Monday, August 11, 2014

সন্দেহের তালিকায় র‌্যাবের আরও ২৩:প্রথম অালো

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় জড়িত বা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, এমন আরও ২৩ সদস্যকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এঁরা সবাই র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব-১১) সদস্য। এ ছাড়া ঘটনার শুরুতে র‌্যাবের তিন পদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে এ মামলার আসামি করা হয়। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। কর্মকর্তারা জানান, ইতিমধ্যে র‌্যাবের ২৩ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এঁদের ১৮ জনকে আসামি ক
রা হতে পারে। অন্যরা এ মামলার সাক্ষী হতে পারেন। তবে হত্যাকাণ্ডের তিন মাস অতিবাহিত হলেও আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র শিগগিরই দাখিল করার সম্ভাবনা কম। মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফেরত আনার জন্য অপেক্ষা করবে পুলিশ। এ ব্যাপারে সরকারের ওপর মহলের নির্দেশ আছে বলে জানা গেছে। পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, নূর হোসেনকে শিগগিরই ফেরত আনার ব্যাপারে তাঁরা আশাবাদী। কিন্তু কবে ফেরত আনা যাবে, তা কেউ জানেন না। জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে। আমরা বেশ আশাবাদী।’ ওই ২৬ জনের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া র‌্যাবের সাবেক তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন এবং লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানাও রয়েছেন। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন গতকাল পর্যন্ত নয়জন প্রত্যক্ষদর্শী। সব মিলিয়ে তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করা হলেও আরও তদন্তের প্রয়োজন বোধ করছে পুলিশ। গত ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। এরপর ৩০ এপ্রিল ছয়জনের এবং পরদিন আরও একজনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে দুটি মামলা করা হয়। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব সদস্যদের সঙ্গে নূর হোসেনের কয়েকজন সহযোগীও জড়িত ছিলেন। সাতজনকেই ইনজেকশন দিয়ে হত্যা, গাড়ি থেকে লাশ নৌকায় তোলা এবং ইট বেঁধে তা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার কাজে তাঁরা র‌্যাবকে সহায়তা করেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা ও অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে এ তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া তিন কর্মকর্তা ছাড়াও অপহরণ, খুন ও লাশ গুমের সঙ্গে যুক্ত এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন র‌্যাব-১১-এর আরও ২৩ জন সদস্য। এঁরা হলেন নারায়ণগঞ্জ র‌্যাবে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক (ডিএডি) আবদুস ছালাম শিকদার, নৌবাহিনীর এলএস আবদুস সামাদ, এসআই পলাশ গোলদার, নায়েক নাজিম উদ্দিন, নায়েক আবদুর রাজ্জাক, সিপাই আজম আলী, কনস্টেবল মিজানুর রহমান, এসআই পূর্ণেন্দু বালাম, নায়েক দেলোয়ার হোসেন, নায়েক নাজিম উদ্দিন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, হাবিলদার ইমদাদুল হক, সিপাই আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, সৈনিক আবদুল আলিম, ল্যান্স নায়েক বেলাল, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সি, ডিএডি সালাম শিকদার, করপোরাল মোহাম্মাদ মোখলেস, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, এলএস আবদুস সামাদ, সিপাই আজম আলী ও কনস্টেবল মিজানুর রহমান। এঁদের মধ্যে পরিদর্শক ছালাম শিকদার ও আবদুস সামাদ ছাড়া অন্য সবাইকে এ ঘটনার পর র‌্যাব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এই র‌্যাব সদস্যদের সবাইকে আসামি করা হবে না। কারণ, তাঁদের বেশির ভাগই নিজ বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশ অনুসরণ করেছেন। এঁদের মধ্যে ১৮ জনকে আসামি করা হতে পারে। অন্যদের সাক্ষী করা হবে বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে চারজনের জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, তিন র‌্যাব কর্মকর্তার স্বীকারোক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী, নূর হোসেনের দেহরক্ষী ও ঘনিষ্ঠজনদের স্বীকারোক্তিতে এখন পর্যন্ত ২৬ র‌্যাব সদস্যসহ ৩৮ জনের নাম এসেছে। এই তালিকায় বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী, নারায়ণগঞ্জের পুলিশ-প্রশাসনের কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য আছেন। এই তালিকা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, নূর হোসেনের সাত সহযোগীর মধ্যে আলী মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ চার্চিল নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নূর হোসেনের সঙ্গে তাঁর প্রধান সহযোগী সেলিম কলকাতায় ধরা পড়েছেন। অন্যরা গা ঢাকা দিয়েছেন। পুলিশের হাতে এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য এসেছে, তাতে তাঁরা নিশ্চিত যে নূর হোসেনের পরিকল্পনা ও সহায়তায় র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম এম রানা ও তাঁদের লোকজন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। র‌্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ পুরো ঘটনা তদারকি করেছেন। খুনের সময় শাহজাহান, সানাউল্লাহ সানা, বাশারসহ নূর হোসেনের সাত সহযোগী উপস্থিত ছিলেন। জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সাত খুনের মামলার তদন্তে এ পর্যন্ত যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতির সবটুকু মামলা তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। প্রধান আসামি নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এটি একটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তাই ব্যাপক তদন্ত প্রয়োজন। তবে ব্যাপক তদন্ত কী, তা তিনি বলেননি। জেলা পুলিশ সুপারের কার‌্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এঁদের মধ্যে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা ছাড়াও নূর হোসেনের সহযোগী চার্চিল ও আলী মোহাম্মদ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আর অপহরণ ও খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন নয়জন। এঁরা হলেন পথচারী শহীদুল, তাঁর মেয়ে রাবেয়া আক্তার, শাহীনুল ইসলাম, র‌্যাব সদস্য আবদুস সামাদ, আবদুস সালাম, আবদুর রাজ্জাক, আলী আজম, এএসপি শাহরিয়ার আলম ও নায়েক নাজিমউদ্দিন। তদন্তকারী কর্মকর্তা ও জেলা গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক মামুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, এ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ তাঁদের হাতে এসেছে। বিশেষ করে র‌্যাব-১১-এর সাবেক দুই কর্মকর্তা আরিফ হোসেন ও এম এম রানার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ধরে তদন্ত চালিয়ে খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন তাঁরা। তবে অভিযোগপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা নূর হোসেনের জন্য অপেক্ষা করবেন। জেলা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আরিফ ও রানার জবানবন্দি পূর্ণাঙ্গ ও তথ্যবহুল। এই জবানবন্দির আগে পুলিশ অনেকগুলো বিষয় পর‌্যাপ্ত প্রমাণসহ শনাক্ত করতে পারছিল না। জবানবন্দির পর সেগুলোকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। দুই কর্মকর্তার জবানবন্দি অনুসারে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর সারা দিন তাঁদের গাড়িতে রাখেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। আরিফ প্রথমে এঁদের সবাইকে নরসিংদী ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এঁদের রাখতে অপারগতা জানিয়েছিলেন। এরপর নরসিংদীর শিববািড় এলাকায় রাস্তার পাশে একটি নির্জন স্থানে তাঁদের রাখা হয়। অপহরণকারীরা রাস্তার পাশে বসে দুপুরের খাবারও খান। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তাঁরা এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করেন। এরপর সাতজনকে নিয়ে আসেন কাঁচপুর ব্রিজের নিচে বিআইডব্লিউটিএর একটি ঘাটের কাছে। ওই ঘাটটি নূর হোসেন নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাত ১২টার দিকে ওই ঘাট থেকে সবাইকে নৌকায় তোলা হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে প্রত্যক্ষদর্শী এক সৈনিক জানিয়েছেন, শিবপুর থেকে আনার পথে সাতজনকে বিষাক্ত ইনজেকশন দেওয়া হলে সবাই অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তাঁদের নাক-মুখ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এতে কয়েক মিনিটের মধ্যে সবাই মারা যান। ওই সিপাই জানান, সাতজনের মধ্যে একজন মারা যান প্রায় ২০ মিনিট পরে। অন্যরা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মারা যান। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ওই দিন রাত ১১টা ৫৫ থেকে ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত কাঁচপুর ব্রিজের নিচে ছিলেন মেজর আরিফ। তাঁর মোবাইল ফোনের অবস্থান থেকে তাঁরা এ তথ্য পেয়েছেন। মামলার নথিতে মোবাইল ফোনের কথা বলার বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। র‌্যাবের অন্য দুই কর্মকর্তা আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এক সেনাসদস্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেন, মেজর আরিফ হোসেন অপহরণের পর থেকে নূর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। কাঁচপুর ব্রিজের নিচে আগে থেকে একটি নৌকাসহ তাঁর লোকজন অপেক্ষা করছিলেন। এর আগে নারায়ণগঞ্জের ১ নম্বর ঘাট থেকে র‌্যাবের নৌকাটি সেখানে আনা হয়। এরপর দুটি নৌকায় সাতজনের মৃতদেহ তোলা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন, শুধু জবানবন্দিকেই প্রমাণ হিসেবে না ধরে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর প্রমাণ নিশ্চিত করা হয়েছে; যেন আদালতে আসামিরা জবানবন্দি অস্বীকার করলে বিচারকের কাছে পর‌্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ হাজির করা যায়। এ কারণে তাঁরা র‌্যাব কর্মকর্তাদের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ করেছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন, ওই ঘটনার পর নিহত নজরুলের শ্বশুর শহিদুল ইমলাম এ ঘটনার জন্য ছয় কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার যে দাবি করেছেন, এর কোনো প্রমাণ তাঁরা পাননি। শহিদুল ইসলাম এ নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলতে চান না। তিনি এখন পুলিশ পাহারায় রয়েছেন।

No comments:

Post a Comment