বঙ্গোপসাগরে ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি ছয় হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে ভারত। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর পর বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে স্থায়ী সমুদ্রসীমা পেল। নেদারল্যান্ডসের হেগে স্থায়ী সালিসি আদালতের রায় ঘোষণার এক দিন পর গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ঢাকায় প্রেস ব্রিফিং করে রায়ের ব
িস্তারিত জানান। প্রায় একই সময় আদালতের ওয়েবসাইটেও রায় প্রকাশিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আদালত বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন) ও ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপান অঞ্চলে (কন্টিনেন্টাল শেলফ) বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম অধিকার সুনিশ্চিত করে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা নির্ধারণী মামলার রায় ঘোষণা করেছেন। পাঁচজন বিচারকের ওই ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছেন, সমদূরবর্তী পদ্ধতিতে দুই দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হলে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী তা ন্যায্যতা নিশ্চিত করে না। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় প্রত্যাশিত অগ্রগতি না হওয়ায় ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সমুদ্র আইনবিষয়ক জাতিসংঘ সনদের আর্টিকেল ২৮৭ ও অ্যানেক্স আট, আর্টিকেল এক অনুযায়ী স্থায়ী সালিসি আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি হয়েছে ২০১২ সালে। গত সোমবার স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি রাষ্ট্রাধীন সমুদ্র (টেরিটোরিয়াল সি), ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ নেই। এর মধ্য দিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমাবিষয়ক বাংলাদেশের মামলার পরিসমাপ্তি ঘটল। স্থায়ী সালিসি আদালতের রায় পর্যালোচনা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, এই রায় উভয় রাষ্ট্রের (বাংলাদেশ ও ভারত) জন্য বিজয় নিশ্চিত করেছে। এই বিজয় বন্ধুত্বের বিজয়। এই বিজয় বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের বিজয়। এর কারণ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তিন দশকের বেশি সময় ধরে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা, যা দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল, তা আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে অবশেষে নিষ্পত্তি হলো। আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিনের বিরাজমান এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভারতের সদিচ্ছাকে ও আদালতের রায় মেনে নেওয়ার জন্য আমরা ভারত সরকারকে সাধুবাদ জানাই।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা করেন, এই রায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নেবে এবং সমুদ্রবিষয়ক ক্ষেত্রে সমঝোতা ও সহযোগিতার সম্পর্কে নতুন এক দুয়ার খুলে দেবে। রায়ের প্রভাব প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এখন থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপানে বাংলাদেশের অবাধ প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। গভীর সাগরে মৎস্য আহরণ এবং সমুদ্রের তলদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে আমাদের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জনগণ তাদের পুষ্টির উৎস, সম্পদ এবং কর্মসংস্থানের জন্য সমুদ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও সমুদ্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এই রায়ের স্বচ্ছতা ও আইনগত নিশ্চয়তার ফলে বাংলাদেশের জনগণ গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রসম্পদ ব্যবহার করে লাভবান হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। সমুদ্র ও সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলোতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে জনগণের আর্থ-সামাজিক ও কল্যাণমুখী পরিবর্তন আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগামী ১ ও ২ সেপ্টেম্বর ‘ব্লু ইকোনমি’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালার আয়োজন করছে বলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান। মিয়ানমারের মতো ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশ বিজয় উৎসব করবে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাঁর বক্তব্যে এর উত্তর রয়েছে। রায়ে বাংলাদেশের জয় হয়েছে, ভারতেরও জয় হয়েছে। ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের পক্ষে মামলার এজেন্ট সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি ডা. দীপু মনি, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয়) মুস্তাফা কামাল, মামলার ডেপুটি এজেন্ট ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্রবিষয়ক ইউনিটের প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘আজ অত্যন্ত আনন্দের দিন। একটি বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান আমরা করতে পেরেছি। দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষায়, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ রকম একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপের সঙ্গে এর একেবারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত পুরোপুরি সম্পৃক্ত থাকার সুযোগকে নিজের জন্য বিরাট সৌভাগ্য বলে তিনি দাবি করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। ডা. দীপু মনি বলেন, ‘আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার যেকোনো বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা- এ দুটো বিষয়কেই আমরা সমুন্নত রেখেছি। এ কারণেই আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদা বেড়েছে।’ ডা. দীপু মনি বলেন, ‘প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে মামলার নিষ্পত্তি হওয়ায় সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব, সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার ও একসঙ্গে কাজ করার পথে আর কোনো বাধা অন্তত বঙ্গোপসাগরের ক্ষেত্রে রইল না। আমরা ন্যায্যতার ভিত্তিতে যে দাবি করেছিলাম সেই ন্যায্যতা জয়ী হয়েছে।’ দীপু মনি আরো বলেন, ‘একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সরকার ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ছাড়া আর কেউ বঙ্গোপসাগরে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোনো ধরনের উদ্যোগ এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তাদের এর ব্যর্থতার বিপরীতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যার পদক্ষেপ আমাদের বলতে বাধ্য করে যে আওয়ামী লীগই পারে, আওয়ামী লীগই পারবে। আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি, আমরা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারি।’ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (সমুদ্রসীমাবিষয়ক ইউনিট) মো. খুরশেদ আলম রায়ের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, “২০০ নটিক্যাল মাইল পাওয়ার অধিকার বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশকেই দিয়েছেন আদালত। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছিল। রায়ে সমুদ্রের একটি অংশকে ‘গ্রে এরিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারত সেখানে মাছ ধরতে পারবে। কিন্তু যেহেতু সেখানে বাংলাদেশের শুরু তাই তলদেশের যে সম্পদ আছে তার অধিকার আমাদের দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ওই এলাকার মালিকানা পরে ঠিক করা যেতে পারে। ওই গ্রে এরিয়া ৫০ কিলোমিটার এলাকার মতো হতে পারে।” তিনি আরো বলেন, আদালতের রায়ে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে ১৭৭ ডিগ্রি ৩০ মিনিট লাইন ধরে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি ভারতকে যেমন ‘কাট অফ’ করে না তেমনি বাংলাদেশকে মহীসোপানের অধিকার পাওয়ার সুযোগ দেয়। ভারতের প্রতিক্রিয়া : রায় সম্পর্কে গতকাল বিকেলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন বলেন, ‘সমুদ্র আইনবিষয়ক জাতিসংঘ সনদের (আনক্লজ) অ্যানেক্স-সেভেনের আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে গঠিত সালিসি ট্রাইব্যুনাল গত ৭ জুলাই রায় দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়কে আমরা সম্মান জানাই। আমরা এ রায় ও এর সম্পূর্ণ প্রভাব পর্যালোচনা করছি।’ সৈয়দ আকবর উদ্দিন বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সমুদ্রসীমার সুরাহা হওয়ার ফলে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ইস্যুর নিষ্পত্তি হলো, যা পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সদিচ্ছা আরো জোরদার করবে।’ রায়ে ভারতীয় বিচারকের ভিন্নমত : সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মো. খুরশেদ আলম বলেন, রায়ে আপিলের সুযোগ নেই, কিন্তু ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) দেওয়ার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় বিচারক শ্রীনিবাসা রাও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন। বাংলাদেশ চেয়েছিল ১৮০ ডিগ্রি বরাবর সীমানা রেখা। আদালত আমাদের ১৭৭ ডিগ্রি ৩০ মিনিট বরাবর দিয়েছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে ১৭৭ ডিগ্রি ৩০ মিনিট বরাবর সীমানা দেওয়ার ফলে ভারতের জন্য ন্যায্যতা হয়নি। এর পেছনে আদালত যে যুক্তি দিয়েছেন তা রাওয়ের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, যেহেতু ৪-১-এ এটি গৃহীত হয়ে গেছে তাই এর কোনো প্রভাব থাকবে না। হারাতে হয়নি বিরোধপূর্ণ ১০ ব্লকের একটিও : বঙ্গোপসাগরের ব্লকগুলোর ওপর রায়ের প্রভাব নিয়ে আলোচনার সময় মিয়ানমারের সঙ্গে রায়ের পর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে একে নিয়ে সমালোচনার প্রসঙ্গ তোলেন মো. খুরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘গত দুই-তিন বছরে আমরা অনেক লেখালেখি দেখেছি। আমি আপনাদের বলতে চাই, কোনো একটি লেখাতেও আইনসম্মতভাবে রায়ের সমালোচনা করা হয়নি। কেউ করেছেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, কেউ করেছেন দেশের প্রতি অতি প্রেম দেখিয়ে। কিন্তু আমি বলব, একটি আইনের সিদ্ধান্ত বিষয়ে সমালোচনা আইনসম্মতভাবেই করা উচিত।’ খুরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা যে ২৮টি ব্লক ঘোষণা করেছিলাম এর মধ্যে ১৭টি মিয়ানমার তার নিজের এলাকায় বলে দাবি করেছিল। আর দশটি দাবি করেছিল ভারত। এবারের রায়ে ১০টি ব্লকের ১০টিই আমাদের সীমানার মধ্যে রয়ে গেছে। খুবই অল্প অংশ পশ্চিমের দিকে পড়েছে বিধায় হয়তো আমাদের কিছুটা পুনর্বিন্যাস করতে হবে।’
No comments:
Post a Comment