Friday, December 19, 2014

দেশি ব্যাংকে বেশি সুদ ব্যবসায়ীরা বিদেশমুখী:কালের কন্ঠ

উচ্চ সুদে পোড় খাওয়া ব্যবসায়ীদের অনেকেই ঋণের জন্য দেশ ছেড়ে বাইরে যাচ্ছেন। কম সুদে বিদেশের ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিচ্ছেন তাঁরা। বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে কেবল ব্যবসা সম্
প্রসারণ বা মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিই নয়, সস্তা সুদের ঋণ এনে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে থাকা চড়া সুদের ঋণ সুদাসলসহ এককালীন পরিশোধও করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। তবু সুদের হার কমাচ্ছে না দেশের ব্যাংকগুলো। আর ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার বদলে বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের জামিনদার হচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলো। অথচ দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে বর্তমানে ২৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রদানযোগ্য তহবিল পড়ে রয়েছে। ঋণগ্রহীতা না পেয়ে চড়া সুদে নেওয়া আমানতের অর্থ অলস ফেলে রাখতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশের ২০৩টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে ৫৫৩ কোটি ৬২ লাখ ডলার ঋণ নিয়েছে, টাকার অঙ্কে যা ৪৩ হাজার কোটিরও বেশি। বিদেশ থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ও কারখানা সম্প্রসারণ করতে এসব ঋণ ব্যবহার করা হয়েছে। বিদেশের ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ীদের নেওয়া এই ঋণ দেশের মোট জিডিপির ১.৪৯ শতাংশ। এসব ঋণের গড় সুদের হার (লন্ডন আন্তঃব্যাংক সুদহার +৩) ৪.৫ শতাংশ। আর বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদের হার ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ। এ ছাড়া আর্থিক সক্ষমতার অভাবের কারণে স্থানীয় ব্যাংকগুলো বড় বড় প্রকল্পে ঋণ দিতে পারে না। এ দুটি কারণেই দেশি ব্যবসায়ীরা বিদেশি ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়ছেন বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহার সহনীয় হলে ব্যবসায়ীদের বিদেশি ব্যাংকের কাছে ভিড়তে হতো না। কারণ, বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া এই ঋণের ঝুঁকিও কম নয়। মূলত ঋণ পরিশোধকালে টাকার তুলনায় ডলারের মান শক্তিশালী হলে তখন ঋণগ্রহীতার ব্যয় বেড়ে যাবে। অর্থাৎ, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হলেও ডলারের মূল্যমানে তা টাকায় রূপান্তর করেন ব্যবসায়ীরা। ঋণ পরিশোধের সময় টাকার তুলনায় ডলারের দাম বেড়ে গেলে তখন ডলারের হিসাবে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে না হলেও টাকার অঙ্কে তা বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংক আর বিদেশি উৎসের সুদের হারে ‘আকাশ-পাতাল’ ফারাক থাকার কারণে বিদেশের দিকেই ঝুঁকছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, স্বল্প সুদের বিদেশি ঋণ থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে নিজেদের ‘সুদ-মুনাফায়’ বড় মাপের কাঁচি ধরতে হবে স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে। ঋণের সুদের হার কমিয়ে নামিয়ে আনতে হবে এক অঙ্কের ঘরে। না হলে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে স্থানীয় ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণ ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে, সেটার সদ্ব্যবহার করতে হবে সবার আগে। দেশে ছোট ছোট অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাঁদের পুঁজি কম। তাঁদের সহযোগিতা করতে হবে। এ জন্য কিভাবে ঋণের সুদের হার একটু নমনীয় করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ব্যাংকগুলো চাইলে অনেকভাবে ঋণের সুদের হার কমাতে পারে। খেলাপি ঋণ সুদের হার বাড়ার একটি কারণ। তা ছাড়া শাখার সাজসজ্জায় উচ্চহারে ব্যয় করে ব্যাংক। এগুলো কমাতে পারলে অনায়াসে ১০ থেকে ১১ শতাংশে নেমে আসবে সুদের হার। উচ্চ সুদের কারণে ব্যবসায়ীরা যে কেবল বিদেশমুখীই হচ্ছেন, তা নয়; অনেকে আবার ব্যাংক থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকছেন। ফলে স্থানীয় ব্যাংকগুলো তাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ধরা হয়েছে ১৬.৫ শতাংশ। তবে অক্টোবর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি এর থেকে অনেক নিচে রয়েছে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৪৭ শতাংশ। তবে গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবরে এ খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১২.১২ শতাংশ। দেশের ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদহারে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার দ্বার উন্মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন স্তরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এ অবস্থার মধ্যেই শেয়ারবাজার পতনের পর দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট মারাত্মক রূপ ধারণ করে। ওই সময় ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার সামর্থ্য হারায় বেশির ভাগ ব্যাংক। ওই প্রেক্ষিতে বিদেশি ঋণের দ্বার বেশ খানিকটা খুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৯ সালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি উৎস থেকে ৪১ কোটি ২৬ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৩০ কোটি ২৭ লাখ, ২০১১ সালে ৯৩ কোটি ৬৩ লাখ, ২০১২ সালে ১৫৭ কোটি ৯৫ লাখ ডলার ঋণ নিয়েছে। তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ২০১৩ সালে বিদেশি ঋণ আগের বছরগুলোর মতো বাড়েনি। সে বছর হয়েছে ১৫৫ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১১ সালে ২০টি বেসরকারি কম্পানি, ২০১২ সালে ৮১টি কম্পানি ও ২০১৩ সালে ১১৬টি কম্পানি বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। এ ছাড়া বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় ৩২০ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। যেসব কম্পানি বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে, তাদের ওপর জরিপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তৈরি পোশাক, ফুটওয়্যার, নিটওয়্যার, কৃষি পণ্য, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, শিপিং, বিদ্যুৎ, ওষুধ, সিমেন্ট ও স্টিল খাতসহ মোট ১৩টি কম্পানির ওপর জরিপ করে দেখা গেছে, তারা ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৮৯ কোটি ২৪ লাখ ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণের বেশির ভাগই মূলত বিদেশ থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ও কারখানা সম্প্রসারণে ব্যয় হয়েছে। একটি কম্পানি বাদে অন্যরা সবাই উৎপাদনশীল খাতে ঋণের অর্থ ব্যয় করেছে। একটি কম্পানি বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণের অর্থে বাংলাদেশের ব্যাংকে থাকা ঋণ পরিশোধ করেছে, অন্য এক কম্পানি এলসি মূল্য পরিশোধ করেছে। এ ছাড়া একটি কম্পানি ঋণের টাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য জমি কিনেছে। তবে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের চর্চা ভবিষ্যত বাংলাদেশকে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এ ক্ষেত্রে দেশের বাজারে প্রতিযোগিতা কিছুটা বাড়লেও সেটা উদ্বেগজনক পর্যায়ের নয়। তাছাড়া এ প্রতিযোগিতা কমিয়ে আনতে স্থানীয় ব্যাংকগুলোকেই ঋণের সুদের হার কমাতে হবে বলেও মনে করেন তাঁরা। আর এটা শুরুও হয়েছে, তবে খুবই মন্থর গতিতে। দি সিটি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন বলেন, বিদেশি ঋণের কিছু প্রভাব তো আছেই। তবে ভবিষ্যতে বিদেশি ঋণ আসা খুব একটা বাড়বে না। এখন দেশের ব্যাংকগুলোর সুদের হার কমে এসেছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও অনেক বেশি রয়েছে। ব্যাংকের তারল্য অবস্থা ভালো। সরকারকে ঋণ দিতে হচ্ছে কম। তিনি আরো বলেন, ২০১৩ সালে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় উৎপাদন যখন থেমে গিয়েছিল তখন অনেকেই কম সুদে ঋণ নেওয়ার জন্য বিদেশি উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ওই সময় জ্বালানি ও তৈরি পোশাক খাতে বেশ কিছু বিদেশি ঋণ আসে। এখন দেশের ব্যাংকগুলোও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার কমিয়েছে। তাই ভবিষ্যতে বিদেশি ঋণ বাড়ার আশঙ্কা নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ এক গবেষক কালের কণ্ঠকে বলেন, সবাই তো বিদেশি ঋণ পাচ্ছে না; কিছু উৎপাদক প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে। সস্তায় পাচ্ছে বলেই তারা তা নিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ‘বিদেশি ব্যাংক ঋণের সুদের হার অনেক কম। ফলে প্রতিযোগিতাটা একটু কঠিন হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদারকি করা হচ্ছে। স্থানীয় ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া বিদেশি ঋণ যাতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ ফেলতে না পারে, সে দিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। ঝুঁকির কোনো কিছু এখনো দেখা যায়নি।’

No comments:

Post a Comment