Monday, August 11, 2014

চিকিৎসা যন্ত্র মেরামতে সিন্ডিকেট:যুগান্তর

সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি মেরামতের নামে অর্থ তছরুপের অভিযোগ উঠেছে। সরকারি অর্থের তছরুপ করছে ‘ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট মেইনটেইনেন্স ওয়ার্কশপের (নিমিউ)’ অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট। চক্রটি টেন্ডার প্রক্রিয়ার চেয়ে সরাসরি কার্যাদেশ দেয়া এবং ক্যাশ ভাউচারে টাকা ব্যয়ে বেশি উৎসাহী। গত জুন মাসের প্রথম ১০ দিনে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার কার্যাদেশ দি
য়েছে নিমিউ। এভাবে কাজ বণ্টন ও টাকা বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক আইন-কানুনও অনুসরণ করা হচ্ছে না। এসব ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে নিমিউর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ। অভিযোগপত্র ঘেঁটে ও যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। চিকিৎসা যন্ত্র মেরামতের নামে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব এমএম নিয়াজ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে একটি অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। উত্থাপিত অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে।’ নিমিউর কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত দিনে যন্ত্র মেরামতের নামে অর্থবছরের শেষ দিকে একসঙ্গে এত টাকা খরচ দেখানো হয়নি। কী ধরনের কতগুলো যন্ত্র মেরামত করা হচ্ছে, প্রকৃত ব্যয় কত এসব ব্যাপারে মেরামত শাখায় পদস্থরা জানেন না। চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজার (সিটিএম) আবদুল কাইয়ুমের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটের ইশারায় চলছে সব কাজ। সিটিএম আবদুল কাইয়ুম টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘যন্ত্র মেরামতে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। আমরা দ্রুততার সঙ্গে মেরামতের কাজ করতে চাচ্ছি। অভিযোগ দায়ের সম্পর্কে জানি না।’ উত্থাপিত কয়েকটি অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে বললে তিনি বলেন, কাগজপত্র দেখে বলব। অফিসে আসুন। এরপর কমপক্ষে দু’দিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলেও নানা অজুহাতে সময় দেননি তিনি। পিপিআর ২০০৮ অনুযায়ী ক্যাশ ভাউচারে প্রতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা খরচের অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু গত অর্থবছরে প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ করেছে নিমিউ। কমিশনের টাকা হাতিয়ে নিতে এ কাজ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর অভিযোগ। নিমিউ সূত্র জানায়, অনিয়মের পথ সুগম করতে পছন্দের কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসিয়েছেন বর্তমান সিটিএম আবদুল কাইয়ুম। কখনও এ সিন্ডিকেটের লোকেরা নিজেরাই টাকা আত্মসাতে লিপ্ত। আবার কখনও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অথবা পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ পাইয়ে দিয়ে টাকা হাতানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। এসব টাকা কৌশলে ভাগাভাগি করা হয়। নিমিউতে যেসব অনিয়ম বাসা বেঁধেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- এক পদের কর্মীকে অন্য পদে দায়িত্ব দেয়া, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন কমিটিতে ২য় ও ৩য় শ্রেণীর লোক রাখা, ক্যাশ ভাউচারে টাকা খরচে অতি উৎসাহ, ৩য় শ্রেণীর কর্মচারীকে অফিসের সার্বিক কার্যক্রম মনিটরের দায়িত্ব দেয়া, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির (ডিপিএম) ব্যবহার। একদিকে জুনিয়র কর্মীদের বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন পদের বেশকিছু কর্মীকে দায়িত্ব থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। নিমিউ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে চলে। সিটিএম মন্ত্রণালয়ের কাছে দায়বদ্ধ। কাজেই প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। কাগজপত্রে দেখা যায়, নিমিউর টেকনিক্যাল ম্যানেজার (মেরামত) দুলাল কৃষ্ণ বিশ্বাস ৪ জুন অনিময়ের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। এই অভিযোগপত্রটির সঙ্গে নিমিউর আরও সাতজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর সংযুক্ত রয়েছে। এসব কাগজপত্রে নিমিউতে চলমান অনিয়মের তথ্য বিস্তারিত বলা আছে। টেকনিক্যাল ম্যানেজার (মেরামত) দুলাল কৃষ্ণ বিশ্বাস যুগান্তরকে বলেন, ‘ক্যাশ ভাউচারে ৫ লাখের স্থলে ৪০ লাখ টাকা খরচ করে ফেলা হয়েছে। যন্ত্র মেরামতের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার ছাড়াই ২ কোটিরও বেশি টাকার কাজ দেয়া হয়েছে। এতে নিশ্চিতভাবেই অডিট আপত্তি উঠবে। সিটিএমকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি পরামর্শ শুনছেন না। দাফতরিক দায়িত্বের কারণে অডিট আপত্তির দায় আমার ঘাড়েও বর্তাবে। এ জন্যই প্রতিকার চেয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছি।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বর্তমানে নিমিউর মাধ্যমে যন্ত্র মেরামতের পরিমাণ আগের তুলনায় বেশি। নিমিউ উদ্যোগী হয়েও বেশকিছু যন্ত্র মেরামত করেছে। তবে মেরামত কাজ ও টাকা বরাদ্দের প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছেন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কর্মীরাই। মন্ত্রণালয়ে অভিযোগকারীদের একজন যুগান্তরকে জানান, মেরামতের জন্য কর্মী পাঠানোর সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা অগ্রিম দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে যাতে বিল করার সময় বেশি টাকার ক্যাশ ভাউচার জমা দেয়। বিশেষত জুনিয়র প্রকৌশলীদের এভাবে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রে নামেই যন্ত্র মেরামত দেখানো হচ্ছে। আড়ালে মেরামতের টাকার বড় অংশ মূলত ভাগাভাগি করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দায়েরকৃত অভিযোগপত্র ঘেঁটে ও অভিযোগকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জুন মাসের প্রথম ১০ দিনে মোট ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার ১৬৪ টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২ জুনে যন্ত্র মেরামতের জন্য দুই কোটি এক লাখ চার হাজার ৪৭০ টাকার কার্যাদেশ পেয়েছে ‘আনিফকো হেলথ কেয়ার’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক বর্তমান সিটিএমের এক আত্মীয়। কার্যাদেশের কপিতে দেখা যায়, কিছুসংখ্যক এন্ডোসকপি মেশিন এবং আইসিইউ ভেন্টিলেটর মেশিন মেরামতে এসব কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি (ডিপিএম)। আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে দেড় কোটির কিছু বেশি টাকার কাজ। আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে আছে প্রশাসনিক অনিয়মও। গত বছরের ২৭ নভেম্বর সিটিএমের দফতর থেকে জারিকৃত একটি অফিস আদেশে উপসহকারী প্রকৌশলী (ইলেকট্রনিক্স) আহম আপেল মাহমুদকে সামগ্রিক মেরামত কাজ ও অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর থেকেই সব কাজে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন আপেল। অথচ মেরামত শাখায় টেকনিক্যাল ম্যানেজারসহ আরও দু’একজন ঊর্ধ্বতন পদের কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। সরবরাহ ও সংগ্রহ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবুল হোসেনকে নিমিউর টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির (টিইসি) সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আবুল হোসেন একজন ২য় শ্রেণীর কর্মকর্তা। সাধারণত টিইসির সদস্য সচিব হিসেবে একজন ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-২ শাখার আদেশে নিমিউর সহকারী মেরামত কাম প্রশিক্ষণ প্রকৌশলীকে টিইসির সদস্য সচিব করা হয়েছিল। বাজার দর যাচাই কমিটিতেও রাখা হয়েছে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কিছু কর্মীকে। সিটিএম আবদুল কাইয়ুমের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সিনিয়র স্টোরকিপার কাজল কান্তি বড়–য়াকে হিসাব শাখার পাশাপাশি সরবরাহ ও সংগ্রহ কর্মকর্তার দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। নিমিউ সূত্র জানায়, হিসাব শাখার পদটি ২০১২ সাল থেকে খালি। এ সুযোগে কাজলকে দায়িত্বে বসানো হয়েছে। আরেক উপসহকারী প্রকৌশলী মুকুল কান্তি বড়–য়াকেও অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে উপরস্থ পদে পাঠানো হয়েছে। এক্স-রে শাখায় উপ-সহকারী মেরামত প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ ইউসুফকে এক্স-রে শাখার সব কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অথচ এখানে শাখা প্রধান হিসেবে আবদুর রহমান নামক একজন সহকারী প্রকৌশলী কর্মরত আছেন।  

No comments:

Post a Comment