‘আইজ ১৮ টাকা দরে কাঁচা মরিচ বেচল্যাম। অথচ অবরোধ না থাকলি এর দাম হইতো ২৮ টাকার থ্যা ৩০ টাকা। অবরোধ আমাগরে কোমর ভাইঙ্যা দিত্যাছে।’ এ বক্তব্য পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার শহীদনগর গ্রামের মরিচচাষি মন্টু মিয়ার। সাঁথিয়ায় প্রচুর সবজি ও মরিচ চাষ হয় এবং সেখান থেকে যায় ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে। তবে মরিচের দামের উল্টো চিত্র নীলফামারীতে। শহরের বড় বাজারের কাঁচামাল বিক্রেতা নাজমুল হোসেন জানান, কাঁচা মরিচ কদিন
আগেও ১৬-১৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন ২৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অবরোধের কারণে বাইরের জেলা থেকে মরিচ না আসায় দাম বেড়ে গেছে। বিরোধী জোটের ডাকা অবরোধ এবং এর আগে আরও দুই দিন সড়ক যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন থাকায় এর চরম প্রভাব পড়েছে কৃষিতে। শীতের সবজিসহ অন্যান্য কাঁচা পণ্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় পৌঁছাতে না পারায় দাম কমে গেছে অনেক। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। আর ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় লোকসান গুনছেন ব্যবসায়ীরাও। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উত্তরাঞ্চলের দুগ্ধখামারিদের। অরোধের কারণে ঢাকায় পাঠাতে না পারায় সিরাজগঞ্জে দুধ কেনা বন্ধ করে দিয়েছে মিল্ক ভিটা। ফলে সেখানে ৫০ টাকার দুধ বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে। একই অবস্থা বগুড়ার ধুনট ও শেরপুরে। সবজির ক্রেতা নেই: বৃহস্পতিবার পাবনার সাঁথিয়ার অন্যতম পাইকারি সবজির হাট করমজা হাটে গিয়ে দেখা যায়, এক জায়গায় স্তূপাকারে পড়ে আছে পেঁয়াজকলি (পেঁয়াজের ফুল)। ছবি তুলতে গেলে এগিয়ে আসেন সবজি ব্যবসায়ী সাহাদাত। তিনি জানান, ক্রেতা না পাওয়ায় এগুলো ফেলে গেছেন কৃষক ও ছোট ব্যবসায়ীরা। হাটের আরেক পাশে ফুলকপি নিয়ে মুখ ভার করে বসেছিলেন শাহজাদপুর উপজেলার তালগাছি গ্রামের কৃষক মোজাম্মেল হোসেন। তিনি জানান, অবরোধের আগেও এই হাটে আট থেকে দশ টাকা কেজি দরে ফুলকপি বিক্রি করেছেন। এখন বিক্রি হচ্ছে চার থেকে সাড়ে চার টাকা কেজিতে। করমজা হাটের কাঁচামালের আড়ত আজমির ভান্ডারের মালিক ফজলুর রহমান জানান, অবরোধের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামে কোনো সবজিই পাঠানো যাচ্ছে না। ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, কাঁচা মরিচসহ সব ধরনের সবজির দাম অর্ধেকে নেমে গেছে। তিনি বলেন, এতে শুধু কৃষকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, ব্যবসায়ীদেরও লোকসান হচ্ছে। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার আলুচাষি আলম হোসেন জানান, অবরোধের আগে যে আলু খেত থেকে পাইকােররা ১২ থেকে ১৪ টাকা দরে কিনে নিয়ে গেছেন, এখন সেই আলু বিক্রি করতে হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা কেজি দরে। শহরের বড় বাজারের সবজি ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন বলেন, ‘এ জেলা থেকে যেসব কাঁচামাল বাইরে যায়, তার দাম কমেছে আর যেসব মাল বাইরে থেকে এখানে আসে তার দাম বেড়েছে।’ দেশের সবচেয়ে বেশি শীতকালীন টমেটো চাষ হয় রাজশাহীর গোদাগাড়িতে। উপজেলার পিরিজপুর গ্রামের চাষি গোলাম রসুল জানান, গত রোববার তিনি প্রতি মণ পাকা টমেটো বিক্রি করেছেন ৩৬০ টাকা। গতকাল সেই টমেটো বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা মণ দরে। দাম এত কমল কেন জানতে চাইলে নাটোর থেকে গোদাগাড়িতে টমেটো কিনতে আসা ব্যবসায়ী শাহজাহান আলী বলেন, ‘গোদাগাড়ি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রাক ভাড়া লাগত ২৫ হাজার টাকা। অবরোধের কারণে সেই ভাড়া গিয়ে ঠেকেছে ৬০ হাজার। এর পরও ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না, চালকেরা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামতে চাইছেন না। ফলে আগের দামে টমেটো কিনলে ট্রাকভাড়া মিটিয়ে ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হবে।’ দুধের দাম অর্ধেক: সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও পার্শ্ববর্তী পাবনা জেলা থেকে খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে মিল্ক ভিটা, ব্র্যাক, প্রাণ, আকিজ ও অ্যামোসহ প্রায় দশটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ লিটার দুধ কেনে তারা। কিন্তু অবরোধের কারণে ঢাকায় পাঠাতে না পারায় দুধ কেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা লিটারের দুধ বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। ওই এলাকার দুধের প্রায় অর্ধেক কেনে মিল্ক ভিটা। প্রতিষ্ঠানটির বাঘাবাড়ি কারখানার ব্যবস্থাপক মো. ইদ্রিস আলী জানান, সংগ্রহ করা দুধের বেশির ভাগই ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে ঢাকায় পাঠানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে কেবল গত বুধবার পুলিশ পাহারায় চার গাড়ি (৪২ হাজার লিটার) দুধ ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ কারণে তাঁরা দুধ কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। বগুড়ার ধুনট ও শেরপুর বাজারেও বৃহস্পতিবার দুধ বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা লিটার দরে। অবরোধের আগে দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। কমেছে ধানের দামও: বগুড়া ও পাবনায় ধানের দামও কমে গেছে। ধান ও চাল বাইরে পাঠাতে না পারায় ওই সব এলাকার ধানচাতালগুলোও বন্ধ হতে বসেছে। কাজ না থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন চাতালশ্রমিকেরা। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে ধানের দাম কমেছে মণপ্রতি ৪০ টাকা। উপজেলার কোলগ্রামের কৃষক খয়বর আলী বলেন, ‘এবার আমন ধানের ফলন হয়েছিল ভালো। আমরা খেটে খাওয়া কৃষকেরা খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু গত কয়েক দিনে ধানের বাজার মণপ্রতি ৩০-৪০ টাকা করে কমে গেছে। রবিশস্য খেতে সার ও কীটনাশক দেওয়া এবং ঋণের টাকা শোধ করার জন্য বাধ্য হয়ে কম দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। পাবনার ঈশ্বরদীর ধান-চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সাদেক আলী বিশ্বাস বলেন, উপজেলার অধিকাংশ চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। অবরোধ প্রত্যাহার না হলে দু-এক দিনের মধ্যে সব চাতাল বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিপাকে পড়েছেন চাতালশ্রমিকেরা। প্রায় ১২ হাজার শ্রমিকের কাজ নেই। চাতালশ্রমিক মুছলিমা খাতুন বলেন, ‘অবরোধের কারণে বুধবার থেকে চাতাল বন্ধ। মালিক কাজে যেতে নিষেধ করেছেন। ফলে হাজিরাও (পারিশ্রমিক) পাব না।’ {প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী এবং সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, ঈশ্বরদী ও বেড়া (পাবনা), দুপচাঁচিয়া, শেরপুর ও ধুনট (বগুড়া) প্রতিনিধি}
No comments:
Post a Comment