ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলোর যেকোনো একটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে প্রতীকীভাবে হস্তান্তর করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর ভারতের ভেতর বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর যেকোনো একটি প্রতীকীভাবে নরেন্দ্র মোদির হাতে তুলে দেবেন শেখ হাসিনা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময়ের এ চিত্র দেখার সুযোগ পাবে ছিটমহলবাসী। ভারত সরকার সীমান্ত বিল পাস করার পর দুই দেশের অচিহ্নিত
সীমানাও ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে, সেই সীমানা মানচিত্রেও সই করবেন দুই প্রধানমন্ত্রী। তবে তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যুটি আটকে যেতে পারে ফেনী নদীতে এসে। কারণ ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ফেনী নদীর পানিবণ্টনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ৬ জুন বাংলাদেশ সফরে আসছেন নরেন্দ্র মোদি। দুই দেশের অমীমাংসিত নানা ইস্যু ও দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয় চূড়ান্ত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করছে। ইতিমধ্যে দুই নেতার সম্ভাব্য আলোচ্য বিষয় প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। সফরকালে মানবপাচার রোধ, উভয় দেশের কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে। একে অন্যের সড়ক, রেল ও নৌপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে পণ্য বাণিজ্য উন্মুক্ত রেখে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তি সই হবে। তবে কাক্সিক্ষত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদিও শীর্ষ দুই নেতার আলোচনায় বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। একই সঙ্গে ফেনী নদীর পানিবণ্টন, গঙ্গা ব্যারাজ বাস্তবায়ন, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি, বিএসটিআই ও বিআইএসের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে। ওই সময় বাংলাদেশকে একটি ড্রেজার (নদী খনন যন্ত্র) উপহার দেবেন নরেন্দ্র মোদি। ড্রেজারটি চলতি মাসের শেষের দিকেই বাংলাদেশে পৌঁছাবে। নরেন্দ্র মোদি সেটি মংলা বন্দর ট্রাস্টকে হস্তান্তর করবেন। মোদির সফর উপলক্ষে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো বিভিন্ন প্রস্তাব ও বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব উঠে এসেছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্তে। তাতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি সইয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। এ চুক্তি হলে ভারত বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও নৌপথ ব্যবহার করে সেভেন সিস্টারখ্যাত রাজ্যগুলোতে সহজেই পণ্য পাঠাতে পারবে। আর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দুই দেশ নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সড়কপথে পণ্য আনা-নেওয়া করতে পারবে। এ চুক্তি হলে ভারতের ওপর দিয়ে ঢাকা ও কাঠমাণ্ডুর মধ্যে সরাসরি বাস যোগাযোগও চালু হবে। নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি সই হবে বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তবে এ চুক্তি পুরোপুরি কার্যকর হতে বেশ সময় লাগবে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) মনোজ কুমার রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, চুক্তি সইয়ের পর সড়কপথ ব্যবহারের জন্য সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয় আলাদা প্রটোকল তৈরি করবে। কোন দেশ অন্য দেশের কোন কোন সড়ক ও রেলপথ কিভাবে ব্যবহার করবে, চার্জ ও লেভির পরিমাণ কেমন হবে- সেগুলো ওই সময় নির্ধারিত হবে। এদিকে ভারত ও বাংলাদেশ পরস্পরের নৌপথ ব্যবহার করতে পারছে বিদ্যমান ‘প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড (পিআইডাব্লিউটিটি) অনুযায়ী। তবে এর আওতায় বাংলাদেশ বা ভারত একে অন্যের নৌপথ ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে পণ্য বাণিজ্য করতে পারে না। গত সোমবারের মন্ত্রিসভা বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তি সংশোধনের অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি হলে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের ভেতরের নৌপথ দিয়েই বাণিজ্য করতে পারবে বাংলাদেশ। এখন সমুদ্রপথে নেপাল থেকে বাংলাদেশে পণ্য আসতে ২১ দিন সময় লাগবে, ভারতের নৌপথ ব্যবহারের সুযোগ পেলে সময় লাগবে ছয় দিন। তবে এ বিষয়ে এখনো ভারত সরকারের ইতিবাচক বার্তা বাংলাদেশ সরকারের হাতে এসে পৌঁছায়নি বলে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান পিআইডাব্লিউটিটি অনুযায়ী, প্রতি দুই বছর পর পর নবায়ন করতে হয় এ চুক্তিটি। গত বছর দুই দেশের নৌসচিব পর্যায়ের বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে এর মেয়াদ পাঁচ বছর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নৌ ট্রানজিটের জন্য সার্ভিস চার্জ ও ব্যাংক গ্যারান্টি আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু ভারত সার্ভিজ চার্জ ও ব্যাংক গ্যারান্টি না দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে নৌ ট্রানজিট অব্যাহত রাখতে আগ্রহী। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার প্রস্তাবও রয়েছে ভারতের পক্ষ থেকে। নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে বলে আশা করছে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা চালুর পর এর আদলে পদ্মা নদীর ওপর ‘গঙ্গা ব্যারাজ’ নির্মাণের পরিকল্পনা বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের। নদীর রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা অংশ থেকে পাবনার সুজানগর উপজেলার সাতপাড়িয়া পর্যন্ত ২ দশমিক ১ কিলোমিটার লম্বা এ ব্যারেজ নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। ফারাক্কা হয়ে আসা পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে সেচকাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এ ব্যারেজ নির্মাণ করা হলেও এর ডেকের ওপর চার লেনের সড়কের পাশাপাশি থাকবে ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থাও। ব্যারেজের সুড়ঙ্গপথে চলতে পারবে নৌযানও। এ ব্যারেজ প্রকল্প থেকে উৎপাদিত হবে ১১৩ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ। স্থাপন করা হবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইনও। এ ব্যারেজের মাধ্যমে ধরে রাখা পানি চ্যানেলে সরবরাহ করে ২৬ জেলার ১৬৫ উপজেলায় সেচকাজে ব্যবহার করা হবে। প্রস্তাবিত ব্যারেজটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে ৮২ কিলোমিটার এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজ (পাকশী ব্রিজ) ও রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৫২ কিলোমিটার ভাটিতে নির্মাণ করার কথা। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। মালয়েশিয়া ও চীন এতে অর্থায়নের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৯৬ সালে ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ১০ দিন অন্তর অন্তর ৪০ হাজার কিউসেক পানি পায়। সংরক্ষণের অভাবে এ পানি বিনা বাধায় সাগরে চলে যায়। শুষ্ক মৌসুমে এ পানি বাংলাদেশের কোনো কাজে লাগে না। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়নের জন্য ভারতকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ওই প্রস্তাব সম্পর্কে কোনো মতামত না জানিয়ে দেশটি ওই প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য চায় বাংলাদেশের কাছে। সে মতে, প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ভারত সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে এখনো সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় গঙ্গা ব্যারেজ বাস্তবায়নের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি মোদির সফরের সময় হচ্ছে না বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ২০১১ সালে ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের পর খুব একটা অগ্রগতি নেই। বরং ভারতের পক্ষ থেকে তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির সঙ্গে ফেনী নদীর পানিবণ্টনের শর্ত জুড়ে দেওয়ায় এটি আরো জটিল রূপ নিয়েছে। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের সফরের সময়ই তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির সঙ্গে ফেনী নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টিও জড়িয়ে ফেলে ভারত। ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তি হলে তখন বন্ধ থাকা বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা সেচ প্রকল্পসংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে ভারত। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি ব্যবহার করতে পারবে। ভারত ইতিমধ্যে একতরফাভাবে কুশিয়ারা থেকে ১০০ কিউসেক পানি ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ মনে করে, মনমোহনের সফরের সময় ফেনী নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি যেহেতু তিস্তার পানিবণ্টনের সঙ্গে জড়ানো হয়েছে, তাই সুরমা-কুশিয়ারা সেচ প্রকল্পের সঙ্গেও ফেনী নদীর পানিবণ্টন বিষয়টি সম্পৃক্ত করা ভারতের উচিত নয়। বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ সুরমা-কুশিয়ারা সেচ প্রকল্প চালুর বিপরীতে ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরাবাসীর খাওয়ার জন্য ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি সরবরাহ করতে আগ্রহী। এখন একতরফাভাবে ভারত ফেনী নদী থেকে প্রায় ৩৫-৪০ কিউসেক পানি ব্যবহার করছে। এদিকে বাংলাদেশ পণ্যমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের সনদ গ্রহণ করে না ভারতীয় একই ধরনের কর্তৃপক্ষ দ্য ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস (বিআইএস)। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানিকারকদের বড় ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দেশটির বিশাল বাজারে বাংলাদেশের অল্প রপ্তানি আয়ের পেছনে এটি অন্যতম একটি কারণ। বাংলাদেশের বিএসটিআইয়ের সনদ গ্রহণ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ভারতকে অনুরোধ করা হলেও দেশটি তাতে সাড়া দেয়নি। মোদির সফরে আলোচনার টেবিলে এটি গুরুত্ব পাবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয় বিএসটিআই ও বিআইএসের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা চুক্তি সইয়ের জন্য ভারতের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে চুক্তির খসড়াটি গত ১৫ মে চূড়ান্ত করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। মোদির সফরে এটি সই হওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। মোদির সফরের সময় ত্রিপুরার কমলসাগরে একটি সীমান্তহাট উদ্বোধন, ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস ও ঢাকা-কলকাতা-আগরতলা বাস সার্ভিসও আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবে। এ দুটি রুট চালুর ব্যাপারে ভারতের পক্ষ থেকে চুক্তির খসড়া পাঠানো হয়েছে, যা মোদির সফরের সময় সই হবে। ফেনী নদীর ওপর একটি সেতুও নির্মাণ করে দেবে ভারত। গত ১০ মে এ জন্য ভারতীয় সমীক্ষাদল বাংলাদেশে এসে কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া মানবপাচার রোধ, জাল নোট প্রতিরোধ এবং বাংলাদেশ-ভারতের কোস্টগার্ডের মধ্যে এমওইউ স্বাক্ষরের জন্য আলাদা আলাদা খসড়া ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে দিয়েছে ভারত। এগুলো চূড়ান্ত করতে কাজ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সারদা পুলিশ একাডেমিতে একটি আইটি (তথ্যপ্রযুক্তি) ল্যাব স্থাপনে সহায়তা করবে ভারত। ইতিমধ্যে ওই প্রকল্পের সব কাগজপত্র ভারত সরকারকে দিয়েছে বাংলাদেশ।
No comments:
Post a Comment