ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেঘনা নদীর ওপর শত বছরের স্থায়িত্ব ধরে নির্মিত মেঘনা সেতু আবারও চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট সেতুর নিচ থেকে দেদার বালু উত্তোলন করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যোগাযোগমন্ত্রীর তৎপরতার পর মামলা হয়েছে। সেতুর ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন বন্ধে টহল জোরদার করা হচ্ছে। ১০০ বছর স্থায়িত্ব ধরে নির্মাণের ১৩ বছরের
মাথায়ই ঝুঁকিতে পড়ে সেতুটি। এ অবস্থায় সংস্কার শেষে গত বছর সেতুটি ঝুঁকিমুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু অসাধু বালু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতার কারণে আবারও ঝুঁকিতে পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই সেতু। প্রশাসন তৎপর হয়েছে ঠিকই, তবে ইতিমধ্যে অনেকটাই ক্ষতি হয়ে গেছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, সেতুর চারটি পিলারের নিচে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমেই সরে যাচ্ছে মাটি। এ কারণে ভূমিকম্প হলে বা অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যান চলাচল বেড়ে গেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, পিলারের নিচ থেকে বালু উত্তোলন করা হলে সেতুর শক্তি কমে যায়। এ অবস্থায় মেঘনা সেতুর ওপর দিয়ে অতিরিক্ত ভারবাহী যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। মেঘনা নদীতে সেতুর নিচ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে চলছে রমরমা ব্যবসা।ছবি : কালের কণ্ঠ সওজ অধিদপ্তর সূত্র মতে ও সরেজমিনে দেখা গেছে, সেতুর ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর পিলারের পাশের মাটি সরে গেছে। এর বড় কারণ সেতুর নিচে মেঘনা থেকে বেআইনিভাবে অবাধে বালু উত্তোলন। ছয় নম্বর পিলারের পাশে সৃষ্টি হয়েছে ২০ থেকে ২২ ফুট গভীর গর্ত। ৭, ৮ ও ৯ নম্বর পিলারের পাশে সৃষ্ট গর্তের গভীরতা ৭ থেকে ১২ ফুট। নারায়ণগঞ্জ সড়ক ভবনের নির্বাহী প্রকৌশলী রসনিয়া ফাতিমা কালের কণ্ঠকে বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে মেঘনা সেতুর ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর পিলারের পাশ থেকে মাটি সরে গেছে। তিনি জানান, ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গোমতী সেতুর পাশাপাশি মেঘনা সেতুও মেরামত করা হয়েছিল। সেতু দুটির সম্প্রসারণশীল সংযোগ ও হিঞ্জ বিয়ারিং স্থাপন করে গত বছর এগুলো ঝুঁকিমুক্ত করা হয়েছিল। মেরামতের পর সেতু দুটি ১০ বছরের জন্য নিরাপদ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু বালু তোলা বন্ধ না হওয়ায় আবারও গর্ত তৈরি হচ্ছে পিলারগুলোর পাশে। অনুসন্ধানে জানা যায়, চর হোগলা, ছোট দেওভোগ, ডেঙ্গুরকান্দিসহ ১২টি বালুমহাল রয়েছে। এর মধ্যে রমজান সোনাউল্লা মৌজা-৬ নামে একটি বালুমহালের ইজারা নিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে মেসার্স মাইক্রো ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে। প্রতিষ্ঠানটি ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা আবু নাইম ইকবালের মালিকানাধীন। স্থানীয় বারদী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জহিরুল হক, ইউপি সদস্য কামাল হোসেন, উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান মাসুম, জাতীয় পার্টির নেতা শাহীন মিয়াসহ ক্ষমতাসীন দলের শতাধিক নেতা-কর্মী রয়েছে এই সিন্ডিকেটে। কয়েক দিন আগে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, এই সিন্ডিকেট ইজারা নেওয়া অংশ থেকে বালু উত্তোলন না করে রাতের আঁধারে সেতুর নিচ থেকে শ্রমিক দিয়ে বালু তুলে নিচ্ছে। অথচ মেঘনা সেতুর পার্শ্ববর্তী তিন কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এদিকে মেঘনা সেতুর পূর্ব পাশে বিআইডাব্লিউটিএর জায়গা জোরপূর্বক দখল করে স্থানীয় যুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিন প্রধান, শামসুজ্জামান শামসু, তোফায়েল আহাম্মেদ, সামসু মিয়া, কলু মিয়া, শরাফত উল্লাহ, আরিফ হোসেনসহ আরো কয়েকজন বালুর ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। বিআইডাব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের উপপরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে থানায় লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। মন্ত্রীর নির্দেশে মামলা : যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত শুক্রবার মেঘনা সেতু পরিদর্শন করেন। তাঁর নির্দেশে ওই দিনই মাহাবুব মিয়া, জসিমউদ্দিন, সুমন মিয়া, আরিফ প্রধান, যুবলীগকর্মী তোফায়েল আহাম্মেদ স্বপন, ইসমাইল হোসেন, বাবুল হোসেন ও বাবুল মিয়া নামের বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন সোনারগাঁ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জালাল উদ্দিন। বালুভর্তি একটি বাল্কহেডসহ চারজনকে আটকও করে পুলিশ। টহল জোরদার : গত রবিবার মেঘনা সেতু এলাকা পরিদর্শনে যান নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, মেঘনা সেতুর দুপাশে ১৪ কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে যাতে কেউ বালু উত্তোলন না করতে পারে সে জন্য নিয়মিত টহলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিজাউল হক জানান, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ (পুলিশের) বরাবর গোপন প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। বালু উত্তোলনকারীরা ফসলি জমি ও নদীর তীর থেকেও বালু তুলে নিচ্ছে। এ কারণে হুমকির মুখে পড়েছে নুনেরটেক, ভাটিবন্দরসহ ১০টি গ্রাম। এ অবস্থায় বালুমহালের ইজারা বাতিলের জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে কতিপয় ব্যক্তি বালু উত্তোলন করছে। এ কারণে মেঘনা সেতু আবারও হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সোনারগাঁ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান বলেন, রাতের আঁধারে বালু উত্তোলনের নিয়ম না থাকলেও বালু ব্যবসায়ীরা নিয়মনীতি উপেক্ষা করে মেঘনা সেতু এলাকায় মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু নাসের ভুঁইয়া জানান, রাতের আঁধারে যাতে মেঘনা সেতুর আশপাশের এলাকা থেকে কেউ বালু উত্তোলন করতে না পারে, সে জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেঘনা নদীর ওপর ১৯৯১ সালে সেতুটি নির্মাণ করা হয় জাপান সরকারের আর্থিক সহায়তায়। সেতুতে ১২টি পিলার ও ১৩টি সম্প্রসারণশীল সংযোগ রয়েছে। এটির স্থায়িত্ব ধরা হয় নির্মাণের পর থেকে ১০০ বছর। কিন্তু পিলারগুলোর পাশ থেকে মাটি সরে যাওয়া শুরু হলে ১৩ বছরেই সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মেঘনা ও গোমতী সেতু কয়েক দফায় মেরামত শেষে ঝুঁকিমুক্ত ঘোষণা করা হয় গত বছরের মার্চ মাসে। ওই সংস্কারকাজের পর আবারও সেতুর নিচ ও আশপাশ থেকে অবাধে বালু উত্তোলন শুরু হয়। ফলে বর্তমানের এই শঙ্কাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
No comments:
Post a Comment