Thursday, October 23, 2014

লুটপাট ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা পিডিবির:যুগান্তর

টঙ্গীতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ভাণ্ডার থেকে ৩০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের বৈদ্যুতিক তার লুটের ঘটনায় নতুন নাটকের জন্ম দিয়েছে তদন্ত কমিটি। শুধু ভাণ্ডার থেকে কিছু কাগজপত্র নিয়ে ঘরে বসে তড়িঘড়ি করে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। আর এতে বলা হয়েছে, তারগুলো বাইরে লুটপাট হয়েছে। ভাণ্ডারের ভেতরে লুটপাটের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। কমিটির পাঁচ সদস্যই রিপোর্টে এ কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও নথিপত্র বলছে, সব মাল ট
ঙ্গীর পিডিবির ভাণ্ডারেই রক্ষিত ছিল। সংশ্লিষ্ট অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ভাণ্ডার কর্তৃপক্ষই নয়, পিডিবির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বেশিরভাগ শীর্ষ কর্মকর্তাই লুটপাটের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তারা তড়িঘড়ি করে রিপোর্ট দুটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে পিডিবিকে দায়মুক্তি দিতে চাচ্ছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লুটপাটের কারণে পিডিবি কিংবা সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, সংশ্লিষ্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে পুরো টাকা আদায় করা সম্ভব হবে। যদিও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ইতিমধ্যে পিডিবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, তারা কোনো টাকা দেবে না। কারণ তাদের নিজস্ব তদন্ত অনুযায়ী, তার লুট হয়েছে পিডিবির ভাণ্ডার থেকেই। গত ১৫ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে ‘পিডিবির ভাণ্ডার লুট’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। লুটের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় থেকে দ্রুত এর সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পিডিবিকে চিঠি দেয়া হয়। একই সঙ্গে যেকোনো মূল্যে লুট হওয়া মালামাল উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পিডিবির অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করতে বলা হয়। চিঠি পেয়েই পিডিবির চেয়ারম্যান আবদুহু রুহুল্লাহ দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। একটি কমিটির আহ্বায়ক করা হয় ভাণ্ডারের পরিচালক প্রকৌশলী এজেএম লুৎফে রাব্বানীকে। যিনি লুটের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। আর ওই কমিটির সদস্যসচিব করা হয় আরেক অভিযুক্ত ভাণ্ডারের উপপরিচালক পান্না কুমার ঘোষকে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেখানে এ ধরনের একটি ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে এই দুই কর্মকর্তাসহ যারা মালামাল গ্রহণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের সাময়িক বহিষ্কার করা উচিত ছিল, সেখানে তাদের কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব করা হয়েছে। তাই স্বভাবতই তারা পুরো লুটপাটের ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো তদন্ত রিপোর্টের সঙ্গে একটি চিঠিও সংযুক্ত করে দেয়া হয়। ওই চিঠিটি ভিয়েতনামের তার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এলএস ভিনা ক্যাবল অ্যান্ড সিস্টেমকে দেয়া হয়েছিল। গত সপ্তাহে এলএস ভিনা ক্যাবলকে দেয়া ওই চিঠিতে (পিডিবি ম্যামো নং-৩৫১, তারিখ ১২/১০/১৪) বলা হয়েছে, তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের সরবরাহকারী ক্যাবলগুলো পিডিবির ভাণ্ডারের বাইরে চুরি হয়েছে। এ জন্য পিডিবির কোনো দায় নেই। ইতিমধ্যে লোকাল এজেন্টকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টি জানিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। কাজেই অবিলম্বে লুট হওয়া মালামাল ফেরত না দিলে পিডিবি বাধ্য হবে পারফরমেন্স গ্যারান্টি ও সিকিউরিটি গ্যারান্টির টাকা থেকে এই ক্ষতিপূরণ আদায় করবে। এই চিঠির উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। এলএস ভিনা ক্যাবলের একটি সূত্রে জানা গেছে, তারা পিডিবির ওই চিঠির উত্তর দেবে না। প্রয়োজনে তারা এর সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে পিডিবির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করবে। তদন্ত রিপোর্টে যা আছে : ভাণ্ডারের বাইরে লুটের কারণ হিসেবে তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তার বোঝাই করে ছেড়ে আসা ছয়টি ট্রাক ৩-৪ দিন পর ঢাকায় পৌঁছেছে। একটি ট্রাক এসেছে সাত দিন পর। এ ছাড়া কোনো ধরনের চালান ছাড়া ভাণ্ডার কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে তারবোঝাই ছয়টি ট্রাক ভাণ্ডারে ঢুকিয়েছে। কাগজপত্রে যেসব ট্রাকের নম্বর উল্লেখ ছিল ট্রাকগুলো সেই নম্বরের ছিল না। তদন্ত কমিটি এসব আলামতের কথা উল্লেখ করে বলেছে, দেরিতে আসা ও চালান ছাড়া আসা ১২টি ট্রাক থেকেই তারগুলো বাইরে চুরি হয়েছে। নাম প্রকাশ না করে পিডিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, তদন্ত কমিটির সদস্যরা একতরফাভাবে পিডিবির পক্ষে রিপোর্ট তৈরি করলেও চালান ছাড়া কীভাবে ভাণ্ডারে ট্রাক প্রবেশ কেেরছে এবং কম মালামাল থাকার পরও কেন ভাণ্ডার কর্তৃপক্ষ সেগুলো সঠিক পাওয়া গেছে উল্লেখ করে গ্রহণ করেছে তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। এমনকি এ জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেনি রিপোর্টে। ওই কর্মকর্তা বলেন, পিডিবির ভাণ্ডারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের খুঁটির জোর খুবই শক্তিশালী। তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়নি। দায়সারা রিপোর্ট দিয়ে পুরো লুটের ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত সপ্তাহের সোমবার দিনভর দুই তদন্ত কমিটির সদস্যরা আবদুল গনি রোডে বিদ্যুৎ ভবনে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তৈরি করা রিপোর্ট নিয়ে কমিটির একাধিক সদস্য দ্বিমত পোষণ করলেও শীর্ষ মহলের চাপে তড়িঘড়ি করে তা জমা দেয়া হয়। কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী এজেএম লুৎফে রাব্বানী যুগান্তরকে বলেন, প্রাথমিক রিপোর্ট জমা দেয়া হয়েছে। রিপোর্টে তারা মালামালগুলো পিডিবির ভাণ্ডারে নয়, বাইরে লুটপাট হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। বাইরে লুটপাটের বিষয়ে তাদের হাতে কোনো ধরনের প্রমাণ আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে কিছু আলামতের ভিত্তিতে অনুমান করে রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। চালানবিহীন এবং কম মাল বোঝাই ট্রাক ভেতরে কীভাবে প্রবেশ করল। আর যারা মালামালগুলো সঠিকভাবে পাওয়া গেছে মর্মে চালানপত্র রিসিভ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছেন কিনা- জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেনি। এ ব্যাপারে ভাণ্ডারের উপপরিচালক পান্না কুমার ঘোষ বলেন, আমার ধারণা, যত বেশি বলা হচ্ছে, তত বেশি মালামাল চুরি হয়নি। কারণ এখনও পুরো মালামাল পরীক্ষাই করা হয়নি। যা বলা হচ্ছে সবই অনুমানের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে। কম মাল বোঝাই ও চালানবিহীন ট্রাক ভাণ্ডারে প্রবেশের অনুমতি দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো মালামাল রিসিভ করিনি।’ তাহলে পিডিবির ভাণ্ডারে এই মালামাল কীভাবে প্রবেশ করল- জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে প্রতিবেদককে তার অফিসে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। ভিয়েতনামের কোম্পানির বক্তব্য : তার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভিয়েতনামের এলএস ভিনা ক্যাবল অ্যান্ড সিস্টেমসের কর্মকর্তা দো থান তো জানান, মালগুলো জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে তারা সরবরাহ করেছেন। এসব পণ্য আন্তর্জাতিক প্যাকেজিং এবং জাইকার প্রতিনিধি ও পিডিবির পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি ড্রাম গুণগত মানের পরীক্ষা শেষে এবং চুক্তি অনুযায়ী প্যাকেজিং শেষে জাহাজিকরণ করা হয়েছে। এ ধরনের প্রজেক্টে এক ইঞ্চি মালও কম দেয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, মালামালগুলো প্রস্তুতের পর থেকে গ্রহণ পর্যন্ত পিডিবি রহস্যজনক কারণে নানাভাবে সময়ক্ষেপণ করেছে। উৎপাদিত মালামালের গুণগত মান নিশ্চিতকরণে প্রাক জাহাজিকরণ পরীক্ষা ও পরিদর্শনের জন্য এলএস ভিনা ক্যাবল গত জানুয়ারি থেকে ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক বরাবর চার দফা চিঠি দেয়। কিন্তু পিডিবি এসব চিঠির তোয়াক্কাই করেনি। একইভাবে গত ২ জুলাই মালামালগুলো টঙ্গীর কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারে পৌঁছার পরও পোস্টল্যান্ডিং পরিদর্শনে আবার রহস্যজনক কারণে কালক্ষেপণ করতে থাকে পিডিবি। তিনি বলেন, ডেলিভারি চালানসমূহে পিডিবির ভাণ্ডার কর্মকর্তা (গ্রহণ), ভাণ্ডার কর্মকর্তা (ইস্যু), স্টোরকিপার-সি এবং উপপরিচালক (স্টোরস), কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারের স্বাক্ষর রয়েছে। তারা প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে মালামালের স্যাম্পল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওজন ঠিক থাকার পরই চালানে স্বাক্ষর করেছেন। এরপরই মালামাল বুঝে নিয়ে ভাণ্ডারে রেখেছেন। পিডিবি না চাইলে কারও পক্ষে সম্ভব হবে না ভাণ্ডারে কোনো ধরনের মালামাল প্রবেশ করানো। তিনি আরও বলেন, পোস্টল্যান্ডেং পরিদর্শনের জন্য গত ২ জুলাই প্রকল্প পরিচালকের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। ৫ দিন পর ৭ জুলাই এ জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তারপরও রহস্যজনক কারণে ৩৮ দিন পর পরিদর্শন কমিটি গত ১০ আগস্ট কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারে আসে। ৩৮ দিন পিডিবির ভাণ্ডারে মালামালগুলো কীভাবে ছিল সেটা সরবরাহকারীর পক্ষে দেখারও কোনো সুযোগ নেই। ট্রাকগুলো পরে আসা প্রসঙ্গে স্থানীয় এজেন্টের এক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রাম থেকে মঙ্গলবারে ছেড়ে আসা ৫টি ট্রাক ঢাকায় টঙ্গীস্থ ভাণ্ডারে পৌঁছেছে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। কিন্তু সরকারি ছুটি থাকায় ওই ট্রাক ভেতরে প্রবেশ করেছে পরের সপ্তাহে রোববার সকালে। কাজেই ৫টি ট্রাক চার দিন পরে ভাণ্ডারে প্রবেশ অন্যায় হয়নি। তবে একটি ট্রাক আসার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়ায় অন্য একটি ট্রাক দিয়ে মালামালগুলো ভাণ্ডারে পৌঁছানো হয়েছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ২২ ডিসেম্বর জাপান সরকারের ঋণ সহায়তায় জাইকা, সেন্ট্রাল জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন প্রজেক্ট (বিউবো) এবং এলএস ভিনা ক্যাবল অ্যান্ড সিস্টেমের সঙ্গে ৪ হাজার ২১০.২৭ কিলোমিটার এসিআরএস ডগ কন্ডাকটর এবং ৪ হাজার ৭৪.৮০ কিলোমিটার গাই ওয়্যার সরবরাহের লক্ষ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু গত ১২ আগস্ট পিডিবির একটি টিম সরেজমিনে দেখে অধিকাংশ ড্রামের মধ্যে তার নেই। ড্রামগুলো ভাঙার পর ড্রামের গায়ে তার থাকার চিহ্ন দেখা গেলেও বাস্তবে সেখানে তার ছিল না।  

No comments:

Post a Comment