Monday, June 15, 2015

ছিটবাসীর শুধু ‘নাই নাই’, বিয়ের কাবিনও নাই:প্রথম অালো

রবিউল আলম সংসার করছেন প্রায় ১৪ বছর। কিন্তু বিয়ের কাবিন নেই। তাঁর বড় ভাই মজিদুল ইসলাম নির্বাচিত ওয়ার্ড সদস্য। তাঁরও বিয়ের কাবিন রেজিস্ট্রি হয়নি। এমনকি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামও বিয়ে করেছেন কাবিন ছাড়া। কাবিন ছাড়া বিয়ের এসব ঘটনা পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার কাজলদীঘি ছিটমহলের। স্বেচ্ছায় নয়, নিরুপায় হয়েই শুভকাজটি তাঁদের করতে হয়েছে বিনা কাবিনে। কারণ, প্রথমত ছিটে কোনো কাজি নেই। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের কাজিদে
র পক্ষে ভারতীয় ছিটবাসীর কাবিন রেজিস্ট্রি করার নিয়ম নেই। ‘নাই, নাই আর নাই। যেইটার কথা বলবেন, ছিটমহলবাসীর সেইটাই নাই।’—বলছিলেন রবিউল আলম। তাঁর বড় ভাই আর চেয়ারম্যানও সায় দিলেন এ কথায়। ৬ জুন দুপুরে তাঁদের সঙ্গে কথা হয় কাজলদীঘির দিনবাজারে। জানান, ‘নেই’-এর বৃত্তেই বন্দী তাঁদের জীবন। এখন অপেক্ষায় আছেন এই বৃত্ত থেকে মুক্তির। শালবাড়ী, কাজলদীঘি, বেলুয়াডাঙ্গা ও নাটক টোকা—পাশাপাশি লাগোয়া এই চার ছিটমহল নিয়ে ছিটবাসীরা একটি ইউনিয়ন পরিষদের মতো করেছেন। নির্বাচিত কমিটির নাম ‘এসকেবিএন ছিটমহল নাগরিক কমিটি’, সংক্ষেপে তাঁরা বলেন, ‘এসকেবিএন’। দীর্ঘ দিন থেকে সেখানে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হচ্ছে। বাংলাদেশে ছিটমহলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় একক ছিট কুড়িগ্রামের দাশিয়ার ছড়া এবং এসকেবিএন—এ দুটিতেই সরাসরি ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন ছিটবাসী। তবে দাশিয়ার ছড়ায় ২০০৫ সাল থেকে নির্বাচন বন্ধ। এসকেবিএন ছিটে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ নির্বাচন হয়। দাশিয়ার ছড়ায় নারীরা ভোটার ছিলেন না। এখানে নারীরাও ভোটার। চার হাজারের বেশি ভোটার। সিরাজুল ইসলাম ১৯৯৩ সাল থেকে টানা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নিজে কিছু বললেন না, তবে তাঁর ভোটাররা দাবি করেন—তাঁদের ছিটেই বাংলাদেশের সব থেকে নির্ভেজাল ভোট হয়। কোনো জাল ভোট নেই, কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। এটি তাঁদের জন্য গর্বের। তবে অপর জরুরি সব বিষয় না থাকা নিদারুণ কষ্টের। তাঁরা জানান, ছিটবাসীর নাগরিকত্ব নেই, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, চাকরি, নিরাপত্তা, আইনি অধিকার—কিছুই নেই। ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা নেই। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা নেই। বিদেশি দাতা সংস্থা বা বেসরকারি সংস্থা নেই। এমনকি চলাচলের মতো রাস্তাও নেই। টিআর, কাবিখা নেই। নিজেরাই খরচাপাতি দিয়ে মাটি কেটে কিছু কিছু রাস্তা করেছেন। এ ছাড়া জমির আল, এর-ওর বাড়ির আনাচ-কানাচ দিয়েই তাঁদের চলাচল করতে হয়। বাস্তবেও গত দেড় সপ্তাহে কুড়িগ্রাম, পাটগ্রাম ও পঞ্চগড়ের ছিটমহলগুলোতে ঘুরে এমন অবস্থাই চোখে পড়েছে। এসকেবিএনের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম জানান, শুধু তাঁদের চার ছিটে নয়, পঞ্চগড়ের অধিকাংশ ছিটেই চল্লিশোর্ধ্ব বয়সীদের ৮০ শতাংশেরই বিয়ের কাবিন নেই। মৌলভির সামনে কলেমা পড়ে কবুলের মাধ্যমে শরিয়ত অনুযায়ী বিয়ে হয়েছে। ইদানীং লোকজনের অনেকে আশপাশের ইউনিয়ন বা আত্মীয়ের ঠিকানা দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন, এঁদেরই কাবিন রেজিস্ট্রি হচ্ছে। কাবিনের চেয়েও ছিটবাসীর বড় সমস্যা হয় চিকিৎসায়। সরকারি হাসপাতালে ছিটের রোগী ভর্তি নিতে চায় না। অনেক সময় দালাল ধরেও লাভ হয় না। বিশেষ করে প্রসবকালে জটিলতা দেখা দিলে মা বা সন্তানের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। তাঁরা জানান, চলতি বছরের এপ্রিলে বেলুয়াডাঙ্গার বেলাল হোসেনের স্ত্রী রোকেয়া আক্তারের প্রসবের সময় জটিলতা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি। মা প্রাণে বাঁচলেও বাচ্চাটি বাঁচেনি। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রসবকালে জাহিদুল হকের স্ত্রী রোজিনা আক্তারের যমজ সন্তান মারা গেছে। গত বছর অক্টোবরে আবদুর রহিমের স্ত্রী মুক্তা বানু প্রসব করেন মৃত সন্তান। এর আগে প্রসবকালে সন্তানসহ মারা গেছেন জয়নাল আবেদিনের স্ত্রী কমলা বেগম। এমন ঘটনা ঘটেছে আবদুল জব্বারে স্ত্রী হামিদা ও হামিদুল ইসলামের স্ত্রী সাবিনার ক্ষেত্রেও। চেয়ারম্যান, সদস্য ও উপস্থিত ছিটবাসীরা জানান, সব ছিটেই প্রসবকালে মা ও শিশুর মৃত্যুর ঘটনা প্রায় নিয়মিত। সব ছিটের শিশুকে পোলিও টিকা খাওয়ানো হয় না। যেখানে হয়, সেখানেও অনিয়মিত। আগে ছিটের শিশুদের স্কুলেও ভর্তি নেওয়া হতো না। এখন ছিটের পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুকে ভর্তি নেওয়া হলেও অনেকের কপালেই নতুন বই হয় না। মূল ভূখণ্ডের শিশুদের বই বিতরণের পর অবশিষ্ট থাকলেই কেবল সেগুলো ছিটের শিশুরা পায়। কিছু থাকে ছেঁড়া-ফাটা। যদি না বাঁচে তবে আগের বছরের শিশুদের পড়া পুরোনো বই তাদের দেওয়া হয়। স্কুলের খাতায় ছিটের শিশুদের নামও থাকে একেবারে শেষে। আবুল বাশার আক্ষেপ করে বললেন, ‘মুই ভালো করিই কবার পামু মোর ছাওয়া পাইছে ছেঁড়া বই।’ বিদ্যুৎহীন ছিটে অবস্থাপন্ন কেউ কেউ বাড়িতে সোলার প্যানেল বসিয়েছেন, নগদ অর্থে। মূল ভূখণ্ডের গ্রামে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এ জন্য ঋণ দেয়। ছিটে এমন ঋণ কার্যক্রম নেই। চলাচলের ক্ষেত্রে যেসব ছিটের ভেতর দিয়ে নদী বা খাল বয়ে গেছে সেখানে খুবই সমস্যা। নিজেরাই ‘হাউলি’ (স্বেচ্ছাশ্রম) ও অর্থে ‘খড়খড়ি’ (বাঁশের সেতু) তৈরি করেছেন। পঞ্চগড়ের ৩৬টি ছিটের মধ্যে এসকেবিএন ছাড়া আর কোথাও সুসংগঠিত কমিটি না থাকায় সেসব ছিটে এ ধরনের অবকাঠামোগত সামান্য সুবিধাও কম। আইনি অধিকার ও সুযোগ না থাকায় ছিটবাসীকে অনেক অন্যায়-অবিচার সহ্য করে যেতে হয়। থাকতে হয় নিরাপত্তাহীন। তবে দীর্ঘকালের এই বঞ্চনার যবনিকাপাত হলো। ছিটমহল হস্তান্তর এখন সময়ের ব্যাপার হওয়ায় ‘হাসি’ ফুটেছে ছিটবাসীর মুখে। অপেক্ষায় আছেন নেই-এর বৃত্ত থেকে বের হওয়ার।

No comments:

Post a Comment