Wednesday, May 13, 2015

বিভীষিকার স্মৃতি নিয়ে ফিরছে হাজারো যাত্রী:কালের কন্ঠ

থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া উপকূলে সেসব দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীরা তীরে ভিড়তে না পেরে উল্টো এখন বাংলাদেশে ফিরে আসতে শুরু করেছে। গত তিন দিনে শত শত যাত্রীবোঝাই ছয়টি ট্রলার ফিরে এসেছে বাংলাদেশের উপকূলের কাছাকাছি। এমন তথ্য দিয়েছে ফিরে আসা দুই কিশোর। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে টেকনাফের সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের কাছে কোস্টগার্ডের হাতে এ রকম যাত্রীবোঝাই এ
কটি ট্রলার আটকও হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ১১৬ যাত্রীকে। আরো কয়েক হাজার যাত্রী নিয়ে বহু ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলার গভীর সমুদ্রে ভাসছে। মালয়েশিয়াগামী যাত্রীবোঝাই নৌকা থেকে কক্সবাজারের রামুর দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে ফিরে আসা দুই কিশোরের জবানিতে গতকাল জানা গেছে এসব তথ্য। এই দুই কিশোর হলো- কক্সবাজারের রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের দারিয়ারদিঘি পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা গোলাম সোবহানের ছেলে আবুল মজিদ (১৩) ও দুলাল মিস্ত্রির ছেলে খাইরুল আমিন (১৪)। সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থার কথা বলতে গিয়ে এই দুই কিশোর বলে, দীর্ঘ সময় ধরে নৌকাগুলো সাগরে ভাসতে থাকায় একপর্যায়ে খাবার ও পানি শেষ হয়ে যায়। এতে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ছে যাত্রীরা। সেই সঙ্গে রয়েছে ট্রলারের জ্বালানি সংকট। এই পরিস্থিতি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে হাজার হাজার যাত্রীর, যদি না তাদের উদ্ধারে কেউ এগিয়ে যায়। মজিদ ও খাইরুল মূলত আরো দুই সঙ্গীসহ অপহরণের শিকার হয়েছিল। তাদের প্রতিবেশী আলী আহমদের ছেলে নুরুল হক ও মোহাম্মদ কামালের ছেলে আবদুল্লাহসহ তারা চার বন্ধু একসঙ্গে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও এলাকার নুরু শিকদারের ইটখোলায় কাজ করত। সেখান থেকেই তাদের প্রলোভন দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কক্সবাজারের উখিয়ার মানবপাচারের অন্যতম প্রধান পয়েন্ট সোনারপাড়ায়। সেখানে সোনালী শ্রিম্প হ্যাচারিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলা হয় তাদের। ২৬ এপ্রিল তাদের উখিয়ার সোনারপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সৈকতের ঝাউবনে তাদের বসিয়ে রাখা হয় সারা দিন। সন্ধ্যায় ১০-১২ জনের মুখোশধারী পাচারকারীরা তাদের জোর করে একটি ট্রলারে তুলে দেয়। তারা যাতে চিৎকার করতে না পারে সে জন্য মুখে টেপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। ছোট আকারের এই নৌকায় দুই দিন দুই রাত সাগরে ভাসার পর তাদের তোলা হয় মালয়েশিয়াগামী বড় নৌকায়। কিশোর মজিদ জানায়, সেই বড় নৌকায় ১৬০ জনের মতো যাত্রী ছিল। তাদের মধ্যে ২২ জন রোহিঙ্গা নারীও ছিল। যাত্রীদের মধ্যে রোহিঙ্গা ছাড়াও বাংলাদেশের নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দাও রয়েছে। নৌকায় সকালে ও বিকেলে পেয়ালায় করে ভাত ও মিষ্টি লাউ খেতে দেওয়া হতো। সবচেয়ে বেশি অভাব ছিল পানির। আরেক কিশোর খাইরুল আমিন জানায়, গভীর সমুদ্রে অপেক্ষমাণ থাইল্যান্ডের বড় নৌকায় অবস্থান করে থাইল্যান্ডে মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের বড় নেতা। ওই নেতার কাছে তাদের তুলে দিয়ে জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে নেয় স্থানীয় মানবপাচারকারীচক্রের সদস্যরা। বড় নৌকায় তাদের গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হয়। তবে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সীমান্তে সেই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের কারণে তাদের বহন করা বড় নৌকাটি সীমান্তে ভিড়তে পারছিল না। এভাবে সাগরে ভাসার পর তীরে ভিড়তে না পেরে নৌকার চালক উল্টো ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। দুই কিশোর জানায়, নৌকার চালক হচ্ছে থাইল্যান্ডের বাসিন্দা এবং অন্যদের বেশির ভাগই মিয়ানমারের বাসিন্দা। সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের কাছে এনে রবিবার দুপুরে তাদের সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। তাদের হাতে একটি প্লাস্টিকের ছোট জ্যারিকেন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সাগরে ফেলে দেওয়ার পর মিয়ানমারের একটি মাছ ধরার নৌকা তাদের উদ্ধার করে। সেই নৌকায় তারা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে আসে। সেখান থেকে সোমবার রাতে বাড়ি ফেরে তারা। মাজেদের বাবা গোলাম সোবহান বলেন, 'আমার ছেলেসহ চার কিশোরকেই অপহরণ করে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল মূলত মুক্তিপণ আদায়ের জন্য। তবে এ যাত্রায় আল্লাহ রহমত করেছেন।' খাইরুলের বাব দুলাল মিস্ত্রি বলেন, 'আমার ছেলেকে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য নিয়েছিল। কিন্তু আমি কোত্থেকে সেই মুক্তিপণের টাকা দিতাম তা চিন্তাও করতে পারছি না।' ১১৬ যাত্রীসহ ট্রলার আটক : সেন্ট মার্টিনসের অদূরে বঙ্গোপসাগরে ১১৬ মালয়েশিয়াগামী যাত্রী নিয়ে অবস্থানরত একটি ট্রলার আটক করেছে কোস্টগার্ড। ওই ট্রলারে কতজন নারী, পুরুষ বা কতজন বাংলাদেশি ও কতজন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছে সেটা গতকাল রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত জানা যায়নি। এ ছাড়া ট্রলারটিতে কোনো দালাল ছিল কি না সেটাও জানা যায়নি। কোস্টগার্ড কর্মকর্তারা জানান, যাত্রীসহ ট্রলারটি নিয়ে টেকনাফ রওনা হয়েছেন কোস্টগার্ডের সদস্যরা। থাইল্যান্ডের উপকূলীয় জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান এবং শত শত বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক উদ্ধারের পর সাগরে প্রায় আট হাজার যাত্রী ভাসমান অবস্থায় রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ায় দুই দফায় প্রায় দুই হাজার যাত্রী আটক হয়েছে, যাদের মধ্যে বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকই বেশি। জানা গেছে, গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ডিক্সন চৌধুরীর নেতৃত্বে কোস্টগার্ড সদস্যরা সাগর থেকে ট্রলারটি আটক করেন। কয়েক দিন ধরে ট্রলারটি সেন্ট মার্টিনসের কাছাকাছি মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান করছিল। কোস্টগার্ড চট্টগ্রাম ইস্টার্ন জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট শহিদুল ইসলাম জানান, সীমান্তবর্তী সীতা পাহাড় এলাকাটি মিয়ানমারের মধ্যে পড়েছে। সোমবার থেকে ট্রলারটির ওপর নজর রাখা হয়েছিল। গতকাল বিকেলে ট্রলারটি বাংলাদেশের জলসীমায় পাওয়ার পর ১১৬ যাত্রীসহ আটক করা হয়েছে। এদিকে গত সোমবার সকালে ভুট্টো নামের চকরিয়া উপজেলার এক যুবক আটক হওয়া ট্রলার থেকে মোবাইল ফোনে তাঁর ভাই নূর হোসেনকে ফোন করে উদ্ধারের অনুরোধ জানান। গতকাল নূর হোসেন টেকনাফ আসেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, ভুট্টো মোবাইল ফোনে বলেছিলেন ট্রলারটিতে প্রায় ১৩২ জন যাত্রী রয়েছে, যার মধ্যে ২২ জন রোহিঙ্গা নারী। বাদবাকি সবাই বাংলাদেশি। নূর হোসেন আরো জানান, তাঁর ভাই বাড়ি থেকে বের হয়েছেন প্রায় ২৫ দিন আগে। ভুট্টো তাঁকে ফোনে বলেছেন, নৌবাহিনীর ভয়ে ট্রলারটি সেন্ট মার্টিনসে ভিড়তে সাহস করেনি। ট্রলারটির মালিক হাসেম নামের এক ব্যক্তি। এর মাঝির নাম নবী হোসেন।

No comments:

Post a Comment