গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই নিজেদের জন্য একটি আচরণবিধি বা নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেন। এটা করা সম্ভব হলে গণমাধ্যমের ওপর সরকার যে নীতিমালা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তা এমনিতেই অকার্যকর হয়ে যাবে। সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এমন মত প্রকাশ করেন। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘গণমাধ্যমের সামনে চ্যালেঞ্জ’। এ সময় বেশির ভাগ আলোচকই সম্প্রচার নীতিমালা প্রত্যাখ্যান করেন। সভায় দীর্ঘ আলোচনা
শেষে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘আমরাও এ নীতিমালা প্রত্যাখ্যান করছি। সমালোচনার মুখে এমনিতেই এটা স্তব্ধ হয়ে গেছে। সম্পাদক পরিষদের আগামী সভায় নিজেরাই আচরণবিধি প্রণয়ন করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।’ গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত ওই সভায় প্রায় সব বক্তাই ওই নীতিমালার বিভিন্ন অসংগতি ও অশুভ ইঙ্গিতগুলো তুলে ধরেন। বিশিষ্ট আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘নীতিমালা তৈরির কাজটি খুব দ্রুত করা হলো। যাঁরা সরকারকে এই কাজটি করতে উৎসাহী করেছেন, তাঁরা সরকারের যতখানি বিব্রত ও ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন, আপনারা (সাংবাদিক) চেষ্টা করলেও তা পারতেন না। যাঁরা তড়িঘড়ি করে এই কাজটি করেছেন, তাঁরা সরকারের বন্ধু কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। সরকারের উচিত হবে এটা কারা তৈরি করেছেন, তা অনুসন্ধান করে দেখা এবং তাঁরা সরকারে থাকার যোগ্য কিনা, তাও দেখা।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘তারা কী করল না করল, তা না দেখে আপনারাই একটা নীতিমালা ও কমিশন করুন, এটা সবাই গ্রহণ করবে।’ সভায় প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বিপদের মধ্যে আছি। এর মধ্যে এ সম্প্রচার নীতিমালা আরেকটি নতুন বিপদ। এটাকে আপদও বলা যায়। আশা করব, সম্পাদক পরিষদ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে।’ তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের ওপর যে আক্রমণ আসছে তার একটা কারণ হলো, সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য নেই। এই বিভাজন অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে সম্পাদকেরা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন বলে আশা করব।’ সম্প্রচার নীতিমালাকে অপ্রত্যাশিত উল্লেখ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে তো জরুরি অবস্থা জারি করা হয়নি, সামরিক শাসন জারি হয়নি। তার পরও কেন এই নিষেধাজ্ঞা। এই নীতিমালা অত্যন্ত ভয়ংকর, এটা প্রত্যাখ্যান করা দরকার। বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘এমনিতেই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। নানা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আবার নতুন নিয়ন্ত্রণ দেখছি।’ সবশেষে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম হলো আমাদের ভরসার জায়গা। সেই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ হলে সেই ভরসার জায়গাও নষ্ট হয়ে যাবে।’ প্রারম্ভিক বক্তব্যে সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘আমরা কতগুলো অশুভ ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি। কিছুদিন আগে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে পত্রিকার প্রকাশনা বাতিলের ক্ষমতা ডিসিদের হাতে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পত্রিকা বন্ধের যে ক্ষমতা রহিত করেছিলেন, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইচ্ছা সরকারেরও ছিল। তথ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। কিন্তু পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর পর্দার অন্তরালের এসব কাজ থেমে যায়। তবে পর্দার বাইরে আমরা পেয়েছি সম্প্রচার নীতিমালা। একইভাবে অনলাইনের জন্য নীতিমালা করার প্রয়াস দেখতে পাচ্ছি।’ মাহ্ফুজ আনাম সম্প্রচার নীতিমালার বিভিন্ন বিতর্কিত ও উদ্বেগজনক বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন, এতে সরাসরি ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনোভাবেই দেশবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না বলে উল্লেখ আছে। এ নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই। কিন্তু ‘দেশবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী’ বিষয়টি কে নির্ণয় করবে? নীতিমালা অনুযায়ী আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে কোনো প্রকার বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য-উপাত্ত দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, এগুলো তো হচ্ছেই। যদি কখনো অনিচ্ছাকৃত কোনো ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়, তবে তা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করা হয় এবং ক্ষমাও চাওয়া হয়। এটাই রীতি। তার পরও অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হলো কেন? এমন আরও কয়েকটি ধারার কথা উল্লেখ করে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, এগুলো গণমাধ্যমকে সংকুচিত করার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এর ফলে সম্প্রচার মাধ্যমগুলো ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবে। লিখিত বক্তব্যে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘আমরাও সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে নই। তবে আমরা এমন আইন চাই, যা স্বাধীনতাকে লালন করবে এবং গণমাধ্যমকে একটি শক্তিশালী শিল্প খাত হিসেবে গড়ে তুলবে, যেখানে একটি নৈতিক ও স্বাধীন গণমাধ্যম সর্বোচ্চ নৈতিকতা বজায় রেখে সর্বোচ্চ সেবা দিতে সক্ষম হয়। আমরা মনে করি, এ রকম একটি আইন তৈরি করতে প্রথমেই একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করা উচিত।’ অ্যাসোসিয়েশন অব টিভি চ্যানেল ওনার্সের (অ্যাটকো) সাধারণ সম্পাদক শাইখ সিরাজ বলেন, ‘সম্পূর্ণ খসড়াটি মন্ত্রিসভায় যাওয়ার আগে আমাদের দেখানো হয়নি। একধরনের পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, যোগ্য ব্যক্তিকে লাইসেন্স দেওয়া হলে নীতিমালার প্রশ্নই আসত না। ‘আমাদের হাত-পা বেঁধে পানিতে সাঁতার কাটার অবস্থা’—এমন মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, গণমাধ্যমের নিজস্ব নীতিমালা থাকা উচিত। তবে যেহেতু সরকার সুযোগ পেয়েছে, এ জন্য একটা নীতিমালা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু নীতিমালা চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে গেজেট প্রকাশের পর আলোচনা হচ্ছে। এটাই গণতন্ত্রের সার্থকতা। কেউবা প্রত্যাখ্যান করছেন। তবে আমি আশাবাদী মানুষ। আমি সম্প্রচার নীতিমালাকে ধরে এগোতে চাই।’ বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি ও নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, অনেকে রাজনৈতিক কারণে এবং কেউ কেউ না জেনে সস্প্রচার নীতিমালার সমালোচনা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চারটি কারণে নীতিমালা দাবি করেছিলাম। কিন্তু খসড়ায় দাবি পূরণ হয়নি। কিছু উদ্বেগ আছে। সপ্তম অধ্যায় আমাদের না জানিয়ে যোগ করা হয়েছে। নীতিমালায় অসংখ্য “না” রয়েছে।’ স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন দাবি করে মনজুরুল আহসান বলেন, এটা চূড়ান্ত করার সময় সবাই যুক্ত হলে ভালো কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু কমিশনে পদাধিকারবলে কাউকে দেখতে চাই না। কমিশনে থাকবেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব বা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষক। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের আরেকাংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ গণমাধ্যমের এগিয়ে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে বলেন, নীতিমালা ছাড়াই গণমাধ্যম যদি এত দূর এগোতে পারে, তাহলে এটা করে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হচ্ছে কেন। এই নীতিমালা বাতিল করে গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে নীতিমালা করতে হবে এবং স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন করতে হবে। নীতিমালার সমালোচনাকারীদের ‘স্বৈরাচারের দালাল’ বলে তথ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানান তিনি। মূল আলোচনার পর সভায় উপস্থিত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিরা গণমাধ্যম বিষয়ে তাঁদের সংক্ষিপ্ত মত তুলে ধরেন। নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটাকে নীতিমালা না বলে যাঁরা ‘ভীতিমালা’ বলছেন, তাঁরা বুঝেশুনেই তা বলছেন। সরকার তার অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য নীতিমালার নামে যা করেছে, তা প্রাক-নিষেধাজ্ঞার (প্রি-সেন্সরশিপ) আলামত। এর ফলে নিজেদের মধ্যেই নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রবণতা (সেলফ সেন্সরশিপ) বাড়বে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ সম্প্রচার নীতিমালা বাতিল করার দাবি জানিয়ে বলেন, গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট সর্বজনশ্রদ্ধেয়দের নিয়ে এই নীতিমালা হতে পারে এবং এটাই যৌক্তিক। মাছারাঙা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মুনয়েম বলেন, এমনিতেই গণমাধ্যম অনেকভাবে, অনেকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রচলিত আইনে সব সমস্যার সমাধান থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর পরও কেন বলা হচ্ছে এটা করা যাবে বা যাবে না। নীতিমালাটি অতি উৎসাহে ভরপুর—এমন মন্তব্য করে একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল বাবু বলেন, তিনি যেকোনো নীতি প্রণয়ন ও লাইসেন্স দেওয়ার বিপক্ষে। তাঁর মতে, যাঁর টাকা আছে তিনি পত্রিকা বের করবেন, টেলিভিশন চ্যানেল করবেন। এরপর দর্শক বা পাঠক যেটা গ্রহণ করবে, সেটি টিকে থাকবে, বাকিগুলো এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য এই নীতিমালা করা হয়েছে। কণ্ঠরোধ করা এর লক্ষ্য নয়। আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সীমা কতটুকু, সেটিও বিতর্কের মাধ্যমে নির্ধারণ করা দরকার। এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ জ ই মামুন বলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য এ দেশে কোনো আইন হয়নি। যত আইন বা নীতি হয়েছে তা স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার জন্য। তিনি সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ সংশোধনের দাবি জানান। এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ মুন্নী সাহা বলেন, যেনতেনভাবে সরকার এই নীতিমালা করায় এটা নিয়ে এমন আলোচনা সভা করতে হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে সর্বত্রই যেখানে বিভক্তি, এমনকি সাংবাদিক নেতাদের মধ্যেও, তখন এই আলোচনা ইতিবাচক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গণমাধ্যম দেশের মানুষের জন্য কাজ করে। তাই এই নীতিমালা প্রতিটি মানুষের জন্য। এটি প্রণয়নে কপটতার আশ্রয় নেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা যা বলেছিলাম বা দেখেছিলাম, চূড়ান্ত করার সময় তাতে সূক্ষ্ম পরিবর্তন করা হয়েছে। গণমাধ্যমকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতেই এসব করা হয়েছে।’ নীতিমালাটি তথ্য অধিকার আইনসহ বেশ কিছু আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেন তিনি। সভা সঞ্চালনা করেন দৈনিকভোরের কাগজ-এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত। সভায় উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার নিউমারারি অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান, বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রমুখ।
No comments:
Post a Comment