Saturday, September 20, 2014

আ. লীগের নতুন-পুরনো ৮০ এমপির দ্বন্দ্ব চরমে:কালের কন্ঠ

নাটোর-২ আসনের সাবেক এমপি আহাদ আলী সরকার আর বর্তমান এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল। দুজনই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা হলেও শিমুলের দাপটে রাজনীতি থেকে প্রায় নির্বাসিত হয়ে পড়েছেন আহাদ আলী সরকার। এখানে শিমুলই সর্বেসর্বা। দুই পক্ষে সামান্য উত্তেজনা দেখা দিলেই সাবেক এমপি নিজেকে গুটিয়ে নেন বলে এ এলাকায় সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে না। তবে দুজনের সম্পর্ক মোটেও ভালো না বলে জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগেরই দায়িত্বশীল এক
নেতা। সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের অবস্থা উল্টো। সেখানে সাবেক এমপি আবদুল লতিফ বিশ্বাসের কাছে একেবারেই কোণঠাসা বর্তমান এমপি মজিদ মণ্ডল। লতিফ বিশ্বাসের আধিপত্য এখানে এতটাই যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও নির্বাচনী প্রচারণায় লতিফ বিশ্বাসের দলবলের কাছে মজিদ মণ্ডলকে বাধা পেতে হয়েছে বারবার। গত রমজানের শেষ সপ্তাহে জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় লতিফ বিশ্বাস প্রকাশ্যেই মজিদ মণ্ডলের প্রতি বিষোদ্গার করে বলেন, আন্দোলনে বিএনপি নামলে এখানে লতিফ বিশ্বাস ছাড়া কে প্রতিহত করে তা দেখা যাবে। ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনের সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন আহমেদ আর বর্তমান এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল। দুজনের মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব-কোন্দলের কথা জানিয়েছেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিন সরকার। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, আধিপত্য বিস্তার নিয়েই দুজনের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব। কেউ কারো ছায়া পর্যন্ত মাড়ান না। দলাদলি এমন পর্যায়ে যে একজনের সমর্থকদের কাছে আরেকজনের সমর্থকরা নিরাপদ নয়। আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াইয়ে সংগঠনের ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে মতিন সরকার বলেন, ‘অনেকবার চেষ্টা করেছি দুজনকে মেলানোর। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেন না।’ নতুন ও পুরনো এমপির মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব-বিরোধ দেশের সব নির্বাচনী এলাকায় কমবেশি থাকলেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০টি জেলার নতুন-পুরনো মিলিয়ে প্রায় ৮০ জন এমপির মধ্যে এ দ্বন্দ্ব ঘোরতর। এসব দ্বন্দ্বের মূল কারণ এলাকার আধিপত্য ধরে রাখা। আরো কারণের মধ্যে জানা গেছে, নতুন এমপি পুরনো জনকে ব্যর্থ দেখিয়ে চাইছেন ভবিষ্যতেও নিজের প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে। আবার পুরনো এমপি চাইছেন নতুন এমপিকে ব্যর্থ প্রমাণ করে নিজের প্রার্থিতা ফিরে পেতে। এসব কারণে নিজ নিজ এলাকায় দলীয় কর্মসূচি পালনেও বর্তমান ও সাবেক এমপিদের পাল্টাপাল্টি অবস্থান প্রায়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোথাও নতুন এমপি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন, কোথাও বা পুরনোরাই আধিপত্য ধরে রেখেছেন। মাঠের নেতাদের মতে, এটি দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার অন্যতম কারণও। তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের মত ভিন্ন। দ্বন্দ্বকে তাঁরা দেখছেন প্রতিযোগিতা হিসেবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক জেলা থেকে আমাদের কাছে তথ্য আসে যে অমুক এমপির সঙ্গে তমুক এমপির বিরোধ আছে। এটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা মাত্র।’ একই কথা বলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহও। অথচ ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান বলেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের বর্তমান এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার ও সাবেক এমপি আব্দুল মান্নানের মধ্যে কোনো রকম সদ্ভাব নেই। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তাঁদের পাওয়া তো যায়ই না, তবে বিরোধিতা থাকে চরমে। তিনি বলেন, দুজনই আলাদা গ্রুপ নিয়ে চলেন। কখনো কখনো এই গ্রুপগুলো মারমুখী অবস্থানে চলে যায়। ঝিনাইদহ-৩ আসনের সাবেক এমপি শফিকুল আজম খান চঞ্চল ও বর্তমান এমপি নবী নেওয়াজ সম্পর্কেও একই অভিযোগ করেন আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হওয়ায় জামায়াত অধ্যুষিত মহেশপুর-কোটচাঁদপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগ আরো দুর্বল হতে চলেছে। দলীয় কোনো কর্মসূচিতে তাদের এক করা যায়নি। জানতে চাইলে শফিকুল আজম খান চঞ্চল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এলাকায় আমি শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে রাজনীতি করে আসছি। তার পরও বর্তমান এমপি আমাকে প্রতিপক্ষ ভাবছেন। এলাকায় খোঁজখবর নিলেই এর সত্যতা জানতে পারবেন।’ অন্যদিকে বর্তমান সংসদ সদস্য নবী নেওয়াজ খান বলেন, ‘এলাকার কেউই আমার বিপক্ষে নেই। শুধু সাবেক এমপি ও মহেশপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আজম চঞ্চল আমাকে তাঁর প্রতিপক্ষ ভাবছেন।’ সাবেক এমপির সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি ‘না’ জবাব দেন। যশোর জেলার সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মতে, সাবেক আর বর্তমান এমপিদের মধ্যে সমন্বয় সাধন বা যোগাযোগ স্থাপন করে চলা- এটা শুধু যশোরে নয়, বাংলাদেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কোথাও প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে, কোথাও গোপনে চলছে- এই যা। তবে যশোরে সাবেক আর বর্তমান এমপিদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যেই চলছে দাবি করে তিনি বলেন, গতবারের এমপিরা এবার বাদ পড়ার কারণে দলীয় কর্মকাণ্ডে আসেন না। নতুন-পুরনোতে যোগাযোগ না থাকা সংগঠনের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন তিনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক মঈনুদ্দিন মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১-এর সাবেক ও বর্তমান এমপি যথাক্রমে এনামুল হক ও গোলাম রব্বানীর কোনো কর্মকাণ্ডই সংগঠনের জন্য উপকারী নয়। এর মূল কারণ একে অন্যকে প্রতিপক্ষ মনে করা। দুজনই থাকেন ঢাকায়। তাঁদের মধ্যে নানা বিষয়ে দ্বন্দ্বের অভিযোগ শুনতে পাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের অবস্থা আরো গুরুতর জানিয়ে মঈনুদ্দিন বলেন, এখানে সাবেক এমপি জিয়াউর রহমান আর বর্তমান এমপি গোলাম মোস্তফার দ্বন্দ্বের কারণে আওয়ামী লীগের কার্যালয় দুটি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নতুনরা চান পুরনোদের ব্যর্থ প্রমাণ করে নিজের আসন পাকাপোক্ত রাখতে, আর পুরনোরা চান নতুনদের ব্যর্থ করে আগামী নির্বাচনে অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে। দশম সংসদ নির্বাচনের পর আট মাসে নতুন ও পুরনো এমপি কারো সঙ্গে কারো যোগাযোগ পর্যন্ত হয় না; সশরীরে তো নয়ই, ফোনেও যোগাযোগ রক্ষা করেন না তাঁরা। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম ও বর্তমান এমপি তানভীর ইমাম। বর্তমান এমপি প্রভাবশালী এক নেতার ছেলে হওয়ায় তাঁর কাছে কোণঠাসা সাবেক এমপি। শুধু তাই নয়, বর্তমান এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর উল্লাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাবেক এমপি। পরে তাঁকে সে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সাবেক এমপি চয়ন ইসলাম বর্তমান এমপি হাসিবুর রহমান খান স্বপনের প্রভাবের কাছে একেবারে কোণঠাসা। সিরাজগঞ্জ-৫-এর সাবেক সংসদ আবদুল লতিফ বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এলাকার মানুষের জন্য রাজনীতি করি। এলাকার মানুষ আমাকে চায়।’ তবে লতিফ বিশ্বাসের প্রতি ইঙ্গিত করে বর্তমান সংসদ সদস্য মজিদ মণ্ডল বলেন, ‘এমপি হওয়ার পর থেকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে রাজনীতি করে যাচ্ছি।’ মেহেরপুর-১ আসনের সাবেক এমপি জয়নাল আবেদীন আর বর্তমান এমপি ফরহাদ হোসেন দোদুল। গত ৩১ আগস্ট জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আয়োজিত জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মিয়াজান আলী এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি জয়নাল আবেদীন অভিযোগ করেন, মেহেরপুর-১ (সদর) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন দোদুল অরাজনৈতিক ব্যক্তি। এ জন্য এখানে দলের অবস্থা দিন দিন নাজুক হচ্ছে। সাবেক এমপি বলেন, অরাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়ার কারণেই জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের মতো কর্মসূচিতেও এমপি যোগ দেননি। বর্তমান এমপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, টেন্ডারবাজি, হাট-ঘাট-বাজার দখল ও ইজারা নিয়ে মেতে আছেন এমপির ভগ্নিপতি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুস সামাদ বিশ্বাস। যশোর-২ আসনের সাবেক এমপি মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ ও বর্তমান এমপি মনিরুল ইসলামের মধ্যেও এ দ্বন্দ্ব আছে, তবে একেবারেই ভেতরে ভেতরে। যশোর-৩-এর সাবেক এমপি খালেদুর রহমান টিটো ও বতর্মান এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। জানা গেছে, দ্বন্দ্বের কারণে বর্তমান এমপিকে কোনো সহযোগিতাই করেন না সাবেক এমপি। এ ধরনের দ্বন্দ্ব আরো যেসব আসনে রয়েছে বলে জানা গেছে সেগুলো হলো মেহেরপুর-২-এর সাবেক এমপি আমজাদ হোসেন ও বতর্মান এমপি আব্দুল খালেক; নড়াইল-২-এর সাবেক এমপি এস কে আবু বাকের ও বর্তমান এমপি এস এম আসিফুর রহমান; খুলনা-১-এর সাবেক এমপি ননী গোপাল মণ্ডল ও বর্তমান এমপি পঞ্চানন বিশ্বাস; খুলনা-৬-এর সাবেক এমপি সোহরাব আলী সানা ও বর্তমান এমপি শেখ মো. নুরুল হক; পিরোজপুর-২-এর সাবেক এমপি শাহ আলম ও বর্তমান এমপি ইসহাক আলী খান পান্না; ময়মনসিংহ-২-এর সাবেক এমপি হায়াতুর রহমান খান ও বর্তমান এমপি শরীফ আহমেদ; নেত্রকোনা-১-এর সাবেক এমপি মোশতাক আহমেদ রূহী ও বর্তমান এমপি ছবি বিশ্বাস; নেত্রকোনা-২-এর সাবেক এমপি আশরাফ আলী খান খসরু ও বর্তমান এমপি আরিফ খান জয়; নেত্রকোনা-৩-এর সাবেক এমপি মঞ্জুর কাদের কোরাইশী ও বর্তমান এমপি ইফতিখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টুর মধ্যে। এ ছাড়া পার্বত্য খাগড়াছড়ির সাবেক এমপি যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরা ও বর্তমান এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা; ঢাকা-১৯-এর সাবেক এমপি তালুকদার মো. মুরাদ জং ও বর্তমান এমপি ডা. মো. এনামুর রহমান; নারায়ণগঞ্জ-৩-এর সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল কায়সার ও বর্তমান এমপি মো. মোশাররফ হোসেন; ফেনী-২-এর সাবেক এমপি জয়নাল হাজারী ও বর্তমান এমপি নিজামউদ্দিন হাজারীর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট বলে জানা গেছে।

No comments:

Post a Comment