চারদিকে উৎকণ্ঠা। সবার মনে প্রশ্ন আর প্রশ্ন- শিশুটি গর্তে আছে? এখনো কি বেঁচে আছে? সে আসলেই গর্তে পড়েছে? উদ্ধার করা যাবে তো? শিশু জিয়াদকে নিয়ে এভাবেই টানা ২৪ ঘণ্টা উদ্ব
েগ্ন-উৎকণ্ঠায় ছিল দেশসুদ্ধ মানুষ। অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে সাড়ে তিন বছরের ছেলেটি প্রাণহীন দেহ নিয়ে বেরিয়ে এসেছে গভীর নলকূপের পাইপ থেকে। তাকে বের করে আনা হয়েছে ২৪ ঘণ্টার এক রুদ্ধশ্বাস, অসহায় উদ্ধার অভিযানের মাধ্যমে। গত শুক্রবার রাজধানীর শাহজাহানপুরের একটি মাঠে খেলতে গিয়ে ওয়াসার অরক্ষিত পাইপে পড়ে যায় শিশু জিয়াদ। তারপর নিথর দেহ নিয়ে বেরিয়ে এসে শিশুটি কোটি মানুষের চোখের জলের সঙ্গে জাগিয়ে তুলেছে হাজারো প্রশ্ন, হাজারো অসহায়ত্ব। প্রশ্ন জেগেছে, একটি শিশু খেলতে খেলতে গর্তে পড়ে গেলে তাকে দ্রুত উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা এই যুগেও এ দেশে নেই? লাশ হয়ে ফিরতে হবে তাকে? প্রশ্নের সঙ্গে ক্ষোভ জাগিয়েছে, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে। শিশুটিকে উদ্ধার অভিযান শুরুর ১৩ ঘণ্টা পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকসহ দায়িত্বশীলরা সন্দেহ প্রকাশ করেন, জিয়াদ নামের শিশুটি গর্তেই পড়েনি। আটক করা হয় শিশুটির বাবাসহ কয়েকজনকে। গতকাল শনিবার ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা ওয়াসা ও রেলের উদ্ধারকারী দল ২২ ঘণ্টা পর জিয়াদ উদ্ধারের শ্বাসরুদ্ধ অভিযানের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তিও ঘোষণা করে। তবে সবাইকে অবাক করে এক দল স্বেচ্ছাসেবী পাতাল থেকে তুলে আনেন শিশু জিয়াদকে। জিয়াদের লাশ উদ্ধারের পর স্বজন ও এলাকাবাসী অভিযোগ করে, দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই বাঁচানো যায়নি জিয়াদকে। নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার না করে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। জিয়াদের লাশ উদ্ধারের পর এখন ব্যর্থতার জন্য দায়ীদের বিচার দাবি করেছে তারা। শুক্রবার সন্ধ্যা ও রাতের অভিযানের ধারাবাহিকতায় রাত ৩টার দিকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাটি ভেতরে নামিয়ে তল্লাশি চালিয়ে জিয়াদের কোনো অস্তিত্ব পাননি উদ্ধারকারীরা। এ সময় ভেতরে কর্কশিটের কিছু অংশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। উদ্ধারকারীরা দাবি করেন, তাঁরা ৪০০ ফুটের মতো গভীরে তল্লাশি চালিয়েছেন। তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, শিশুটি ভেতরে আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এর পরও ভেতরে পরিষ্কার করে খোঁজা হবে বলে জানান মন্ত্রী। একই সময় একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাও সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, শিশুটি পড়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, ‘আমরা এখনো উদ্ধারকাজ শেষ করছি না।’ রাতে দায়িত্বশীলদের এমন বক্তব্যে জিয়াদের পাইপে পড়া নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় দেখা দেয়। পুলিশ জিয়াদের বাবা নাসির উদ্দিনসহ কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। গতকাল সকালেও জিয়াদের গর্তে পড়ার বিষয়ে ব্যাপক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে জিয়াদের পরিবার ও স্থানীয় লোকজন দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, তারা নিশ্চিত যে জিয়াদ পাইপের মধ্যেই আছে। স্বজনরা দাবি করেন, জিয়াদ পাইপে না পড়লে ছেলেটা গেল কোথায়? উদ্ধারকারীদের ব্যর্থতা : শুক্রবার রাতের শেষভাগে স্বেচ্ছাসেবী, বুয়েটের প্রতিনিধিদল এবং উদ্ধারকারীরা মিলে আবার পাইপের ভেতরে ক্যামেরা নামিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। ভোর পৌনে ৫টার দিকে পাইপের ভেতরে ক্যামেরা আটকে গেলে আগের মতোই কিছু বস্তু দেখা যায়। এ সময় ক্যামেরায় ধরা পড়ে জ্বলন্ত লাইটও। এরপর গতকাল সকাল পর্যন্ত উদ্ধার অভিযানে এক রকম স্থবিরতা বিরাজ করে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গর্তের পাশে অবস্থান করেন। আর পাশে বেষ্টনী তৈরি করেন পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা। গতকাল সকাল ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আবারও পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। তবে শুক্রবার রাতভর পাইপে অক্সিজেন দেওয়া হলেও গতকাল সকালে তা আর ব্যবহার করা হয়নি। সকাল ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বশীলরা বলেন, ২৪০ ফুট গভীরের প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। ২০ কেজি ওজনের যন্ত্র দিয়ে আঘাত করেও সেই লেয়ারের প্রতিবন্ধকতা ভাঙা যায়নি। দুপুর ১১টার পরই স্বেচ্ছাসেবীরা পাইপের চারপাশে ভিড় করেন। এ সময় স্বেচ্ছাসেবীদের কাজে বাধা না দিয়ে ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা ও রেলের কর্মীরা সহায়তা করেন। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আব্দুল কাদের চৌধুরী নামের এক স্বেচ্ছাসেবী বলেন, তাঁরা বিশেষ ক্যাচার দিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওই ক্যাচারের সঙ্গে কয়েকটি বড়শির মতো আংটাও নিচে ফেলা হবে। দুপুর ১টার দিকে ওই আংটা ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। তবে আংটার সঙ্গে জিয়াদ বা তার কোনো আলামত উঠে আসেনি। এরপরই আইকন ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মীও কাজে যোগ দেন। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আরেকটি ক্যাচার তৈরির কাজ শুরু করে স্বেচ্ছাসেবীদের আরেকটি দল। এ সময় ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানান। দুপুর আড়াইটার দিকে গভীর নলকূপের পাশে রেলওয়ে কলোনি মাঠে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ভোররাতে ওয়াসার বিশেষ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ‘বোর হোল’ ক্যামেরার মাধ্যমে প্রায় ৩০০ ফুট নিচে সর্বশেষ কঠিন বস্তুর ছবি দেখা যায়। কঠিন বস্তুর কারণে নিচে আর ক্যামেরা নামানো সম্ভব হয়নি। সেখানে শিশুটির কোনো অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি। তাই ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হলো। এর আগে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, শুক্রবার বিকেলে ওই কূপ থেকে শিশু জিয়াদ কথা বলেছে। এমনকি কূপে পাঠানো জুস জিয়াদ পান করেছে। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, যারা পাইপের ওপর থেকে কথা বলেছে তাদের প্রতিধ্বনি আসতে পারে। আর এ ধরনের ঘটনা দেশে প্রথম হওয়াতে অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণে ভুল হতে পারে। উদ্ধারের আগ পর্যন্ত অন্য কর্মকর্তারা বলছিলেন, পাইপের একেবারে নিচে শিশুটির অস্তিত্ব মেলেনি। সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো বস্তু, ফাঙ্গাস ও বড়দের একটি জুতা পাওয়া গেছে। যেভাবে উদ্ধার : গতকাল দুপুরে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধারকাজ শেষ করার পরও একদল স্বেচ্ছাসেবী ভেতরে যন্ত্র পাঠিয়ে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের কিছু কর্মী তাঁদের এ কাজে সহায়তা করছিলেন। তখনো চারপাশে অপেক্ষা করছিল হাজারো উৎসুক জনতা। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল পৌনে ৩টা। এ সময় গর্তের পাশে থেকে ‘পাওয়া গেছে’ বলে কেউ একজন চিৎকার করে ওঠেন। সবার মধ্যে চাঞ্চল্য ফিরে আসে। এরপর আবার নীরবতা। ভেতরে নামানো যন্ত্রটি টেনে তুলছিলেন কয়েকজন উদ্ধারকারী। ২টা ৫৫ মিনিটে উঠে আসে সেই যন্ত্র। হইচই, হট্টগোল বেধে যায় চারদিকে। ভিড় ঠেলে দর্শনার্থীরাও দেখে সেখানে ঝুলছে একটি শিশুর দেহ। জিয়াদকে যখন তোলা হয় তখন তার দেহ ছিল নিথর। উদ্ধারকারীরা দ্রুত জিয়াদকে শাহজাহানপুর মৈত্রী মাঠে নিয়ে যান। সেখানে ওয়াজ মাহফিল চলছিল। ওই মাহফিলের মঞ্চে নিয়ে জিয়াদকে পর্যবেক্ষণ করেন উদ্ধারকারীরা। সেখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় জিয়াদকে এক নজর দেখার জন্য। বিকেল ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে জিয়াদকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল ৩টা ৩৫ মিনিটে তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছে। এ সময় আবাসিক সার্জন ডাক্তার রিয়াজ মোর্শেদের নেতৃত্বে চার সদস্যর একটি টিম আগ থেকেই প্রস্তুত ছিল। বিকেল ৪টার দিকে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জিয়াদকে মৃত ঘোষণা করেন। ডাক্তার রিয়াজ মোর্শেদ জানান, জিয়াদকে হাসপাতালে আনার পর তার ইসিজি করা হয়। তার শরীরে গুরুতর কোনো জখম ছিল না। শুধু দুই পায়ের ঊরু ও বুকের ওপরের চামড়া কিছুটা উঠে গেছে। উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, পাইপের ভেতর জিয়াদের অস্বিত্ব নেই- ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসার ১৫ মিনিটের মাথায় সাত-আটজন তরুণের নিজস্ব উদ্ভাবিত প্রযুক্তিনির্ভর একটি ক্যাচারের সুবাদে পানির পাম্পের পাইপ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। উদ্ধারকাজে ব্যবহার করা হয় ওই তরুণদের ‘ক্যাচার’ পদ্ধতি। রশি ঝুলিয়ে কূপের তলদেশে পাঠানো ওই লোহার রড দিয়ে তৈরি করা ক্যাচারে গোপন ক্যামেরা (সিসিটিভি) ও টর্চলাইট যুক্ত ছিল। আর ঘূর্ণনশীল ক্যাচারের ভেতরে ঢুকে পড়লে নিচে থাকা লোহার হুকে আটকা পড়ে শিশুটি উঠে আসে বলে তরুণরা জানান। ওই তরুণরা সেইফ টেক বিডি, আইকন বিডিসহ তিন-চারটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন রংপুর পলিটেকনিক ও ঢাকা আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল বিভাগের ছাত্র মো. কবির মুরাদ বলেন, ‘সেইফ টেক বিডি নামের বন্ধুর একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া ধারণা নিয়ে গতকাল দুপুর ২টার দিকে ক্যাচারের নিচে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে ওপরে থাকা যন্ত্রটিতে মানুষ আকৃতির কিছু ফুটেজ আসে। ওই ফুটেজ একটি বড় মনিটরের মাধ্যমে দেখলে আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে। এভাবে একের পর এক করে লোহার ক্যাচার ফেলতেই থাকি। আমাদের চেষ্টায় অবশেষে বিকেল ৩টার দিকে শিশু জিয়াদ উঠে আসে।’ চিকন পাইপ তোলার পরই নিচে পড়ে যায় জিয়াদ : ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পানির পাইপের ভেতরে থাকা দুই ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাইপটি ওপরে তোলার পরপরই শিশু জিয়াদ নিচে পড়ে যায় বলে ধারণা করছি। এর পরই সে মারা যায়। এর আগে তার সাথে আমাদের লোকজন কথা বলেছে। জিয়াদের বাবা-মাও কথা বলেছেন। তবে তাকে বাঁচাতে আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।’ রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রকৌশলী মফিজুর রহমান বলেন, ৬০০ ফুট গভীরের মধ্যে ৩৫০ ফুট পাইপের ব্যাসার্ধ ছিল ১৬ ইঞ্চি, ১৩০ ফুট পাইপের ব্যাসার্র্ধ ছিল আট ইঞ্চি ও পাম্পের ব্যাসার্ধ ছিল ২৪৬ ইঞ্চি। সেই থেকে বোঝা যায়- ৩৫০ ফুট গভীরে গিয়ে জিয়াদ আটকে গিয়েছিল। চিকন পাইপটি তোলার পর হয়তো সে নিচে পড়ে যায়। পাম্পের পাশের ক্যাম্পে নেই পুলিশ : জিয়াদের মৃত্যুকূপের উত্তর পাশেই আছে শাহজাহানপুর অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। অথচ সেখানে থাকেন না কোনো পুলিশ সদস্য। কলোনিবাসীর নিরাপত্তার জন্য মূলত ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয়। জিয়াদ পাইপের ভেতরে পড়ে যাওয়ার সময় ওই ক্যাম্পে পুলিশ ছিল না বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করে। অনেক আগেই মৃত্যু : শিশু জিয়াদ কখন মারা গেছে তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। শুক্রবার রাত আনুমানিক ১১টার দিকেও ফায়ার সার্ভিস বলেছিল- জিয়াদ এখনো বেঁচে আছে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে ওয়াসার অত্যাধুনিক ক্যামেরার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে পাইপের ভেতরে জিয়াদ নেই। তবে গতকাল বিকেলে ডা. রিয়াজ মোর্শেদ সাংবাদিকদের জানান, ফরেনসিক পরীক্ষার পর বোঝা যাবে তার কখন মৃত্যু হয়েছে। লাশের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, উদ্ধারের আনুমানিক চার ঘণ্টা আগে শিশুটি মারা যেতে পারে। আজ ময়নাতদন্ত হতে পারে : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার হাবিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশ ও শিশুটির পরিবার চাইলে আজ লাশের ময়নাতদন্ত করা হবে। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো অনুরোধ আসেনি। লাশ মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে।’ এলাকায় বিক্ষোভ, উত্তেজনা, পুলিশ মোতায়েন : উদ্ধারের পর লোকমুখে জিয়াদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ শুরু করে। তারা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ‘মিথ্যাচার’ ও কূপের মুখ খোলা থাকায় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের পদত্যাগের দাবিতে জুতা প্রদর্শন করে স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা লাঠিসোঁটা দিয়ে সেই মৃত্যুকূপের পাশে থাকা ওয়াসার নির্মাণসামগ্রী রাখার টিনশেডের গুদাম ভেঙে ফেলে। এই সময় পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করতে গেলে বিক্ষুব্ধরা পুলিশকে লক্ষ্য করেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। বিক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে একজন আমিরুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি সব ধরনের প্রযুক্তি যেখানে ব্যর্থ, সেই ব্যর্থতার দায় স্বীকার না করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, পাইপের মধ্যে মানুষের বদলে কীটপতঙ্গের ছবি দেখা গেছে। তাহলে জিয়াদের লাশ উঠল কিভাবে? আমিরুল বলেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ ধরনের বক্তব্য না দিয়ে সত্যিকার অর্থে উচ্চ প্রযুক্তির ক্যামেরাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করলে শিশুটিকে জীবিত তোলা সম্ভব হতো। এর আগে শুক্রবার গভীর রাতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা নিচে নামানো হয়েছিল, সেখানে মানুষের কোনো অস্তিত্ব দেখা যায়নি। কিছু কীটপতঙ্গের ছবি দেখা গেছে। পাইপে কোনো মানুষ নেই, সেটা ক্যামেরায় দেখা গেছে। এটা আসলে গুজব হতে পারে।’ এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়। মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। প্রস্তুত রাখা হয় সাঁজোয়া যান এপিসি ভ্যান। এই প্রসঙ্গে মতিঝিল ডিভিশনের উপপুলিশ কমিশনার আশরাফুজ্জামান জানান, এই ঘটনাকে পুঁজি করে যাতে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। একটি মহল চাচ্ছে শিশু জিয়াদের মৃত্যুর ঘটনাটি নিয়ে এলাকাবাসীকে খেপিয়ে তুলতে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জিয়াদের পরিবারকে হয়রানি বা নির্যাতন করা হয়নি। পাইপের ভেতরে কোনো কিছু না পাওয়ায় জিয়াদের বাবাসহ অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইলেন মা : আদরের ধন কোলে ফিরে আসবে- এই আশায় বুক বেঁধে শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে দীর্ঘ ২০-২২ ঘণ্টা রেলওয়ে কলোনির বাসার দরজার সামনে বসে ছিলেন জিয়াদের মা খাদিজা আক্তার। শুক্রবার বিকেলে পাইপের মুখে গিয়ে ছেলের সঙ্গে শেষ কথা বলে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে জিয়াদ পাইপের নিচেই রয়েছে। বারবার ওই কথা স্মরণ করে কেঁদে উঠছিলেন তিনি। গতকাল বিকেলে ছেলের লাশ পাওয়ার খবর শুনে আবারও আহাজারিতে ভেঙে পড়েন মা। তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ বিভিন্নজন জিয়াদকে উদ্ধার করার নামে বিভিন্ন ধরনের কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি তাঁদের বিচার চাই। তাঁরা যদি বিভিন্ন ধরনের কথা না বলে ভালোভাবে খুঁজে দেখতেন, তাহলে আমার বাচ্চাকে আমি কালকেই পেতাম।’ জিয়াদের মা আরো বলেন, শুক্রবার রাতে তাঁর স্বামী ও ভাইকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বাচ্চাটাকে তাঁরা কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসবেরও বিচার চান। বাবার সংবাদ সম্মেলন : গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে জিয়াদের বাবা নাসিরউদ্দিন শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে সন্তানের লাশ উদ্ধার ও সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা এবং তাঁর পরিবারকে হয়রানি করার অভিযোগ তোলেন। এর জন্য তিনি আইনের আশ্রয় নেবেন বলেও জানান। নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলের মৃত্যুর ঘটনার জন্য যারা দায়ী, আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করব। রেলের লোকজনের কারণে পাইপটি এভাবে ছিল।’ ‘উদ্ধারে কারো ব্যর্থতা নেই’ : স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা আমার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, তারা বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাসের লোক। আমি ইলিগ্যাল কিছুই বলিনি। আমি বলেছি, পাইপের ভেতরে যেসব বস্তু দেখা যাচ্ছিল সেগুলো পরিষ্কার করে আবার অভিযান চালাতে। আমি শুধু এটুকু বলেছি, ক্যামেরায় যেটুকু দৃশ্য দেখা গেছে সেখানে শিশুটি ছিল না। সে হিসেবে আমি বক্তব্য দিয়েছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ কর্তৃপক্ষের কোনো ব্যর্থতা নেই। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জিয়াদকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম।’ যত অভিযোগ সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে : শিশু জিয়াদের মৃত্যুর জন্য তার পরিবার ও এলাকাবাসী দায়ী করেছে ফায়ার সার্ভিস, গোয়েন্দা সংস্থা, ওয়াসা, রেলওয়ে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসআর হাউস, পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে। জিয়াদের বাবা নাসির উদ্দিন বলেন, সংস্থাগুলোর গাফিলতির কারণেই তাঁর আদরের ধনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের বিচার করতে হবে। মনির হোসেন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, শুক্রবার রাতেই ওই সংস্থাগুলো ঘোষণা দিয়ে দিল, পাইপের ভেতর জিয়াদ নেই। অথচ স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে সেই পাইপের ভেতর থেকেই উদ্ধার করে। একই কথা বলেছেন স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবদুল কুদ্দুস, রমজান ব্যাপারী, রুহুল আমিনসহ অনেকে। বন্ধ করে দেওয়া হলো সেই মৃত্যুকূপ : অবশেষে বন্ধ করে দেওয়া হলো সেই পাইপের মুখটি। গতকাল বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ফায়ার সার্ভিস, রেলওয়ে ও ওয়াসার কর্মীরা পাইপের মুখে ধাতব পাত দিয়ে ঝালাই করে দেন। রেলওয়ের মহাপরিচালক তফাজ্জল হোসেন বলেছিলেন, সেখানে একটি নতুন গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছিল। কিন্তু পুরনো নলকূপের মুখ বন্ধ না করেই তারা কাজ করছিল। অথচ এ ধরনের কাজ করার সময় পরিত্যক্ত নলকূপের মুখ ঝালাই করে বন্ধ করার নিয়ম রয়েছে। রেলওয়ের তদন্ত কমিটি : ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আহম্মদ উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, রেলওয়ের ঢাকা বিভাগের প্রকৌশলী-৩-কে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। তা ছাড়া আরো দুজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়। হত্যা মামলা দায়ের জিয়াদের বাবার : ছেলের লাশ উদ্ধারের প্রায় ৯ ঘণ্টা পর জিয়াদের বাবা নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে শাহজাহানপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় পাম্প বসানোর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেআরএসের স্বত্বাধিকারী আব্দুস সালাম ও রেলওয়ের প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে আসামি করা হয়েছে। রাত পৌনে ১২টার দিকে তিনি থানায় হাজির হয়ে মামলা দায়ের করেন। শাহজাহানপুর থানার ওসি মেহেদী হাসান জানান, এজাহারে বলা হয়েছে- ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাইপটির মুখ খোলা রাখে। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এটা তদারকি করেননি। তাঁদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে জিয়াদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। ফলে তাঁদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। ওসি জানান, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া পুলিশও মামলা করবে বলে ওসি জানান।
No comments:
Post a Comment