ্জামান আহমেদ, ফয়জুর রহমান, নাজমুল হক প্রধান, মো. মনিরুল ইসলাম, লুৎফুন নেছাসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
No comments:
Post a Comment