কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্যসচিব করে ৫৩ সদস্যের এই কমিটি ঘোষণা করা হয়। নতুন কমিটিতে আগের আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকাকে উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়েছে। গত রাত ১০টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী এ
ই কমিটি ঘোষণা করেন। ঘোষিত কমিটিতে ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুকে। কমিটিতে চার সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টামণ্ডলী রাখা হয়েছে। তাতে সাদেক হোসেন খোকা ছাড়াও রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও সাবেক সদস্যসচিব আবদুস সালাম। রুহুল কবীর রিজভী সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করে বলেন, ঢাকা মহানগর কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় এতদিন আহ্বায়ক কমিটি ছিল। এই কমিটি বিলুপ্ত করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। দলের চেয়ারপারসনের পরামর্শক্রমে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই নতুন কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন। নতুন আহ্বায়ক কমিটি আগামী এক মাসের মধ্যে ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ শেষ করে মহানগর কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করবে। ছয়জন যুগ্ম আহ্বায়কের মধ্যে আবদুল আউয়াল মিন্টু ছাড়াও রয়েছেন (পর্যায়ক্রমে) বিএনপির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক সালাউদ্দিন আহম্মেদ, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল বাশার, ঢাকা বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু, নির্বাহী কমিটির সদস্য এম এ কাইয়ুম এবং সহ-তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আবু সাইদ খান খোকন। সদস্যরা হলেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, বরকতউল্লাহ বুলু, নির্বাহী কমিটির সদস্য এস এ খালেক, সমাজকল্যাণ সম্পাদক আবুল খায়ের ভুঁইয়া, যুববিষয়ক সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন অসীম, সহ-সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মো. সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ, আবদুল লতিফ (কলাবাগান), আবদুল মজিদ (রমনা), আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার (তেজগাঁও), শামসুল হুদা (সবুজবাগ), সাজ্জাদ জহির (শাহজাহানপুর), একরামুল হোসেন (শাহজাহানপুর), ইউনুস মৃধা (খিলগাঁও), মুন্সি বজলুল বাসিত আনজু (মিরপুর), সাদেক আহমেদ (জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল), আলী আজগর মাতব্বর (কাফরুল), নিতাই চন্দ্র ঘোষ (সূত্রাপুর), আহসান উল্লাহ হাসান (পল্লবী), বোরহানুজ্জামান ওমর (পল্টন), হারুন অর রশীদ হারুন (মতিঝিল), সিরাজুল ইসলাম সিরাজ (কলাবাগান), গোলাম হোসেন (সবুজবাগ), তানভীর আদেল বাবু (পল্টন), আবুল হাসান তালুকদার ননী (শাহবাগ), আবু মোতালিব (চকবাজার), আলী ইমাম আসাদ (পল্লবী), আবদুল মতিন (মোহাম্মদপুর), আবদুস সামাদ (কোতোয়ালি), হাজি আলতাফ হোসেন (লালবাগ), ফরিদ আহমেদ ফরিদ (দয়াগঞ্জ), হাজি আনোয়ার পারভেজ বাদল (চকবাজার), আখতার হোসেন (খিলক্ষেত), নবী উল্লাহ নবী, হাজি মীর হোসেন মীরু, ফখরুল ইসলাম ফরু (রামপুরা), মিসেস ফেরদৌস আহমেদ মিষ্টি (শাহ আলী থানা), তানভীর আহমেদ রবীন (কদমতলী), শেখ রবিউল আলম (ধানমণ্ডি), মো. কফিল (উত্তরা-পূর্ব), আরিফুর রহমান নাদিম (আরমানিটোলা), মো. জাফরুল (বংশাল) ও এস এম জিলানী। প্রসঙ্গত, গত বুধবার মহানগর বিএনপির ইফতার পার্টিতে খালেদা জিয়া শিগগির নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের ঘোষণার এক দিনের মধ্যে এই কমিটি ঘোষণা করা হলো। ২০১১ সালে ১৪ মে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঢাকার সাবেক মেয়র ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও আবদুস সালামকে সদস্যসচিব করে কমিটি ঘোষণা করেন। ওই কমিটি ছিল ১৯ সদস্যের। এরপর ছয় মাসের মধ্যে সর্বস্তরের কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। গত ফেব্রুয়ারি থেকে বেশ কয়েকবার শোনা যায়, শিগগিরই মহানগর বিএনপির কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে। নতুন কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে একেকবার একেকজনের নাম শোনা যায়। এ অবস্থার মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার রাতে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বৈঠকের পর দলের এক নেতা জানান, মহানগর বিএনপির কমিটি করার লক্ষ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের প্রস্তাবিত একটি তালিকা কাটছাঁট করে কমিটি চূড়ান্ত করেন দলীয় প্রধান। বিএনপির এক নেতা জানান, বৃহস্পতিবার রাতের বৈঠকে মির্জা আব্বাসের করা তালিকা নিয়ে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে দলের এক যুগ্ম মহাসচিবকে রেখে অন্যদের বিদায় করে দেন খালেদা জিয়া। ওই নেতাকে নিয়ে তালিকা কাটছাঁট করে মহানগর বিএনপির কমিটি চূড়ান্ত করেন খালেদা জিয়া। ওই নেতা জানান, মির্জা আব্বাস ৩১ জনের তালিকাসংবলিত একটি কমিটির প্রস্তাব করেছিলেন। ওই তালিকা কাটছাঁট করেই কমিটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, এই কমিটির বিষয়ে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কিছু দিকনির্দেশনা ছিল। সেটা বিবেচনায় নিয়েই কাটছাঁট করেন দলীয় প্রধান। মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ এক নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, কমিটির দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে আব্বাস সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সাদেক হোসেন খোকার মতামতকে। এ নিয়ে খালেদা জিয়াও ফোনে কথা বলেন খোকার সঙ্গে। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করা হলে খোকাকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হবে বলে খালেদা জিয়া তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন। খোকাও শারীরিক অসুস্থতার কারণে মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকতে চাননি বলে দাবি ওই নেতার। মহানগর বিএনপির কমিটি পুনর্গঠন করা হবে বলে খালেদা জিয়া প্রথম ঘোষণা দেন গত ১০ ফেব্রুয়ারি। এরপর শুরু হয় নানা মেরুকরণ, গুঞ্জন। কখনো শোনা যায়, হান্নান শাহকে আহ্বায়ক করে কমিটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। আবার শোনা যায় আবদুল আউয়াল মিন্টুকে আহ্বায়ক ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্যসচিব করা হচ্ছে। এরপর সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে সদস্যসচিব করে কমিটি আসছে। কিন্তু ২৩ মে খোকা যুক্তরাষ্ট্রে গেলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। দুই সপ্তাহের মধ্যে তাঁর দেশে ফেরার কথা থাকলেও দেড় মাস পেরিয়েছে। তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত খোকাকে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। সুস্থ হয়ে কবে ফিরবেন তা বলা যাচ্ছে না। গত মাসের মধ্যভাগে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গুলশানে নিজ কার্যালয়ে ডেকে নেন বিএনপি চেয়ারপারসন। দলীয় সূত্রে জানা যায়, তিনি আব্বাসকে ঢাকা মহানগর বিএনপির দায়িত্ব নিতে বললে তিনি দুই-তিন দিন সময় চান। সপ্তাহখানেক পর দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে সম্মতি দেন আব্বাস। এ সময়ের মধ্যে সাদেক হোসেন খোকাসহ ঢাকা মহানগর বিএনপির সিনিয়র নেতা এবং মহানগরীতে দলের সাবেক সংসদ সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেন আব্বাস। আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর সঙ্গে কাজ করার সম্মতি দেন সবাই। এর পরপরই খালেদা জিয়ার কাছে দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানান আব্বাস। পরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আরো দুই দিন বৈঠক করেন তিনি। এরপর যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সাইদ খান খোকন, আবদুল কাইয়ুম ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল- এই চারজনের মধ্যে একজনকে সদস্যসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ১ নম্বর সদস্য রেখে স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও হান্নান শাহকে উপদেষ্টা এবং যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমানসহ ৩১ সদস্যবিশিষ্ট একটি তালিকা তৈরি করেন আব্বাস। রমজানের আগে তা জমাও দেন খালেদা জিয়ার কাছে। খালেদা জিয়া ওই সময় মির্জা আব্বাসকে জানিয়েছিলেন, রোজার আগেই কমিটি ঘোষণা করা হবে। পরে ২ রমজানে বিএনপি আয়োজিত ইফতার পার্টিতে কমিটি ঘোষণার কথা বলা হয়। তা-ও পিছিয়ে যায়। অবশেষে গত বুধবার মহানগর বিএনপি আয়োজিত ইফতার পার্টিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির ভোট বর্জনের আন্দোলনে রাজধানীতে মহানগর কমিটির কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। ঢাকায় আন্দোলনে ত্রুটি ছিল, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই ঢাকা মহানগরের নতুন আহ্বায়ক কমিটি অতি দ্রুত দেওয়া হবে।
No comments:
Post a Comment