১০০ বাংলাদেশিসহ তিন শতাধিক নারী-পুরুষ নিয়ে ভেসে চলা চালকহীন নৌকাটির দুদিন ধরে আর কোনো খোঁজ মিলছে না। এদিকে থাইল্যান্ডে অভিযান শুরু হওয়ার পর দেশটিতে ভিড়তে না পেরে মানব পাচারকারীদের যেসব নৌকা এখনো সাগরে ভাসছে, সেগুলোর আরোহীদের আত্মীয়স্বজন থেকে এখনো মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ওই সব নৌকা থেকে নেমে কেউ কেউ মালয়েশিয়া পৌঁছেছেন, এমন খবরও পাওয়া গেছে। এমন অন্তত দুজনের সন্ধান পেয়ে
ছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। সংস্থাটির দায়িত্বশীল একটি সূত্র প্রতিবেদককে জানায় যে তাদের কর্মীরা এরই মধ্যে মালয়েশিয়ায় ওই দুজনের সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন, যা তাঁদের পরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে। সূত্রের শর্তানুযায়ী এখানে সংস্থাটির নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। ওই সংস্থাটি যে দুজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তাঁদের একজন অবিবাহিত তরুণী। তাঁর বাড়ি মিয়ানমারের আরাকানে। তাঁকে মুক্ত করতে মালয়েশীয় মুদ্রায় আড়াই হাজার রিংগিত মুক্তিপণ দিয়েছেন মালয়েশিয়ায় কর্মরত তাঁর বড় ভাই। পাচারকারীদের দাবি ছিল, পাঁচ হাজার রিংগিত। বাকিটা পরে দেওয়ার শর্তে বোনকে ছাড়ালেও এখনো অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ছাড়াতে পারেননি ওই ব্যক্তি। তিনি ওই সংস্থাটিকে জানান, বোনকে ছাড়ার ব্যাপারে শর্ত দেয় যে স্ত্রীকে ছাড়ানোর সময় পুরো টাকা দিতে হবে। স্ত্রীকে ছাড়াতে পাঁচ হাজার রিংগিত চায় পাচারকারীরা। টাকা জোগাড় করতে পারেননি তিনি এখনো। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানান, মুক্তি পাওয়া নারী বলেছেন, তাঁকেসহ তিনজনকে এক রাতে মাছ ধরার ছোট একটি ইঞ্জিন নৌকায় তুলে দেয় পাচারকারীদের লোকজন। তারপর মালয়েশিয়ার লাংকাভি দ্বীপের কাছে নামানো হয়। সেখানে পানিতে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা হাঁটার পর রাস্তায় ওঠেন। সেখানে আগে থেকে পাচারকারীদের গাড়ি ছিল। সেই গাড়িতে করে গন্তব্যে পৌঁছান। রোহিঙ্গা সোসাইটি ইন থাইল্যান্ডের সদস্য মামুন রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরাও আরাকানের বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পেয়েছেন যে এখনো নৌকায় বন্দী রোহিঙ্গাদের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে। যারা টাকা দিতে পারছে, তাদের এক-দুজন করে করে মালয়েশিয়ার ছোট মাছ ধরার নৌকায় তুলে ওই দেশে পৌঁছানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ওই সব ছোট নৌকায় মূলত পাচারকারীদের নৌকার জ্বালানি, খাবার ও চার্জ দেওয়া মুঠোফোন যাচ্ছে বলে তাঁরা শুনেছেন। মামুন রশীদ জানান, তাঁরা এখন বেশি উদ্বিগ্ন চালকহীন নৌকাটি নিয়ে, যেটাতে তিন শর বেশি মানুষ আছে। যাদের মধ্যে অনেক মহিলা ও শিশুও আছে। নৌকাটি কূলে ভিড়তে দিলে যাতে সঙ্গে সঙ্গে খাবারসহ অন্যান্য জরুরি সাহায্য দেওয়া যায়, সে জন্য রোহিঙ্গা সোসাইটির একটি স্বেচ্ছাসেবক দল সংখলা এলাকায় পাঁচ দিন ধরে অবস্থান করছে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গেও দলটির সদস্যদের দেখা হয়। তাঁরা জানান, তাঁরা থাই নৌবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। এই নৌকাটির ওপর নজর রাখছিলেন ফুকেটের সাংবাদিক চুতিমা সিদাসাথিয়ানসহ বিদেশি গণমাধ্যমের একদল কর্মী। চুতিমা জানান, সবুজ রঙের ওই নৌকাটিকে সতুন উপকূলের জেলেরা সর্বশেষ দেখেছেন রোববার রাতে। ওই নৌকার আরোহীদের কাছে যে থাই মুঠোফোন রয়েছে, সেটাতেও আর সংযোগ পাচ্ছেন না চুতিমা। থাইল্যান্ডে মানব পাচারবিরোধী অভিযান শুরুর পর কোথাও ভিড়তে না পেরে নৌকাটির মাঝি ও মানব পাচারকারী চক্রের দালালরা স্পিড বোট নিয়ে পালিয়েছে ১০ দিন আগে। তখন নৌকাটিকে নিজেদের জলসীমা থেকে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ থাই উপকূলের দিকে ঠেলে দেয়। গত বৃহস্পতিবার নৌকাটি থাইল্যান্ডের জলসীমায় এলে এ দেশের নৌবাহিনী নৌকাটিতে জ্বালানি ও কিছু খাবার দিয়ে মালয়েশিয়ার দিকে ঠেলে দেয়। পরদিন মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষও একই কাজ করে। এর পরের দিন থাই কর্তৃপক্ষ আবারও মালয়েশিয়ার দিকে নৌকাটিকে ঠেলে দেয়। এরপর নৌকাটির আরোহীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা এখনো জানা যায়নি। অন্যদিকে সোমবার রাত সাড়ে ১০টায় থাইল্যান্ডের ফুকেট উপকূলে পাচার হওয়া লোকভর্তি আরেকটি বড় নৌকা দেখা গেছে বলে সেখানকার থাই জেলেরা জানিয়েছে। নৌকাটি সতুন প্রদেশের দিকে যাচ্ছিল এ খবর পেয়ে গতকাল সতুন উপকূলে স্থানীয় ও বিদেশি কয়েকটি গণমাধ্যমের কর্মীরা যান সংবাদ সংগ্রহ করতে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন কাউকে উপকূলে নামতে দেয়নি। এ সময় কয়েকজন সাংবাদিকে লাঠিপেটাও করেছে স্থানীয় পুলিশ। বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, আনুমানিক ছয় হাজার মানুষ নিয়ে মানব পাচারকারীদের এমন আরও কিছু নৌকা মালাক্কা প্রণালি ও আন্দামান সাগরে ভাসছে। জাতিসংঘ গতকাল জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরে অন্তত পাঁচটি নৌকায় ৪০ দিনেরও বেশি সময় ধরে ভাসছে দুই হাজার অভিভাবসন-প্রত্যাশী মানুষ। তাদের খাবার ও পানীয় জল ফুরিয়ে এসেছে। খাবার নিয়ে নৌকায় চলছে সংঘর্ষ-খুনোখুনি। আর রোহিঙ্গা সোসাইটি ইন থাইল্যান্ডের নেতাদের দাবি, সাগরে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের নিয়ে অন্তত চারটি বড় নৌকা সাগরে ভাসছে বলে তাঁরা থাই জেলেদের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়েছেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার আহ্বান-অনুরোধ সত্ত্বেও পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়া রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের বহনকারী আর কোনো নৌকা ভিড়তে না দেওয়ার সিদ্ধান্তে এখনো অনড় রয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, মালয়েশীয় উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জুনাইদি গতকাল কুয়ালালামপুরে বলেন, তাঁরা মোটেই সময় নষ্ট করবেন না। শিগগিরই ১ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীকে দেশে পাঠিয়ে দেবেন।
No comments:
Post a Comment