সংসদীয় অভিশংসন প্রথা ফিরিয়ে আনা হলে শুধু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিই নন, নির্বাচন কমিশনের মতো আরও কয়েকটি সাংবিধানিক ও আধা সাংবিধানিক সংস্থার সদস্যদের অপসারণের ক্ষমতাও সংসদের হাতে চলে যাবে। বিচারপতি ছাড়া বাকিরা হলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানসহ সব কমিশনার ও প্রধান তথ্য কমিশনারসহ সব কমিশনার; সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়া
রম্যানসহ সদস্যরা এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক। কারণ, সংবিধানের ১১৮(৫) অনুচ্ছেদ বলছে, যে উপায়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারিত হবেন, ‘সেইরূপ কারণ ও পদ্ধতি ব্যতীত’ কোনো কমিশনার অপসারিত হবেন না। ১২(২) অনুচ্ছেদ একই বাক্য উল্লেখ করে মহাহিসাব নিরীক্ষক এবং ১৩৯(২) অনুচ্ছেদ বলেছে, একই কারণ ও পদ্ধতি ছাড়া ‘সরকারি কর্মকমিশনের কোনো সভাপতি বা অন্য কোনো সদস্য অপসারিত হবেন না।’ অন্য পদধারীদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান-সমূহের জন্য প্রযোজ্য আলাদা আইনেও একই ধরনের বিধান রয়েছে। সরকার সংসদের আসন্ন অধিবেশনে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করলেও আইন না থাকার কারণে তা কবে নাগাদ এবং কীভাবে কার্যকর হবে, সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর অভিশংসন প্রথা সংবিধানে প্রতিস্থাপন করা হয়। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীতে তা বাতিল করে রাষ্ট্রপতির কাছে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। তবে ১৯৭২ থেকে ৭৫ সময়কাল একটা শূন্যতা বিরাজ করেছিল। কারণ, কোনো আইন তৈরি করা হয়নি। তবে আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল মঙ্গলবার এক প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোকে বলেছেন, সংবিধানের প্রস্তাবিত ষোড়শ সংশোধন বিল পাস হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই ‘দ্য জাজেস ইনকোয়ারি অ্যাক্ট, ২০১৪’ সংসদে পাস করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবিত অভিশংসন পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কী ফল বয়ে আনবে, সে বিষয়ে কোনো দৃশ্যমান আলোচনা নেই। তবে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাপকভিত্তিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে তাঁরা ওই আইন প্রণয়ন করতে আগ্রহী। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন, অভিশংসন প্রক্রিয়ায় তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে বিদ্যমান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকলেও সরকার সেটা করতে অনিচ্ছুক। কারণ, এটা বহাল রাখা হলে ‘সংঘাত’ জিইয়ে রাখা হবে। বিশ্বজুড়েই সংসদের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসন প্রক্রিয়ায় তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। দুই ধরনের ব্যবস্থা চালু আছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারায় তদন্তকারী সংস্থার নাম জুডিশিয়ারি কমিটি হলেও তা রাজনীতিবিদদের নিয়েই গঠিত হয়। ১৯৯১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় অভিশংসন প্রক্রিয়া পুরোপুরি রাজনৈতিক। কিন্তু ভারতের অভিশংসন প্রক্রিয়া আধা বিচার বিভাগীয়। বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা অভিশংসন প্রথায় যেতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলনরত দেশগুলোকে উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছে। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা গঠনে তারা কী করবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ অবশ্য ইতিমধ্যে তদন্তের ভার বিচারকদের হাতে রাখার পক্ষেই মত দিয়েছেন। গত সোমবার মন্ত্রিসভায় সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের যে খসড়া অনুমোদিত হয়েছে, তার সঙ্গে ভারতের ১৯৫০ সালের সংবিধানের ১২৪ (৪) অনুচ্ছেদের মিল আছে। ভারত এর আওতায় ১৯৬৮ সালে ‘দ্য জাজেস (ইনকোয়ারি) অ্যাক্ট’ পাস করে। এর বিধান হলো, লোকসভা হলে অন্তত ১০০ সদস্য এবং রাজ্যসভা হলে তার অন্তত ৫০ সদস্যের যৌথ স্বাক্ষরে কারও আচরণ বিষয়ে অপসারণের প্রস্তাব আনা যাবে। প্রাথমিক অনুমোদনের দিনটিতেই স্পিকার তিন সদস্যের জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করবেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারকের মধ্য থেকে একজন এবং হাইকোর্টসমূহের প্রধান বিচারপতিদের মধ্য থেকে একজন এর সদস্য হবেন। আর স্পিকারের স্বীয় বিবেচনায় মনোনীত একজন বিশিষ্ট আইনবিদ এর সভাপতি হবেন। নিয়ম হলো, কাউকে অভিযুক্ত করলে তা দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে পাস হতে হবে। আর অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিলে ওই অভিশংসন প্রস্তাবের মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে জুডিশিয়ারি কমিটির যেকোনো সুপারিশ কংগ্রেস অগ্রাহ্য করতে পারে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রিসভায় ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় তদন্তকারী সংস্থার গঠনপ্রণালি বা কী ধরনের আইন হবে, সে বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শুধু জানিয়ে দিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব আইন করতে হবে।’ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও আছে বলে জানা যায় না। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নকালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, নাকি অভিশংসন প্রথায় বিচারপতিদের অপসারণ করা হবে, তা নিয়ে সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে বিতর্ক হয়েছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রিসভার সদস্য জি ডব্লিউ চৌধুরী কনস্টিটিউশনাল ডেভেলপমেন্ট ইন পাকিস্তান বইয়ে লিখেছেন, রাজনীতিকেরা এখনো অনভিজ্ঞ। তাঁরা বিচারক অপসারণে যোগ্য নন—এমন বিবেচনা ছিল। পরে অবশ্য সংসদীয় অভিশংসন প্রথাই গ্রহণ করে পাকিস্তান। ১৯৬৭ সালে জেনারেল আইউব খান পাকিস্তানের সংবিধানে অভিশংসনের ক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথা চালু করেন। আর ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দিয়ে একই ব্যবস্থা চালু করেন।
No comments:
Post a Comment