পদ্মায় এমএল পিনাক-৬ লঞ্চডুবির ঘটনায় দায়ীদের রক্ষার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। অতীতের মতো বিষয়টি ধামাচাপার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে মন্ত্রণালয় গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটিতে নৌপ্রকৌশলী কিংবা জাহাজ জরিপকারক না থাকায় সংশয়ের ডালপালা মেলছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে অভিযুক্ত কর্তারা কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে ঘটনা ধামাচাপা দিতে। গত ৪ আগস্ট কাওরাকান্দি-মাওয়া নৌরুটে পিনাক-৬ লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে। ফিটনেসব
িহীন ও ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করার কারণেই মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এতে ৪৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ৬১ জন। জানা গেছে, নৌযানটির নকশা অনুমোদিত ছিল না। ছিল না স্টাবিলিটি বুকলেটও। কিন্তু তারপরও লঞ্চটিকে দেয়া হয়েছিল ডক সনদ ও ভুয়া জরিপ সনদ। লঞ্চটির সর্বশেষ জরিপ করেছেন সদরঘাট বন্দরের প্রকৌশলী ও জরিপকারক মির্জা সাইফুর রহমান। কোনো প্রকার উপযুক্ততা যাচাই ও সরেজমিন পরিদর্শন ছাড়াই তিনি ঘুষের বিনিময়ে সার্ভে সনদ প্রদান করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জরিপকারক মির্জা সাইফুরকে দুই লাখ টাকা দিয়ে সনদ সংগ্রহ করা হয় বলে গ্রেফতারকৃত লঞ্চ মালিক আবু বকর সিদ্দিক ও তার ছেলে ওমর ফারুক লিমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে জানা যায়। কিন্তু এরপরও মির্জা সাইফুরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। গত ১৮ আগস্ট তাকে ওএসডি করা হলেও সেটি আসলে আইওয়াশ ছিল বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। এ দিকে লঞ্চডুবির ঘটনায় নৌসচিব ও বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানসহ ১০ কর্মকর্তার অপসারণ চেয়ে গত ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আশীষ কুমার দে এবং বাংলাদেশ যাত্রী অধিকার সংরণ পরিষদের সভাপতি তুষার রেহমানের পক্ষে আইনজীবী হারুন অর রশীদ হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দায়ের করেন। এর আগে রিট আবেদনকারীরা গত ১৩ আগস্ট নৌসচিবসহ ১০ জনের কাছে আইনি নোটিশ পাঠায়। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফিটনেসবিহীন চলাচলের অনুমতি দেয়াই পিনাক-৬ লঞ্চডুবির অন্যতম কারণ। লঞ্চটির স্টাবিলিটি বুকলেট ছিল না। আর বুকলেট ছাড়া সার্ভে সনদ প্রদানের সুযোগ নেই। এ ছাড়া ডুবে যাওয়া নৌযানের অনুমোদিত নকশাও নেই। সার্ভে সনদে নৌযানটির দৈর্ঘ দেখানো হয়েছে ১৯ দশমিক ৫ মিটার। বাস্তবে লঞ্চটি ২০ মিটারের উপরে লম্বা। বিধি অনুযায়ী ২০ মিটার বা তার বেশি লম্বা নৌযানের ক্ষেত্রে নকশা অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্য দিকে সার্ভে সনদে মির্জা সাইফুর রহমান নৌযানটির ১১টি ত্রুটি রয়েছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। অথচ ওই সব ত্রুটি সংশোধন ব্যতিরেকেই তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এটিকে দফায় দফায় চলাচলের অনুমতি দেন। এখন দুর্ঘটনার পর তাকে রক্ষায় মরিয়া সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ একটি চক্র। চক্রটির অপতৎপরতার মুখেই মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটিতে নৌপ্রকৌশলী কিংবা জাহাজ জরিপকারক রাখা হয়নি। কমিটির সদস্য চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন কে এম জসিমউদ্দীন সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মির্জা সাইফুরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ফখরুল ইসলামের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে নানা গুঞ্জন। অভিযোগ রয়েছে সরেজমিন জরিপ না করেই মির্জা সাইফুর এভাবে উৎকোচের বিনিময়ে অসংখ্য নৌযানের জরিপ সনদ দিয়েছেন। তার হাত দিয়ে পুরনো অনেক লঞ্চ সাময়িক মেরামতের পর নতুন হিসেবে সনদ পেয়েছে। এর আগে গত মে মাসে মুন্সীগঞ্জে এম ভি মিরাজ-৪ নামে একটি লঞ্চ ডুবে ৫৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। নৌবাণিজ্য অধিদফতরের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক এ এফ এম সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গত ২৪ জুন দাখিলকৃত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য সাইফুর রহমানকে দায়ী করে। কিন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে অর্থবহ সম্পর্ক থাকায় তার বিরুদ্ধে আজো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ আছে। একই কায়দায় তিনি এবারো পার পেয়ে যেতে পারেন বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। মির্জা সাইফুরের বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে জরিপ সনদ প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার মির্জা সাইফুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার অপর জাহাজ জরিপকারক ড. এ এস এম নাজমুল হকের মতামত নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। এ ছাড়াও এ ঘটনায় বিভিন্ন মহল থেকে আরো চার কর্মকর্তাকে সরাসরি দায়ী করা হয়। তারা হলেন : মাওয়া অঞ্চলে নৌযান চলাচল তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মো: মুঈনউদ্দিন জুলফিকার, একই সংস্থার পরিদর্শক শফিক আইয়ুব, বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এবং একই সংস্থার উপপরিচালক ও মাওয়া নদীবন্দর কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহমেদ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিযুক্তরা কোটি কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে। এবারেও তারা বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা শুরু করেছে বলে অভিযোগ মিলেছে।
No comments:
Post a Comment