িন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া অসৎ নোটারি পাবলিকের উকিল, স্ট্যাম্প বিক্রেতা, গোডাউনের সিকিউরিটি গার্ড, শুল্ক ও গোয়েন্দা বিচারালয়ের সদস্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মীও এই সিন্ডিকেটের হাতকে শক্তিশালী করছে। জানা গেছে, কাস্টসম কর্তৃক আটক এবং গোডাউনে রক্ষিত চোরাই সোনাসহ মূল্যবান পণ্য খালাসের বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে কাগজপত্রে বৈধ দেখানো হয়। কাস্টমস আদালত কাগজপত্রের ভিত্তিতে রায় দেন। সোনার মূল্য ব্যাংকে পরিশোধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা খালাস করে দিচ্ছে। অধিকাংশ সময় পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে থাকে ভুয়া জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে। স্বর্ণ লোপাট করার পর কৌশলে সিন্ডিকেটসংশ্লিষ্ট কাগজপত্রগুলোও গায়েব করে দেয়া হয়। এতে পুরো কার্যক্রমটি একসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। আর আটককৃত স্বর্ণের বেশিরভাগ মালিক চোরাকারবারি হওয়ায় তারাও একপর্যায়ে এসব পণ্যের দাবি ছেড়ে দেন। এতে কোনো সাড়া শব্দ ছাড়াই সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যায়। যুগান্তরের নিবিড় অনুসন্ধানে বিষয়গুলো ওঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনার জাকিয়া সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ খালাসের বিষয়টি তার আমলে হয়নি। আগের কমিশনারের বিচারাদেশে এ ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি শুনেছেন। তবে তার আমলে একজন কাস্টমস কর্মকর্তার ছেলেকে ল’ কনসালটেন্ট করে অবৈধ ও জালিয়াতির মাধ্যমে ২০ কোটি টাকার স্বর্ণ নেয়ার একটি গোপন প্রক্রিয়া হচ্ছিল। বিষয়টি জানার পর তিনি তাৎক্ষণিক স্বর্ণের চালানটি আটকে দেন এবং এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করেন। তিনি আরও বলেন, তার আমলে নিু আদালত থেকে রায় নিয়ে অসংখ্য চোরাকারবারি রাজস্ব ছাড়াই শত শত কোটি টাকার আটককৃত স্বর্ণ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এসব রায়ের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চ আদালতে মামলা করে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেন। এই অনিয়ম-দুর্নীতি প্রথম ধরা পড়ে জাকিয়া সুলতানা নামে ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনারের চোখে। এ নিয়ে চোরাকারবারিদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। সম্প্রতি ৫০ কেজি ওজনের খালাস দেয়া একটি চালানের প্রকৃত মালিকও ঢাকা কাস্টম হাউসে অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট চক্রটি মূলত ১০-১২ বছর কিংবা তারও অনেক আগে আটককৃত সোনাসহ, বৈদেশিক মুদ্রা বা মূল্যবান পণ্যসামগ্রী টার্গেট করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। যেসব পণ্যসামগ্রীর কোনো মালিকানা থাকে না সেগুলো তাদের মূল টার্গেট। এক্ষেত্রে চক্রটি ওই সময় যাদের নামে চোরাচালানের অভিযোগে মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল এবং মালামাল গোডাউনে জমা রাখার সময় যাদের নাম এজাহারে দেয়া হয়েছিল তাদের নামে ভুয়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নি তৈরি করে। এরপর ভুয়া নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ওই পাওয়ার অব অ্যাটর্নিকে সত্যায়নও করে নেয়। তারপর এসব কাগজপত্রের মাধ্যমে নিজেদের আটককৃত স্বর্ণালংকারের মালিকানা দাবি করে কাস্টমস বিচারালয়ে মামলা দায়ের করে। অভিযোগ, এই চক্রের সঙ্গে কাস্টমসের টপ টু বটম অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকেন। বিনিময়ে তারাও মোটা অংকের টাকার ভাগ পান। যেভাবে ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ খালাস হয় : জানা গেছে, ২০০১ সালে তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক (বর্তমানে হযরত শাহজালাল) বিমানবন্দর দিয়ে পাচারের সময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ৩০০ তোলা ওজনের সোনার বার আটক করে। এ সময় জড়িত ৩ পাচারকারী পালিয়ে যায়। তারা হল- মোঃ সামছুল শেখ; বাবার নাম : আলি হোসেন; সাং : নোয়াদ্দা; ডাকঘর : আউটশাহী; থানা : টঙ্গীবাড়ী; জেলা : মুন্সীগঞ্জ। তার পাসপোর্ট নম্বর : কিউ-০৯৬৫৭০৯। আলমগীর হোসেন; বাবার নামা : আবদুল হাই; সাং : নোয়াদ্দা; ডাকঘর : আউটশাহী; থানা : টঙ্গীবাড়ী; জেলা : মুন্সীগঞ্জ। তার পাসপোর্ট নম্বও : ও-০৮২৯২৮৩। এমএ জামান’ বাবার নাম : বিল্লাল উদ্দিন, সাং : ধরি হামিদপুর; থানা ও জেলা : জামালপুর। তার পাসপোর্ট নম্বও : ও-০৯৯৫১২১। সূত্র জানায়, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ওই বছরের ২৮ আগস্ট স্বর্ণের বারগুলো আটক করে (ডিএম নং-০৯১৭০৩)। এ ঘটনায় ওই দিন বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা (নং-৬৯) হয়। জানা গেছে, ২০১০ সালের ৮ এপ্রিল তৎকালীন ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনার মাসুদ সাদিক এক বিচারাদেশে স্বর্ণের বারগুলো খালাস করার আদেশ দেন। যার স্মারক নং-২২৫/কাস/২০১০। পরে ওই বছরের ১১ আগস্ট সহকারী কাস্টমস কর্মকর্তা ওয়াজেদ আলীর স্ত্রী ল’ কনসালটেন্ট হাসমত আরা সোনালী ব্যাংক, ঢাকা কাস্টম হাউস শাখায় সোনার মূল্য বাবদ ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা দেন। যার স্ক্রল নং-০৮৩ এবং রসিদ নং-০০৫২০২৬। ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার পর ৩ চোরাচালানির ক্ষমতাপ্রাপ্ত ল’ কনসালটেন্ট হাসমত আরার নামে ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণের বার খালাস করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ, শুধু স্বর্ণ খালাস করেই ক্ষান্ত থাকেনি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, ২০০১ সালে আটক করা স্বর্ণের বারগুলো ২০১০ সালের বাজারমূল্য না ধরে ২০০১ সালের বাজারমূল্য ধরেই খালাস করার আদেশ দেয়। ফলে বর্তমান বাজার ধরে ৬ কোটি টাকার স্বর্ণ মাত্র ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকায় খালাস দেয় কাস্টমস বিভাগ। জানা গেছে, এর আগেও ঢাকা কাস্টমস গুদাম থেকে ১০ কেজি স্বর্ণ পাচারের অভিযোগে সহকারী কমিশনার সাালাউদ্দিন রিপন ও ইন্সপেক্টর মজিবর রহমান সরকারকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনারের এক বিচারাদেশে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চোরাচালানিদের কাছ থেকে আটক করা ৬ কোটি টাকা মূল্যের ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ যে মহিলা আইনজীবী সেজে নিয়ে এসেছেন তিনি কাস্টমসের সহকারী কমিশনার ওয়াজেদ আলীর স্ত্রী। এ ঘটনা স্বীকার করে সহকারী কমিশনার ওয়াজেদ আলী যুগান্তরকে বলেন, তার স্ত্রীকে ল’ কনসালটেন্ট করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমিশনারের অ্যাডজুডিকেশনে ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ খালাস করা হয়েছে। স্বর্ণ খালাস করে মালিককে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ওয়াজেদ আলী এলপিআরে (প্রাক অবসরকালীন ছুটি) আছেন। ওয়াজেদ আলীর দাবি অনুযায়ী যে তিনজনের সঙ্গে তার স্ত্রীর চুক্তি হয়েছে, তার মধ্যে একজন এমএ জামান। তার পাসপোর্ট নম্বর : ও-০৯৯৫১২১। তিনি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন, তার সঙ্গে এ বিষয়ে কারও কোনো চুক্তি হয়নি। তিনি কাউকে ল’ কনসালটেন্টও করেননি। কারও সঙ্গে নোটারি পাবলিকও করেননি। সব কাগজপত্র ভুয়া ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। তিনি এখন সরকারের কাছে তার স্বর্ণগুলো ফিরে পেতে চান। এ জন্য তিনি প্রয়োজনীয় ট্যাক্স-ভ্যাট দিতেও রাজি আছেন বলে জানান। অভিযোগ রয়েছে, ওয়াজেদ আলী কাস্টম হাউসের আইন বিভাগের দায়িত্বে থাকার সময়ে এ ধরনের বেশ কয়েকটি স্বর্ণের চালান খালাস করেছেন তার নিজের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে কনসালটেন্ট, আইনজীবী ও নোটারি পাবলিক ল’য়ার সাজিয়ে। ৬ কোটি টাকার স্বর্ণ খালাসের সময় তিনি কাগজে-কলমে ডিএম থাকার সময় তিন চোরাচালানির সঙ্গে নিজের স্ত্রীর একটি ভুয়া চুক্তি (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) করেন। সেখানে বলা হয়, তিন ব্যবসায়ী তাদের স্বর্ণগুলো ওই সহকারী কমিশনারের স্ত্রীকে গোডাউন থেকে উত্তোলনের জন্য নমিনি হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। পরে ওই চুক্তিটি একজন আইনজীবীর মাধ্যমে নোটারিও করা হয়। ওই আইনজীবীও সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কর্মকর্তার পরিবারের সদস্য। এরপর তারা মামলা দায়ের করে নিজেদের পক্ষে রায় নিয়ে স্বর্ণালংকারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নেন। জানা গেছে, ওই সময় ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার ছিলেন মাসুদ সাদিক। আর তার বিচারাদেশের ভিত্তিতেই সহকারী কমিশনার ওয়াজেদ আলী ও তার পরিবার স্বর্ণালংকারগুলো গায়েব করে দেয়। জানা গেছে, ওই স্বর্ণের প্রকৃত মালিক সম্প্রতি তাদের পণ্য খালাস দেয়ার জন্য ঢাকা কাস্টম হাউসে আবেদন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে বলা হয়েছে, ওই মালামালগুলো তাদের গোডাউনে নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড যাতে পরবর্তী সময়ে কেউ ধরতে না পারে সেজন্য কৌশলে কাস্টম হাউস থেকে সব কাগজপত্র গায়েব করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষিত ফাইলও গায়েব করে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। ঢাকা কাস্টম হাউস এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফাইল গায়েব হওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে সম্প্রতি বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংস্থাগুলো সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেছে। ফাইল গায়েবের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনারের নির্দেশে সম্প্রতি ফাইল খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে বলেও হাউস সূত্রে জানা গেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি চিঠির মাধ্যমে ঢাকা কাস্টম হাউসকে এ পর্যন্ত দায়েরকৃত মামলা, বিচারাধীন মামলা ও নিষ্পত্তি হওয়া মামলার তথ্য জানতে চেয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ও কাস্টমসের নিজস্ব গোডাউনে থাকা উদ্ধারকৃত স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণও জানতে চেয়েছে। সূত্র জানায়, স্ত্রীকে ল’ কনসালটেন্ট করে ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ লোপাট করার পর ওই কাস্টমস কর্মকর্তা ওয়াজেদ আলী তার ছেলেকে ল’ কনসালটেন্ট করে পরবর্তী কালে ২০ কোটি টাকার আরেকটি স্বর্ণের চালান খালাস করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। এতে তিনি সফলও হন। কিন্তু স্বর্ণের চালানটি খালাসের আগ মুহূর্তে ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনার জাকিয়া সুলতানা জানতে পেরে তা আটকে দেন। এ ব্যাপারে ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) মওদুদ দস্তগীর উচ্চ আদালতে এক মামলা (নং-১৪৮৩) দায়ের করেছেন বলেও জানা গেছে। মামলাটি বর্তমানে শুনানির অপেক্ষায় আছে। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে মামলার বাদী কাস্টমস কর্মকর্তা মওদুদ দস্তগীর কিছুদিন আগে জানান, সহকারী কমিশনার তার ছেলেকে ল’ কনসালটেন্ট করে ২০ কোটি টাকার স্বর্ণ খালাস করার প্রক্রিয়ার সময় কমিশনারের নির্দেশে উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়েছে। মামলা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি বলে তিনি জানান। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা কাস্টম হাউস গোডাউন থেকে এভাবে প্রতিনিয়ত মূল্যবান পণ্যসামগ্রী উধাও হয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনার সঙ্গে একজন অসৎ গোডাউন ইন্সপেক্টরের সরাসরি সম্পৃৃক্ততা থাকার অভিযোগ থাকলেও কর্তৃপক্ষ তার ব্যাপারে উদাসীন। জানা গেছে, এই হারুনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে কাস্টম হাউসে। এই সিন্ডকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এরা কাস্টম হাউস গোডাউনে থাকা কোটি কোটি টাকা মূল্যমানের বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নিয়ে সেখানে জাল মুদ্রা রেখে দিচ্ছে। এ ছাড়া গোডাউন থেকে আটক করা মূল্যবান মোবাইল সেট চুরি করে নিয়ে সেখানে কম দামি ও নিুমানের সেট রেখে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব ঘটনায় এই কর্মকর্তাকে একাধিকবার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও শক্তিশালী তদবিরের জোরে আবারও তিনি চাকরিতে ফিরে আসছেন এবং তার সিন্ডিকেটকে আরও শক্তিশালী করে তুলছেন।
Headlines from most popular newspapers of Bangladesh. বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনামগুলো এক নজরে দেখে নিন।
Monday, August 25, 2014
আটক সোনা লোপাট:যুগান্তর
িন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া অসৎ নোটারি পাবলিকের উকিল, স্ট্যাম্প বিক্রেতা, গোডাউনের সিকিউরিটি গার্ড, শুল্ক ও গোয়েন্দা বিচারালয়ের সদস্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মীও এই সিন্ডিকেটের হাতকে শক্তিশালী করছে। জানা গেছে, কাস্টসম কর্তৃক আটক এবং গোডাউনে রক্ষিত চোরাই সোনাসহ মূল্যবান পণ্য খালাসের বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে কাগজপত্রে বৈধ দেখানো হয়। কাস্টমস আদালত কাগজপত্রের ভিত্তিতে রায় দেন। সোনার মূল্য ব্যাংকে পরিশোধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা খালাস করে দিচ্ছে। অধিকাংশ সময় পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে থাকে ভুয়া জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে। স্বর্ণ লোপাট করার পর কৌশলে সিন্ডিকেটসংশ্লিষ্ট কাগজপত্রগুলোও গায়েব করে দেয়া হয়। এতে পুরো কার্যক্রমটি একসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। আর আটককৃত স্বর্ণের বেশিরভাগ মালিক চোরাকারবারি হওয়ায় তারাও একপর্যায়ে এসব পণ্যের দাবি ছেড়ে দেন। এতে কোনো সাড়া শব্দ ছাড়াই সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যায়। যুগান্তরের নিবিড় অনুসন্ধানে বিষয়গুলো ওঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনার জাকিয়া সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ খালাসের বিষয়টি তার আমলে হয়নি। আগের কমিশনারের বিচারাদেশে এ ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি শুনেছেন। তবে তার আমলে একজন কাস্টমস কর্মকর্তার ছেলেকে ল’ কনসালটেন্ট করে অবৈধ ও জালিয়াতির মাধ্যমে ২০ কোটি টাকার স্বর্ণ নেয়ার একটি গোপন প্রক্রিয়া হচ্ছিল। বিষয়টি জানার পর তিনি তাৎক্ষণিক স্বর্ণের চালানটি আটকে দেন এবং এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করেন। তিনি আরও বলেন, তার আমলে নিু আদালত থেকে রায় নিয়ে অসংখ্য চোরাকারবারি রাজস্ব ছাড়াই শত শত কোটি টাকার আটককৃত স্বর্ণ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এসব রায়ের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চ আদালতে মামলা করে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেন। এই অনিয়ম-দুর্নীতি প্রথম ধরা পড়ে জাকিয়া সুলতানা নামে ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনারের চোখে। এ নিয়ে চোরাকারবারিদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। সম্প্রতি ৫০ কেজি ওজনের খালাস দেয়া একটি চালানের প্রকৃত মালিকও ঢাকা কাস্টম হাউসে অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট চক্রটি মূলত ১০-১২ বছর কিংবা তারও অনেক আগে আটককৃত সোনাসহ, বৈদেশিক মুদ্রা বা মূল্যবান পণ্যসামগ্রী টার্গেট করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। যেসব পণ্যসামগ্রীর কোনো মালিকানা থাকে না সেগুলো তাদের মূল টার্গেট। এক্ষেত্রে চক্রটি ওই সময় যাদের নামে চোরাচালানের অভিযোগে মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল এবং মালামাল গোডাউনে জমা রাখার সময় যাদের নাম এজাহারে দেয়া হয়েছিল তাদের নামে ভুয়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নি তৈরি করে। এরপর ভুয়া নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ওই পাওয়ার অব অ্যাটর্নিকে সত্যায়নও করে নেয়। তারপর এসব কাগজপত্রের মাধ্যমে নিজেদের আটককৃত স্বর্ণালংকারের মালিকানা দাবি করে কাস্টমস বিচারালয়ে মামলা দায়ের করে। অভিযোগ, এই চক্রের সঙ্গে কাস্টমসের টপ টু বটম অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকেন। বিনিময়ে তারাও মোটা অংকের টাকার ভাগ পান। যেভাবে ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ খালাস হয় : জানা গেছে, ২০০১ সালে তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক (বর্তমানে হযরত শাহজালাল) বিমানবন্দর দিয়ে পাচারের সময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ৩০০ তোলা ওজনের সোনার বার আটক করে। এ সময় জড়িত ৩ পাচারকারী পালিয়ে যায়। তারা হল- মোঃ সামছুল শেখ; বাবার নাম : আলি হোসেন; সাং : নোয়াদ্দা; ডাকঘর : আউটশাহী; থানা : টঙ্গীবাড়ী; জেলা : মুন্সীগঞ্জ। তার পাসপোর্ট নম্বর : কিউ-০৯৬৫৭০৯। আলমগীর হোসেন; বাবার নামা : আবদুল হাই; সাং : নোয়াদ্দা; ডাকঘর : আউটশাহী; থানা : টঙ্গীবাড়ী; জেলা : মুন্সীগঞ্জ। তার পাসপোর্ট নম্বও : ও-০৮২৯২৮৩। এমএ জামান’ বাবার নাম : বিল্লাল উদ্দিন, সাং : ধরি হামিদপুর; থানা ও জেলা : জামালপুর। তার পাসপোর্ট নম্বও : ও-০৯৯৫১২১। সূত্র জানায়, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ওই বছরের ২৮ আগস্ট স্বর্ণের বারগুলো আটক করে (ডিএম নং-০৯১৭০৩)। এ ঘটনায় ওই দিন বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা (নং-৬৯) হয়। জানা গেছে, ২০১০ সালের ৮ এপ্রিল তৎকালীন ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনার মাসুদ সাদিক এক বিচারাদেশে স্বর্ণের বারগুলো খালাস করার আদেশ দেন। যার স্মারক নং-২২৫/কাস/২০১০। পরে ওই বছরের ১১ আগস্ট সহকারী কাস্টমস কর্মকর্তা ওয়াজেদ আলীর স্ত্রী ল’ কনসালটেন্ট হাসমত আরা সোনালী ব্যাংক, ঢাকা কাস্টম হাউস শাখায় সোনার মূল্য বাবদ ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা দেন। যার স্ক্রল নং-০৮৩ এবং রসিদ নং-০০৫২০২৬। ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার পর ৩ চোরাচালানির ক্ষমতাপ্রাপ্ত ল’ কনসালটেন্ট হাসমত আরার নামে ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণের বার খালাস করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ, শুধু স্বর্ণ খালাস করেই ক্ষান্ত থাকেনি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, ২০০১ সালে আটক করা স্বর্ণের বারগুলো ২০১০ সালের বাজারমূল্য না ধরে ২০০১ সালের বাজারমূল্য ধরেই খালাস করার আদেশ দেয়। ফলে বর্তমান বাজার ধরে ৬ কোটি টাকার স্বর্ণ মাত্র ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকায় খালাস দেয় কাস্টমস বিভাগ। জানা গেছে, এর আগেও ঢাকা কাস্টমস গুদাম থেকে ১০ কেজি স্বর্ণ পাচারের অভিযোগে সহকারী কমিশনার সাালাউদ্দিন রিপন ও ইন্সপেক্টর মজিবর রহমান সরকারকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনারের এক বিচারাদেশে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চোরাচালানিদের কাছ থেকে আটক করা ৬ কোটি টাকা মূল্যের ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ যে মহিলা আইনজীবী সেজে নিয়ে এসেছেন তিনি কাস্টমসের সহকারী কমিশনার ওয়াজেদ আলীর স্ত্রী। এ ঘটনা স্বীকার করে সহকারী কমিশনার ওয়াজেদ আলী যুগান্তরকে বলেন, তার স্ত্রীকে ল’ কনসালটেন্ট করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমিশনারের অ্যাডজুডিকেশনে ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ খালাস করা হয়েছে। স্বর্ণ খালাস করে মালিককে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ওয়াজেদ আলী এলপিআরে (প্রাক অবসরকালীন ছুটি) আছেন। ওয়াজেদ আলীর দাবি অনুযায়ী যে তিনজনের সঙ্গে তার স্ত্রীর চুক্তি হয়েছে, তার মধ্যে একজন এমএ জামান। তার পাসপোর্ট নম্বর : ও-০৯৯৫১২১। তিনি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন, তার সঙ্গে এ বিষয়ে কারও কোনো চুক্তি হয়নি। তিনি কাউকে ল’ কনসালটেন্টও করেননি। কারও সঙ্গে নোটারি পাবলিকও করেননি। সব কাগজপত্র ভুয়া ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। তিনি এখন সরকারের কাছে তার স্বর্ণগুলো ফিরে পেতে চান। এ জন্য তিনি প্রয়োজনীয় ট্যাক্স-ভ্যাট দিতেও রাজি আছেন বলে জানান। অভিযোগ রয়েছে, ওয়াজেদ আলী কাস্টম হাউসের আইন বিভাগের দায়িত্বে থাকার সময়ে এ ধরনের বেশ কয়েকটি স্বর্ণের চালান খালাস করেছেন তার নিজের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে কনসালটেন্ট, আইনজীবী ও নোটারি পাবলিক ল’য়ার সাজিয়ে। ৬ কোটি টাকার স্বর্ণ খালাসের সময় তিনি কাগজে-কলমে ডিএম থাকার সময় তিন চোরাচালানির সঙ্গে নিজের স্ত্রীর একটি ভুয়া চুক্তি (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) করেন। সেখানে বলা হয়, তিন ব্যবসায়ী তাদের স্বর্ণগুলো ওই সহকারী কমিশনারের স্ত্রীকে গোডাউন থেকে উত্তোলনের জন্য নমিনি হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। পরে ওই চুক্তিটি একজন আইনজীবীর মাধ্যমে নোটারিও করা হয়। ওই আইনজীবীও সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কর্মকর্তার পরিবারের সদস্য। এরপর তারা মামলা দায়ের করে নিজেদের পক্ষে রায় নিয়ে স্বর্ণালংকারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নেন। জানা গেছে, ওই সময় ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার ছিলেন মাসুদ সাদিক। আর তার বিচারাদেশের ভিত্তিতেই সহকারী কমিশনার ওয়াজেদ আলী ও তার পরিবার স্বর্ণালংকারগুলো গায়েব করে দেয়। জানা গেছে, ওই স্বর্ণের প্রকৃত মালিক সম্প্রতি তাদের পণ্য খালাস দেয়ার জন্য ঢাকা কাস্টম হাউসে আবেদন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে বলা হয়েছে, ওই মালামালগুলো তাদের গোডাউনে নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড যাতে পরবর্তী সময়ে কেউ ধরতে না পারে সেজন্য কৌশলে কাস্টম হাউস থেকে সব কাগজপত্র গায়েব করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষিত ফাইলও গায়েব করে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। ঢাকা কাস্টম হাউস এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফাইল গায়েব হওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে সম্প্রতি বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংস্থাগুলো সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেছে। ফাইল গায়েবের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনারের নির্দেশে সম্প্রতি ফাইল খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে বলেও হাউস সূত্রে জানা গেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি চিঠির মাধ্যমে ঢাকা কাস্টম হাউসকে এ পর্যন্ত দায়েরকৃত মামলা, বিচারাধীন মামলা ও নিষ্পত্তি হওয়া মামলার তথ্য জানতে চেয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ও কাস্টমসের নিজস্ব গোডাউনে থাকা উদ্ধারকৃত স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণও জানতে চেয়েছে। সূত্র জানায়, স্ত্রীকে ল’ কনসালটেন্ট করে ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ লোপাট করার পর ওই কাস্টমস কর্মকর্তা ওয়াজেদ আলী তার ছেলেকে ল’ কনসালটেন্ট করে পরবর্তী কালে ২০ কোটি টাকার আরেকটি স্বর্ণের চালান খালাস করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। এতে তিনি সফলও হন। কিন্তু স্বর্ণের চালানটি খালাসের আগ মুহূর্তে ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনার জাকিয়া সুলতানা জানতে পেরে তা আটকে দেন। এ ব্যাপারে ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) মওদুদ দস্তগীর উচ্চ আদালতে এক মামলা (নং-১৪৮৩) দায়ের করেছেন বলেও জানা গেছে। মামলাটি বর্তমানে শুনানির অপেক্ষায় আছে। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে মামলার বাদী কাস্টমস কর্মকর্তা মওদুদ দস্তগীর কিছুদিন আগে জানান, সহকারী কমিশনার তার ছেলেকে ল’ কনসালটেন্ট করে ২০ কোটি টাকার স্বর্ণ খালাস করার প্রক্রিয়ার সময় কমিশনারের নির্দেশে উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়েছে। মামলা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি বলে তিনি জানান। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা কাস্টম হাউস গোডাউন থেকে এভাবে প্রতিনিয়ত মূল্যবান পণ্যসামগ্রী উধাও হয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনার সঙ্গে একজন অসৎ গোডাউন ইন্সপেক্টরের সরাসরি সম্পৃৃক্ততা থাকার অভিযোগ থাকলেও কর্তৃপক্ষ তার ব্যাপারে উদাসীন। জানা গেছে, এই হারুনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে কাস্টম হাউসে। এই সিন্ডকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এরা কাস্টম হাউস গোডাউনে থাকা কোটি কোটি টাকা মূল্যমানের বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নিয়ে সেখানে জাল মুদ্রা রেখে দিচ্ছে। এ ছাড়া গোডাউন থেকে আটক করা মূল্যবান মোবাইল সেট চুরি করে নিয়ে সেখানে কম দামি ও নিুমানের সেট রেখে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব ঘটনায় এই কর্মকর্তাকে একাধিকবার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও শক্তিশালী তদবিরের জোরে আবারও তিনি চাকরিতে ফিরে আসছেন এবং তার সিন্ডিকেটকে আরও শক্তিশালী করে তুলছেন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment