জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত হওয়া ৫৯৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মতো জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে। ফলে সারা দেশের এই সব বিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বের কার
ণেই এ অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। প্রথমবারের মতো দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোলা হয় ষষ্ঠ শ্রেণি (পরবর্তী সময়ে এই শিক্ষার্থীরাই এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়বে)। প্রথমবার সারা দেশের মোট ৫৯৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২০১৪ সালে সপ্তম শ্রেণি পেরিয়ে এবার অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা (জেএসসি) অনুষ্ঠিত হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীনে। শিক্ষা বোর্ডের অধীনে জেএসসি পরীক্ষার জন্য এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ বাধার মুখে পড়েছে। তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ঢাকা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক এ টি এম মইনুল হোসেন এক আদেশ মারফত জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম বোর্ড কর্তৃক নিম্ন মাধ্যমিক পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। এই আদেশের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু বকর ছিদ্দিক জানান, বিদ্যালয়ের পাঠদানের অনুমতি ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়া ও শর্ত অনুসরণ করা হয়। বিদ্যালয় পরিদর্শন ছাড়া এ অনুমোদন দেওয়া হয় না। ১২ এপ্রিলের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করার কথা। এই সময়ের মধ্যে এতগুলো বিদ্যালয় পরিদর্শন সম্ভব নয়। তাই এসব বিদ্যালয়কে পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করেই এবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর জানান, সরকার তথা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ও অনুমতিক্রমে ৫৯৬টি বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি চালু করা হয়। এই বিদ্যালয়গুলোকে সরকারের অনুমতিপ্রাপ্ত বিদ্যালয় হিসেবে গণ্য করেই নিয়ম মতো রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে এবার জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার জন্য বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের নিজ নিজ বিদ্যালয়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, এই শিক্ষার্থীরা এত দিন বিনা বেতনে পড়ালেখা করে এসেছে। এখন অন্য বিদ্যালয় থেকে রেজিস্ট্রেশন করে পরীক্ষা দিতে গেলে যে বাড়তি খরচ দিতে হবে তাতে করে অনেকেই আর পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। বিষয়টি দুই মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার জন্য সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বলে তিনি জানান। জেএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের শেষ সময়সীমা ঘনিয়ে এলেও এবং এ ব্যাপারে কোনো সমাধান না হওয়ায় দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত হওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ প্রসঙ্গে রাজধানীর ডেমরা থানার বাকচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমতাজউদ্দিন, কোতোয়ালি থানার রাজারদেউরী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় কুমার মিস্ত্রিসহ আরো অনেকে জানান, শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করে দেখেছেন, ওই সব বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বোর্ডের নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন ফি ছাড়াও ভর্তি ফি, ট্রান্সফার ফি ইত্যাদি বাবদ শিক্ষার্থীপ্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা করে দাবি করছে। তাঁদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এত দিন বিনা খরচে পড়ালেখা করে এসেছে, তারা এত টাকা ব্যয় করে এখন পরীক্ষা দিতে পারবে না। অনেকের পরীক্ষাই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আর এই অবস্থা চলতে থাকলে এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট দেখা দেবে। তাতে সরকারের শিক্ষানীতির বাস্তবায়নও হুমকির মধ্যে পড়বে। বাকচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমতাজউদ্দিন বলেন, এখন পরীক্ষা দিতে হলে টাকা দিতে হবে এটা শিক্ষার্থীদের বলতেও সাহস পাচ্ছি না। বলতে গেলে অপমানিত হওয়াসহ নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রায় তিন মাস থেকে চিঠি চালাচালি হচ্ছে। এখনো কোনো সমাধান মেলেনি। এদিকে প্রতিদিন প্রধান শিক্ষকরা ফোন করে, সশরীরে এসে করণীয় জানতে চান। তাঁদের পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে, কিন্তু কেউ তা মেনে নিতে পারছে না। এদিকে গত ৩০ মার্চ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। ওই সভায় সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ বিদ্যালয়ের নামেই শিক্ষার্থীরা যাতে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলেছেন।
No comments:
Post a Comment