Wednesday, April 8, 2015

পড়ে আছে অনেক স্বপ্নের পানগাঁও বন্দর:যুগান্তর

মঞ্চে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানও। মঞ্চ আলো করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারাও ছিলেন। কিন্তু ২০১৩-এর ৭ নভেম্বর উদ্বোধনের সেই দিনটির পর কেরানীগঞ্জের পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার টার্মিনাল সুনসান। এতটুকু ভিড়ও আর দেখা যায়নি। দেখা যায়নি ব্যবসায়ী কিংবা শ্রমিকদের কর্মতৎপরতা। অলস সময়ই কাটছে এর কর্মকর্তা-কর্মচারী
দের। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছে, সময় ফুরিয়ে যায়নি, তৎপর হলে, প্রচার-প্রচারণা চালালে এ বন্দর সরগম হয়ে উঠবে। আমদানি- রফতানিকারকদের সঙ্গে মতবিনিময় ও বিদেশি ক্রেতাদের কাছে তথ্য পাঠিয়ে তা সচল করা সম্ভব। আর কর্তৃপক্ষের দাবি, ব্যবসায়ীদের নজর কাড়তে ভাড়া কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে বন্দরটি নির্মিত হয়। প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ বন্দর এখন কাজে লাগছে না। আইসিডি ভবনসহ যাবতীয় যান ও যন্ত্রে মরিচা পড়ছে। আয় না থাকলেও বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ সব মিলে প্রতি মাসে সরকারের ৪০ থেকে ৪২ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। বন্দরটি উদ্বোধনের সময় বলা হয়েছিল, এতে বছরে ১ লাখ ১৬ হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। যাতে প্রতি মাসে আয় হবে বহু কোটি টাকা। কিন্তু হায়! উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৮শ’ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। যার অধিকাংশই ছিল খালি! গত বছরের ১১ নভেম্বর সর্বশেষ মালভর্তি ২০টি কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁও বন্দরে আসে। ২৬ নভেম্বর ২৫টি খালি কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে যায়। এর পরে আর কোনো কন্টেইনারবাহী জাহাজ এখানে নোঙর করেনি। যায়ওনি। এক সপ্তাহ পানগাঁও বন্দরে ঘুরে জানা গেছে, প্রায় ৮৮ একরের এ বন্দরে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে ৬৯ একর জায়গায়। দুটি জাহাজ বাদিং করার সুবিধা রয়েছে। ৫৪ হাজার ৮৪৫ বর্গমিটার মার্শালিং ইয়ার্ড রয়েছে- যাতে কন্টেইনার গাদা করার জন্য রাবার টায়ার গ্র্যান্ট্রি ক্রেন (আরটিজি) স্থাপনের সুবিধা আছে। ৫ হাজার ৩৯০ কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশন (সিএফএস) রয়েছে। রয়েছে আধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। এসব সরঞ্জাম ব্যবহৃত না হওয়ায় দিনদিন নষ্ট হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্মোচন করা উদ্বোধন ফলকটি পর্যন্ত ক্ষয়িষ্ণু। শেখ হাসিনা নামটি থাকলেও, নেই তার পদবি এবং উদ্বোধনের দিন-তারিখ। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সরঞ্জামগুলো ২-৩ দিন পরপর নির্দিষ্ট সময় চালিয়ে সচল রাখার চেষ্টা চলছে। বন্দরে ৫৪০ বর্গমিটার ৪টি টার্মিনাল ভবন রয়েছে, প্রতিটি ৪ তলা। ৭২০ বর্গমিটার গেস্ট হাউস, ১০০০ বর্গমিটার রিপেয়র শপ আছে। ১ হাজার ২৫০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি জেনারেটর, ১৫০০ কেভিএ ক্ষমতার ২টি ট্রান্সফরমারযুক্ত বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন রয়েছে। ফায়ার ফাইটিং পাম্প, ফুয়েল পাম্পসহ ৯০০০ বর্গমিটারের একটি ভ্যানপুল (খালি কন্টেইনার রাখার ইয়ার্ড) আছে। রয়েছে অত্যাধুনিক মোবাইল হারবার ক্রেন ও স্ট্যাডল ক্যারিয়ার। শক্তিশালী মোবাইল হারবার ক্রেন দিয়ে প্রায় ৮০ টন ওজন পর্যন্ত মালামাল স্থানান্তর সম্ভব। বুড়িগঙ্গা সেতু-১ থেকে কন্টেইনারবাহী ট্রেইলর ও ট্রাক চলাচলের জন্য বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচ দিয়ে ১০ মিটার প্রস্থের প্রায় ৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি ব্রিজ ও কালভার্ট। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব পণসামগ্রী খালাস হয় তার ৭৫ শতাংশই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার। এর মাত্র ৮-১০ শতাংশ মালামাল রেলপথে আসে। বাকিটা সড়কপথে কন্টেইনার ট্রেইলর ও ট্রাকে আনা হয়। ওইসব মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নৌপথে পানগাঁও বন্দরে আনা হলে খরচ বাঁচবে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটও হ্রাস হতো। সংশ্লিষ্টদের সাদামাটা বক্তব্য, পানগাঁও নিয়ে প্রচার-প্রচারণা না থাকা ও ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি কাড়তে না পারায় বন্দরের এ রুগ্ন দশা। সঙ্গে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএর অবহেলাও। এটি শুধু চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে থাকলে সরগম হতো- অভিমত সংশ্লিষ্টদের অনেকেরই। তারা বলছেন, কর্তৃপক্ষ তৎপর হলে, প্রচার-প্রচারণা চালালে পানগাঁও সরগম হয়ে উঠবে। আমদানি, রফতানিকারকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে, বিদেশী ক্রেতাদের কাছে পাঠাতে হবে তথ্য। বন্দরটির নিরাপত্তাকর্মীরা বলেন, কর্মব্যস্ততাহীন বন্দর পাহারা দিতে তাদের ভালো লাগে না। নিরাপত্তাকর্মী ইদ্রিস, মাহবুব ও শহিদুল ইসলাম জানান, শ্রমিক, ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ লোক- কারওই মুখ দেখেননি তারা। বৃহস্পতিবার ২ জন লোক বন্দরে এসেছিল। ১০ টাকা করে গেট পাস বিক্রি করা হয়েছিল। বন্দরের সোনালী ব্যাংকে নেই লেনদেন। আর ক্যান্টিনে নেই কোনো গ্রাহক। টেবিল-চেয়ারে ধুলাবালির স্তর। ক্যান্টিন ম্যানেজার মো. মাহফুজুর রহমান অবশ্য নিরাশ নন। বলেন, বন্দর একদিন ঠিকই চাঙ্গা হবে, তখন খাবার বিক্রি করে কূল পাবেন না। নিরাপত্তা পরিদর্শক মো. ইলিয়াছ হোসেন জানান, আনসার সদস্য ও নিজস্ব কর্মী মিলে ৬৫ জন নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন। নিজেরা রান্না করে খান। যতদিন ধরে এখানে রয়েছেন ততদিনের মধ্যে বন্দরে কোনো মালামাল উঠা-নামাতে দেখেননি তিনি। কাতর কণ্ঠে তিনি বন্দরটি নিয়ে প্রচার-প্রচারণার আহ্বান জানান। কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ঢাকা শহরে যেসব ফলমূল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আসে তার ৫০ ভাগ পানগাঁও বন্দর হয়ে আসলে বন্দরটি চাঙ্গা হয়ে যেত। এ বিষয়ে সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের দৃষ্টি আর্কষণ করেন তারা। বন্দর নির্মাণের শুরু থেকেই শ্রমিকের কাজ করছেন বন্দর ঘেঁষা কোন্ডা গ্রামের শ্রমিক বাদল দাশ, দ্বীন ইসলাম, বিনা রানী, পারুল রানী, হিরা রানী, দিবা রানী, আরতি রানী ও সচিত্রা রানী। তারা বলেন, এত সুন্দর বন্দর অথচ মালামাল উঠা-নামা নেই। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বসে থাকেন তারা। বন্দর নির্মাণের আগে এ স্থানে জঙ্গল ছিল, এখন উন্নত। চার পাশে বাড়িঘর হচ্ছে সারি সারি। উদ্বোধনের পর থেকে ২-৩ বার জাহাজ এসেছে জানিয়ে তারা বলেন, অধিকাংশ কন্টেইনারই ছিল খালি। ৯ হাজার বর্গমিটারের কন্টেইনার ইয়ার্ডে আজও একটি কন্টেইনারও রাখা হয়নি। মরিচা পড়েছে লোহার তারে। ইয়ার্ডের ভেতর ঘাস বদলে দিচ্ছে রূপ। কোন্ডার ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা গোলাম রসুল লাঠিতে ভর দিয়ে জীর্ণ শরীর নিয়েই কোনোমতে হাঁটছিলেন বন্দরের রাস্তায়। জানালেন, এ বন্দর ছিল স্বপ্নের মহারথী। এলাকাবাসীর আশা ছিল শত শত লোক শ্রম দিয়ে অর্থ কামাবে। কই, কিছুই নেই। খালি ভাঁওতাবাজি...। বন্দর সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ওয়ার্কসপ। ওয়ার্কসপ ব্যবসায়ী নজরুল মিয়া জানান, মালিকরা বড় স্বপ্ন নিয়ে ওয়ার্কসপ করেছিলেন। এখন এ রুটে ট্রাক চলে না। তবে তাদেরও আশা এ বন্দর চাঙ্গা হবে, শত শত ট্রাক আসবে-যাবে। ব্যবসা হবে। কোণ্ডা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান ফারুক চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, আশা ছিল ইউনিয়নের শত শত শ্রমিক বন্দরে কাজ করতে পারবে। সেই আশা আশাই রয়ে গেল। বন্দরটি যথাযথ হয়েছে, উপযুক্ত সড়কও নির্মিত হয়েছে। বন্দর এলাকায় কোনো চাঁদাবাজি নেই। তার ধারণা, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে এ বন্দর থেকে মালামাল নিয়ে শত শত ট্রাক উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে যাবে। বন্দর সড়কের পাশেই আন্তঃজেলা ট্রাকচালক সমিতির কোণ্ডা শাখা। এর সভাপতি মোহাম্মদ আলীকে জিজ্ঞেস করা হয়, ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা হয় কিনা। উত্তরে সাফ জানান, চাঁদা তোলা নয়, বরং চাঁদা দিতে রাজি, তারপরও এ বন্দর দিয়ে ব্যবসায়ীরা যেন আমদানি-রফতানি করেন। কমলাপুর রেলওয়ে আইসিডির এক কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতা ও হরতাল-অবরোধে সহিংসতার শিকার হচ্ছে কন্টেইনারবাহী ট্র্যাক। চুরিও হয় মালামাল। এ অবস্থায় আমদানি-রফতানি পণ্য নৌপথে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কেরানীগঞ্জ পানগাঁও বন্দর হয়ে আনা-নেয়া করলে কোনো বিঘ্নই ঘটবে না। নৌপথে কোনো সহিংসতা নেই। পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার টার্মিনালের ম্যানেজার মো. মশিউর রহমান বেগ জানান, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রাকে যে কন্টেইনার ঢাকা কিংবা নারায়ণগঞ্জে আনা হয় তা পানাগাঁও দিয়ে আনা হলে খরচ অনেক কমে আসবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ বন্দরে মালামাল আনতে ৪০ টিইউএস কন্টেইনার ৩শ’ ডলার ও ২০ টিইউএস কন্টেইনারের ভাড়া ১৫০ ডলার পড়ে। খালি কন্টেইনারের ক্ষেত্রে ভাড়া হয় ৫০ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের নজর কাড়তে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাহাজের ভাড়া কমানো হবে। তিনি বলেন, বন্দর থেকে লোড করা কন্টেইনারবাহী ট্রাক প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ (পোস্তগোলা পর্যন্ত) পুলিশি পাহারায় পৌঁছে দেয়া হয়। সম্ভাবনার এ বন্দরে কর্মব্যস্ততা অবশ্যই বাড়বে- আশা তারও। অতিরিক্ত টার্মিনাল ম্যানেজার মো. মিজানুর রহমান জানান, আন্তর্জাতিক মানের এ বন্দরে সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তার আশা, পদ্মা সেতুর নির্মাণসামগ্রীর অধিকাংশ এ বন্দর হয়ে যাবে। মিজানুর আরও বলেন, বন্দরের আশপাশে ব্যাপক আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠছে। গড়ে উঠবে বড় বড় কল-কারখানাও। এসবের সরঞ্জাম এ বন্দর হয়ে আসলে খরচ অনেক কমে আসবে। মঙ্গলবার দুপুরে এ দু’কর্মকর্তার সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করলেও বন্দরটি ঘুরে দেখতে অনুমতি দেননি তারা।  

No comments:

Post a Comment