
দেখিয়েছে তারা। চীনের কাছ থেকে এ বিনিয়োগ পেলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এককভাবে এটিই হবে সর্বোচ্চ অর্থ সহায়তা। দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের ১০ কম্পানির ৬৫ প্রকল্পের জন্য এ অর্থ বিনিয়োগ করা হবে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জানা যায়, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে নেওয়া প্রকল্পগুলো নিয়ে এরই মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেছেন চীনা প্রতিনিধিরা। সম্প্রতি এক্সিম ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফরে এলে বিদ্যুৎ বিভাগে তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎসচিব মনোয়ার ইসলাম ও বিদ্যুৎ বিভাগের কম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে ৩২ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা চায় বাংলাদেশ। চীনের এক্সিম ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন। তবে তাঁরা বলেছেন, একসঙ্গে এ অর্থ দেওয়া হবে না। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এ অর্থ দেওয়া হবে। এ ছাড়া এ বিনিয়োগের সুদের হারও এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। এরই মধ্যে বাংলাদেশে দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করার জন্য সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে চীনের দুটি কম্পানি। প্রতিটি এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যও অর্থায়ন করবে চীনা এক্সিম ব্যাংক। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চীনা এক্সিম ব্যাংকের কাছে দেওয়া সরকারের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির (ওজোপাডিকো) একটি প্রকল্পে ১৩০ মিলিয়ন ডলার, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ১৪ প্রকল্পে তিন হাজার ৬৫ মিলিয়ন ডলার, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কম্পানির (ডেসকো) আট প্রকল্পে ২১৯ মিলিয়ন ডলার, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কম্পানির (এপিএসসিএল) চার প্রকল্পে চার হাজার ৭০ মিলিয়ন ডলার, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কম্পানির চার প্রকল্পে এক হাজার ৭০০ মিলিয়ন ডলার, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্র্ডের তিন প্রকল্পে ৯ হাজার ২৬৫ মিলিয়ন ডলার, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির একটি প্রকল্পে এক হাজার ৯৯৯ মিলিয়ন ডলার, পাওয়ার গ্রিড কম্পানির (পিজিসিবি) ২২ প্রকল্পে তিন হাজার ৮৬৯ মিলিয়ন ডলার, ইমলকট্রিসিটি জেনারেশন কম্পানির (ইজিসিবি) চার প্রকল্পে সাত হাজার ৯৪ মিলিয়ন ডলার এবং রুরাল পাওয়ার কম্পানির (আরপিসিএল) চার প্রকল্পে এক হাজার ৩১০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের কাছে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে চীন। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কম্পানি এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) যৌথ মূলধনীতে এ কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে। এর জন্য খরচ পড়বে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। আমদানি করা কয়লা দিয়ে কেন্দ্রটি চালানো হবে। জানা গেছে, সরকারি খাস জমিতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাওয়ায় পুনর্বাসন খাতে অর্থ লাগবে কম। আন্ধারমানিক ও রামনাবাদ নদীর মোহনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন করা হবে। নদীতে নাব্য থাকায় গভীর সমুদ্র থেকে ছোট জাহাজে করে কয়লা আনার ক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা হবে না। এ দুই নদীতে গ্রীষ্ম মৌসুমে ছয় মিটার এবং বর্ষায় ১৩ মিটার ড্রাফট (পানির গভীরতা) পাওয়া যাবে। গভীর সমুদ্র থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরত্বে বার্জে কয়লা পরিবহন করা হবে। এরই মধ্যে কেন্দ্রটির জন্য জমি অধিগ্রহণ ও অন্যান্য কাজ শুরু হয়েছে। কম্পানির ৩০ শতাংশ অর্থ সমানভাবে বিনিয়োগ করবে চীন ও বাংলাদেশ। বাকি ৭০ শতাংশ ঋণ নেওয়া হবে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। কেন্দ্রটি ২০১৯ সালের মধ্যেই উৎপাদনে আসবে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ প্রকল্পের জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রকল্পে ৩০ শতাংশের অর্ধেক আমাদের, বাকি ১৫ শতাংশের মালিকানা থাকবে চীনের সিএমসির। আমাদের মালিকানার ১৫ শতাংশের বিনিয়োগ আমরা চীনের এক্সিম ব্যাংকের কাছে চেয়েছি। তারা দিতে সম্মত হয়েছে।' চীনের অর্থায়নে অন্য প্রল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তারা বাকিগুলোতেও ঋণ দিতে চেয়েছে। তবে সব টাকা একসঙ্গে না দিয়ে ধাপে ধাপে দেওয়া হবে। এত অর্থ একসঙ্গে নিয়ে আমরা খরচও করতে পারব না।' এই ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার শতকরা দুই ভাগের নিচে থাকবে বলেও জানান তিনি। পটুয়াখালীর পায়রা ছাড়াও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে চায়না হুদিয়ান হংকংয়ের সঙ্গে পিডিবি একটি যৌথ মূলধনী কম্পানি গঠনের মাধ্যমে। চায়না হুদিয়ান হংকং চীনের রাষ্ট্রীয় কম্পানি। এ ছাড়া চায়না থার্মাল পাওয়ার স্টেশন ও চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানি লিমিটেড বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বড় বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের মহাপরিকল্পনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও সঞ্চালন ব্যবস্থা উন্নতকরণ, বিতরণ ব্যবস্থা গ্রাহকঘনিষ্ঠ করে তোলার জন্য প্রি-পেমেন্ট মিটারিং ব্যবস্থার মতো প্রকল্প রয়েছে। সরকার গত ছয় বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়ায় সঞ্চালন ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। সঞ্চালন ব্যবস্থা আরো আধুনিকায়ন করতে সরকার বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিদ্যুৎ বিভাগের সঞ্চালনের সীমাবদ্ধতা কেটে যাবে। জানা গেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৬ হাজার ৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে আসবে তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এ ছাড়াও জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করে উৎপাদিত হবে ১৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, গ্যাস থেকে আট হাজার ৯৫৬ মেগাওয়াট, ফার্নেস অময়ল থেকে পাঁচ হাজার ২১৭ মেগাওয়াট, ডিজেল থেকে ৫০০ এবং পানি থেকে আরো ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দরকার ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ। এ ছাড়া একই সময়ে সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নে আরো সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।
No comments:
Post a Comment