চাঁদপাই বনফাঁড়ি থেকে পশুর নদ দিয়ে ট্রলারে আধা ঘণ্টা যেতেই মৃগমারী খাল। খালের মাথায় জাল টানানো। বনের ভেতরে যাতে তেল ঢুকতে না পারে সে জন্যই জেলেরা জালগুলো টানিয়েছেন। কিন্তু দুবারের জোয়ার ভাটার সঙ্গে ভেসে আসা তেলের আস্তরণ লেগে সেই জাল ছিঁড়ে গেছে। খালের মাথায় নৌকা নিয়ে জাল দিয়ে কাঁকড়া ধরতে দেখা গেল ফারুক খান নামের একজন বনজীবীকে। কাঁকড়া তুলে বনের মধ্যে রেখে তা পানি দিয়ে ধুইলেন তিনি। কী করছে
ন, জানতে চাইলে একঝলক তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে তিনি বললেন, ‘তেল দি বন ভাসায়ে দেছে। এখন কাঁকড়াগুলোও মরতি বসিছে। সব কাঁকড়ার গায়েই তেল লেগি আছে। এরাম আর কয় দিন চললি বনের সব কাঁকড়া মইরে যাবেনে। কাঁকড়া মরলি আমরা ধরব কী, বেচপো কী, আর খাব কী?’ ফারুক খানের সঙ্গে কথা শেষ করে ট্রলার এগোল কুমিরের চরের দিকে। ভাটার সময় পানি নেমে গেলে চরের মধ্যে ছয় থেকে সাতটি কুমির এমনিতেই শুয়ে থাকতে দেখা যেত জানিয়ে ট্রলারের চালক আলম শেখ বললেন, ‘গেল তিন দিন এই চরে কোনো কুমির দেখিনি। সব পলায়ছে।’ তেল ছড়ানো বন্ধে উদ্যোগ নেই সুন্দরবন গবেষক ও বিশ্বব্যাংকের পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা ইশতিয়াক সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, কাঁকড়ার শরীরজুড়ে অসংখ্য ছিদ্র, তাই এর শরীরে দ্রুত তেল প্রবেশ করে এবং তা এর অক্সিজেন গ্রহণ ও শারীরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করে। ফলে এই তেল নিঃসরণের ঘটনায় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাঁকড়া ও চিংড়িজাতীয় প্রাণীরা মারা পড়বে। তেল যদি দ্রুত অপসারণ না হয় সপ্তাহ দুয়েক পর মাছ, সাপ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী এবং তীরবর্তী লতাগুল্পগুলো মরতে শুরু করবে। বনের মৃগমারীর সীমানা পেরিয়ে তাম্বুলবুনিয়া, আন্ধারমানিক হয়ে আবারও জয়মণির ঘোল গ্রামে ফেরার দুই পথেই দুটি বক ছাড়া কোনো প্রাণীর দেখা মেলেনি। অথচ সুন্দরবনে এই সময়ে এ এলাকাজুড়ে নানারঙা পাখি, ডলফিন আর হরিণের দেখা মিলত। জয়মণির ঘোল গ্রামে ঢোকার পথেই পশুর নদের পাশে থকথকে আলকাতরার মতো ফার্নেস তেল ভাসতে দেখা গেল। ওই তেলের মধ্যেই জীবন্ত কী যেন নড়ছে। সামনে এগোতেই চোখে পড়ল, তেলের আস্তরণের ভেতর থেকে উদ্ধার পেতে দুটি কাঁকড়া প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তেলগুলো আঠার মতো লেপ্টে প্রাণী দুটির প্রাণ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টাই যেন করছে। জয়মনির ঘাটে নেমে দেখা মিলল জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যর্থ কয়েকটি মৃত কাঁকড়ার। ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা সুনীল জানালেন, ভোর থেকে গ্রামের আশপাশে নদীর পাশ দিয়ে মৃত কাঁকড়া ভেসে যেতে দেখা যাচ্ছে। এরপর ঘাট থেকে নেমে জয়মনি বাজারের দিকে যেতেই দেখা গেল, এক দোকানের সামনে বিশাল ব্যানার টানানো। লেখা, ডুবন্ত জাহাজের তেল ক্রয়কেন্দ্র। সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা প্রেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম বাবুল দাঁড়িয়ে। গ্রামের কিশোর তরুণেরা মাঝেমধ্যে বালতি করে তেল নিয়ে আসছে তাঁর কাছে। প্রতি লিটার ৩০ টাকা করে সেই তেল তিনি কিনছেন। বিকেলে বাবুলের কাছে জানতে চাই, কত লিটার তেল কিনলেন সারা দিনে? তিনি জানালেন, পাঁচ হাজার লিটারের মতো। জয়মনি গ্রামের পথ ধরে এগোতে থাকলে বিভিন্ন রাস্তার মোড় ও বাড়ির কাছ থেকে তেলভর্তি বালতি নিয়ে ক্রয়কেন্দ্রে যেতে দেখা গেল অনেককে। কারও শরীরের অর্ধেক, কারও বা মুখটা ছাড়া শরীরের সবটাই কালো তেলে মাখামাখি। এভাবে তেল উত্তোলন এবং সংগ্রহ কতটা সঠিক জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিসারিজের পরিচালক অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এই ফার্নেস তেলে কী ধরনের রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, তা না জেনে এভাবে তেল উত্তোলন করতে দেওয়া ঠিক না। এই তেল গায়ে লেগে গ্রামবাসীর চর্মসহ অন্যান্য রোগ হতে পারে আশঙ্কা করে তিনি বলেন, যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে তেল উত্তোলন করা উচিত। পরিবেশ ঝুঁকি কমাতে গিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ানো ঠিক হবে না। এদিকে দুই দিন ধরেই নিঃসৃত তেল অপসারণে নিয়ে আসা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কান্ডারি-১০ নামের টাগবোটটি শ্যালা নদীতে চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে নোঙর করে আছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিকেল থেকে এক দফা ওই টাগবোটটি থেকে রাসায়নিক ছিটানো শুরু হলেও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় বন বিভাগের আপত্তিতে তা স্থগিত করা হয়। বোটের মাস্টার আবু বকর সিদ্দিকী জানালেন, ১০ হাজার লিটার ‘অয়েল স্পিল ডিসপারসেন্ট’ নামের রাসায়নিক বোটটিতে মজুত আছে। বোটে বসেই পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বললেন, এই ‘অয়েল স্পিল ডিসপারসেন্ট’ কোন দেশ থেকে আমদানি করা, এটি তৈরির ও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ, এর আমদানি কোড এবং রাসায়নিক নাম পরিবেশ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলেই এটা ছিটানো শুরু হবে। বোটের ভেতরে খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আসা একজন কেমিস্টও রাসায়নিকটি পরীক্ষা করছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এসব পরীক্ষার ফলাফল ইতিবাচক হলে এক দিনেই কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। কোন কোন রুটে এটি ছিটানো হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধানত এ চ্যানেলটিতেই। বন বিভাগ, স্থানীয় জেলে ও নৌযান চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া তেল তাম্বুলবুনিয়া পেরিয়ে বেঙ্গল টাইগারের অভয়ারণ্য কটকা ও কচিখালী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটারের বেশি এলাকায় তেল ছড়িয়েছে। এদিকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নুরুল কাদেরের নেতৃত্বে সাত সদস্যের দলটি কাল দুপুরের পর মংলা ও চাঁদপাই এলাকা পরিদর্শন করে।
No comments:
Post a Comment