Saturday, May 9, 2015

ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রার্থীদের দুর্ভোগ:যুগান্তর

ময়মনসিংহ সদরের বাসিন্দা ঝর্ণা বেগম। বিআরএস রেকর্ডে মুদ্রণ ত্রুটির কারণে তার জমির দাগ নম্বরের পরিবর্তন হয়ে গেছে। বয়রা ভালুকা মৌজায় তার জমির দাগ নম্বর ৬ হাজার ৯১০। কিন্তু নতুনভাবে করা এই রেকর্ডে এসেছে ৬ হাজার ৯০১। আর ২৬ শতাংশ জমির জায়গায় রেকর্ড হয়েছে ২৪ শতাংশ। এই ছোট ত্রুটির কারণে ২০১৩ সালে ময়মনসিংহের ল্যান্ড সার্ভে (ভূমি জরিপ) ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন তিনি। মামলা নম্বর ১৩৭৫৩/১৩। কিন্তু মামলার এখন
ও নিষ্পত্তি হয়নি। শুনানির তারিখ পড়ছে এক বছর অন্তর। অথচ সামান্য এই ত্রুটি সরকারের সংশ্লিষ্ট সহকারী ভূমি কমিশনারকেই (এসিল্যান্ড) নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেয়া রয়েছে। শুধু ঝর্ণা বেগম নন, ময়মনসিংহের ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে এ ধরনের প্রায় ৩২ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এভাবে সারা দেশে স্থাপিত ৪২টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় দুই লাখের উপরে। অথচ ৪২টি ট্রাইব্যুনালের মধ্যে ১২টি ট্রাইব্যুনালে নিয়মিত বিচারক আছেন। বাকিগুলো চলছে ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিয়ে। নেই প্রয়োজনীয় লোকবলও। ফলে দিনে দিনে এসব ট্রাইব্যুনালে মামলার জট বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি মামলার শুনানির জন্য এক বছর, আট মাস বা ছয় মাস অন্তর তারিখ পড়ে। তাও ওই নির্ধারিত তারিখে শুনানি হয় না। আবার ট্রাইব্যুনাল থেকে একটি মামলায় হেরে গেলে তার বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো জায়গা নেই। স্টেট অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট ১৯৫০ (সংশোধিত-২০০৪)-এ আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হলেও আজও তা গঠন করা হয়নি। ফলে ট্রাইব্যুনালের রায় পাওয়ার পর ওই রায়ে সংক্ষুব্ধ হলেও সরাসরি প্রতিকার চাওয়ার কোনো উপায় নেই বিচারপ্রার্থীদের। তাই ট্রাইব্যুনালের আদেশ বা রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়েরের মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে হচ্ছে। বিষয়টি লক্ষ্য করে গত ৩ মার্চ ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল কেন করা হয়নি তা স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) হয়ে জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। আইন সচিব ও ভূমি সচিবকে এ বিষয়ে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানিকালে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। কিন্তু ওই রুলের জবাব এখনও দেয়নি সংশ্লিষ্টরা। এদিকে ভূমি জরিপের ছোটখাটো ত্রুটি সংশোধনের জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা রাজস্ব কর্মকর্তা অথবা ভূমি প্রশাসন বোর্ড এবং ভূমি আপিল বোর্ডকেও ক্ষমতা দেয়া আছে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গঠন করায় তারা ওই দায়িত্ব পালন করেন না বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। ওইসব কর্মকর্তাদের কাছে গেলে তারা ট্রাইব্যুনালে মামলা করার পরামর্শ দিয়ে ভুক্তভোগীদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন। জানা গেছে, ট্রাইব্যুনালগুলোতে মামলার চাপ দেখে ভূমি মন্ত্রণালয় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর এক পরিপত্র জারি করে। সেখানে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জেলায় জরিপের চূড়ান্ত রেকর্ড তথা খতিয়ান প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক হারে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালগুলোতে মামলা হচ্ছে বলে মন্ত্রণালয় অবহিত হয়েছে, যার সংখ্যা উদ্বেগজনক। তৎপ্রেক্ষিতে চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ড সংশোধনের বিষয়ে তিন ধরনের কর্তৃপক্ষ তিন ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে আইনত ক্ষমতাবান। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তা বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) স্টেট অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট ১৯৫০’র ১৪৩ ধারামতে এবং প্রজাস্বত্ব বিধিমালা ১৯৫৫-এর বিধি ২৩(৩) অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ডের করণিক ভুল (ক্ল্যারিক্যাল মিসটেকস) যেমন- নামের ভুল, অংশ বসানোর হিসেবে ভুল, দাগসূচিতে ভুল, ম্যাপের সঙ্গে রেকর্ডের ভুল ইত্যাদি নিজেই সংশোধন করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, স্টেট অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট ১৯৫০’র ১৪৯(৪) ধারামতে ভূমি প্রশাসন বোর্ড বোনাফাইড মিসটেক যেমন- জরিপকালে পিতার মৃত্যুর কারণে সন্তানদের নামে সম্পত্তি রেকর্ড হওয়ার কথা থাকলেও জরিপকারকদের ভুলে তা হয়নি- এমন ভুল সংশোধন করতে পারেন। আবার ভূমি আপিল বোর্ডেরও এ ধরনের ভুলের সংশোধনের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু জনসাধারণের অজ্ঞতা, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলাসহ নানা কারণে এই পরিপত্রের নির্দেশনাও কাজে আসেনি। ফলে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের ওপর মামলার চাপ বেড়েই চলেছে। জানা যায়, বিআরএস জরিপ শুরু হয়েছে ১৯৮৪ সাল থেকে। সারা দেশে এই জরিপ এখনও শেষ হয়নি। যেসব এলাকায় শেষ হয়েছে, সেসব এলাকায় দেখা দিয়েছে নানা ধরনের ত্র“টি-বিচ্যুতি। মাঠ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও চরম অবহেলায় ভুলে ভরা ভূমি জরিপের এখন খেসারত গুনতে হচ্ছে জমির মালিকদের। জরিপের পর্চা আর ম্যাপে হাজার হাজার ভুল। কারও জমি পর্চায় আছে তো ম্যাপে নেই। ম্যাপে আছে তো পর্চায় নেই। আবার ম্যাপে থাকলেও শত বছর ধরে যে চৌহদ্দিতে মালিক সম্পত্তি ভোগ-দখল করে আসছেন সেভাবে নেই। এভাবে দেখা দিয়েছে নানান ত্র“টি। এসব বিষয় লক্ষ্য করে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশের জন্য মাত্র ১২টি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। কিন্তু চার-পাঁচটি জেলার সমন্বয়ে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করায় দেখা দেয় মহা-বিড়ম্বনা। একশ-দেড়শ মাইল দূর থেকে ওইসব ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের বিচারপ্রার্থীদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দেখা দেয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকার একই বছরের ২৯ নভেম্বর আরেকটি গেজেটের মাধ্যমে সারা দেশের জন্য ৪১টি ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করেন। এছাড়া ঢাকার জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এসব ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ পরিচালনা করবেন যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার একজন বিচারক। কিন্তু এসব ট্রাইব্যুনালের জন্য মাত্র ১৩টি বিচারকের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন ১২ জন যুগ্ম জেলা জজকে পদায়ন করা হয়েছে। বাকিগুলো চলছে ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিয়ে। যার কারণে মামলার জট বেড়েই চলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকার ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে ৮,২৭৩টি, ময়মনসিংহের ট্রাইব্যুনালে ৩১,৩৭২টি, কিশোরগঞ্জের ট্রাইব্যুনালে ১৭,৫৩৯টি, পাবনার ট্রাইব্যুনালে ২,৬৫৮টি, নোয়াখালীর ট্রাইব্যুনালে ৩,৮১৮টি, টাঙ্গাইলের ট্রাইব্যুনালে ৭,৪৮১টি, খুলনার ট্রাইব্যুনালে ৩,৮০০টি, বরিশালের ট্রাইব্যুনালে ২,৭৫২টি, বগুড়ার ট্রাইব্যুনালে ৩,৪৩৪টি, কুমিল্লার ট্রাইব্যুনালে ২,৯৭৫টি, যশোর ট্রাইব্যুনালে ২,২৪২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অন্য ট্রাইব্যুনালগুলোতেও একইভাবে হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : জানতে চাওয়া হলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, মাঠ পর্যায়ে যারা ভূমি জরিপের কাজ করেছেন তারা প্রচুর অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। হাজার হাজার মামলা তারই প্রমাণ। কিন্তু এই হাজার হাজার মানুষের ভোগান্তির জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেই। জড়িতদের বিরুদ্ধে এখন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে ভবিষ্যতেও যারা জরিপের কাজে যুক্ত থাকবেন তারা একই ধরনের অনিয়ম করবেন। বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য আইনের বিধি তৈরি, আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচারক নিয়োগের জন্য সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। জানতে চাইলে ময়মনসিংহের জেলা বার সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, আমাদের এখানে ২০১২ সালে প্রথম যখন ট্রাইব্যুনাল হয়, তখন বিচারক ছিলেন। এখন বিচারক নেই। ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিয়ে কাজ চলছে। আবার পর্যাপ্ত লোকবলও নেই। প্রসেস সার্ভার নেই। ফলে মামলার বাদী-বিবাদী পক্ষকে নোটিশ পাঠানোর কোনো লোক পাওয়া যায় না। যার কারণে প্রায় ৩১-৩২ হাজার মামলার জট বেঁধেছে। এখন এক বছর দেড় বছর অন্তর একটি মামলার শুনানির তারিখ পড়ছে। তিনি আরও বলেন, ছোটখাটো ত্র“টি নিষ্পত্তিতে এসিল্যান্ডকে (সহকারী ভূমি কমিশনার) দায়িত্ব দেয়া থাকলেও তারা এই দায়িত্ব ঘাড়ে নেন না। ফলে বাধ্য হয়েই বিচারপ্রার্থীদের ট্রাইব্যুনালের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে।  

No comments:

Post a Comment