
ল মালবাহী একটি কাভার্ড ভ্যান। পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যাচ্ছিল সেটি। কিন্তু ট্রেন দেখেও চালক গতি নিয়ন্ত্রণ করেননি। ফলে সেটি সরাসরি গিয়ে সজোরে আঘাত করে ট্রেনের ইঞ্জিনে। ইঞ্জিন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সঙ্গে লাগানো বগিটি লাইনচ্যুত হয়ে কাত হয়ে যায়। কাভার্ড ভ্যানটিও দুমড়েমুচড়ে যায়। সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই দুজন নিহত হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যায় আরো চারজন। এর মধ্যে এক নারীও রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ট্রেনের যাত্রী। গতকাল সোমবার দুপুরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহত আটজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত। এটি অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক ঘটনা। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট।’ মন্ত্রী বলেন, ঘটনার জন্য রেল নয়, কাভার্ড ভ্যানের চালক দায়ী বলে মনে হচ্ছে। লরির চালক হয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন, নয়তো তাঁর গাফিলতি ছিল। জায়গাটি রেলস্টেশনের ভেতরে হওয়ায় এখানে কোনো ক্রসিং নেই। ঘটনা তদন্তে রেল কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। রেলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাজমুল হাসানকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে। বাকিরা হলেন বিভাগীয় প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আরিফ ও সাদেকুর রহমান (ডিভিশনাল মেকানিক্যাল ইঞ্জিয়ার)। কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি আবদুল মজিদ দাবি করেন, কাভার্ড ভ্যানের চালকের আসনে ছিলেন চালকের সহকারী (হেলপার)। এ কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় রেলওয়ের সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুল মতিন মণ্ডল বাদী হয়ে গতকাল বিকেলে কমলাপুর জিআরপি থানায় কাভার্ড ভ্যানের চালকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে প্রাণহানি ও সরকারি সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। গতকাল রাত পর্যন্ত কাভার্ড ভ্যানের চালকের সন্ধান মেলেনি। দুর্ঘটনার পর প্রায় তিন ঘণ্টা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সহযোগিতায় লাইনচ্যুত বগিসহ ট্রেন এবং দুমড়ে যাওয়া লরি সরিয়ে নেওয়া হলে রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়। পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলো নাইম সিকদার (১৬), মুজিবুর রহমান (৪৮) ও আলমগীর হোসেন (৩৫)। নাইম রাজধানীর মুগদা এলাকার একটি মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্র। তার বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ, বাবার নাম ইউনুস আলী। নাইমের খালাতো ভাই মাহফুজুর রহমান গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে মরদেহ শনাক্ত করেন। পেশায় ব্যবসায়ী মুজিবুর রাজধানীর মিরপুরে শিয়ালবাড়ী এলাকায় থাকতেন। গতকাল ভোরে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন, ফেরার সময় ওই দুর্ঘটনায় পড়েন। হাসপাতালে মুজিবুরের লাশ শনাক্ত করেন তাঁর স্ত্রী সখিনা বেগম। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান আলমগীর। তবে তাঁর বিস্তারিত পরিচয় মেলেনি। নিহত অন্যদের মধ্যে এক নারী ও দুজন পুরুষ রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্যে কাভার্ড ভ্যানের চালকও রয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে হতাহতদের খোঁজ নিতে হাসপাতালে যান রেলমন্ত্রী। তিনি আহত ব্যক্তিদের ২০ হাজার টাকা করে চিকিৎসা খরচ দেওয়ার ঘোষণা দেন। পরে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেই টাকা দেওয়া হয়। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণও দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন রেলমন্ত্রী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ট্রেনটি যখন কমলাপুর স্টেশনের আগে কনটেইনার ডিপোতে ঢোকে, কাভার্ড ভ্যানটি তখন পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যাচ্ছিল। ট্রেন দেখার পর কাভার্ড ভ্যানের চালক না থেমে সামনে এগিয়ে যান। প্রথমে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কা লাগে ট্রেনের ইঞ্জিনের সঙ্গে। তারপর কাভার্ড ভ্যানটি ঘুরে আঘাত করে ইঞ্জিনের ঠিক পেছনের বগিতে। তাতে বগিটি আংশিক লাইনচ্যুত হয় এবং যাত্রীরা অনেকে আহত হয়। ততক্ষণে অবশ্য ট্রেনটি কাভার্ড ভ্যানটি টেনে নিয়ে যায় ৪০-৫০ গজ। এরপর ট্রেন থামলে শুরু হয় উদ্ধারকাজ। দুর্ঘটনায় অন্তত ২০-২৫ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে গুরুতর ব্যক্তিদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় ঘটনাস্থলেই দুজনের লাশ পাওয়া যায়। আহতদের অনেকেই ট্রেনের ছাদের যাত্রী ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল রাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আট জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। রেলওয়ে রেঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন জানান, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের আইসিডি টার্মিনাল থেকে লরি হিসেবে ব্যবহৃত কাভার্ড ভ্যানটি আরেকটি টার্মিনালে যাচ্ছিল। এ দুটি টার্মিনালের মধ্যে রেলপথ আছে। একটি টার্মিনাল থেকে অন্যটিতে যেতে হলে এ পথ পাড়ি দিতে হয়। এ সময়ই ঘটেছে দুর্ঘটনা। এতে ওই রেললাইনের পাশাপাশি আরেকটি রেললাইনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইসিডি পরিদর্শক ফজলুল হক চৌধুরী জানান, অন্য ক্রসিংয়ের মতো না হলেও এখানে ট্রেন চলাচলের সময় ঘণ্টা বাজানো হয়, জ্বলে থাকে লাল বাতি। পাশাপাশি টার্মিনাল গেটে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্যরা সংকেত দেন। তাঁরাই লরি ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। ঘটনার সময় হান্নান ও মিজান নামের দুজন আনসার দায়িত্বে ছিলেন। তাঁরা সিগন্যাল দিলেও লরি চালক তা মানেননি। কনটেইনার ডিপোতে দায়িত্ব পালনরত আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাভার্ড ভ্যানটি থামানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মীদের ইশারা অমান্য করে কাভার্ড ভ্যানচালক ট্রেনের সামনে দিয়ে ক্রসিং পার হওয়ার চেষ্টা করেন। তাতেই ঘটে দুর্ঘটনা। কাত হয়ে যাওয়া বগিটিতে শতাধিক যাত্রী ছিল। ওই ট্রেনের যাত্রী ছিলেন জাকির হোসেন। তাঁর ভাষ্য মতে, ‘হঠাৎ যাত্রীদের মধ্যে হৈচৈ শুনে ভড়কে যাই, প্রচণ্ড শব্দ হয়। এর পরই ট্রেনটি কেঁপে ওঠে। চলন্ত ট্রেন থেকে নিচে লাফ দিই, প্রাণে বেঁচে যাই। তবে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পেয়েছি।’ গতকাল কমলাপুর স্টেশনে কথা হয় ওই ট্রেনের যাত্রী আছিয়া বেগমের সঙ্গে। দুর্ঘটনায় সামান্য আহত হয়েছেন তিনি। বললেন, ‘ইঞ্জিনের পেছনের বগিতে ছিলাম আমি, ট্রেনে ভিড় আছিল। মানুষ চিৎকার করতাছিল। এরপর ট্রেনটি কাঁপুনি দেয়। আর কিছু কইতে পারুম না।’ ট্রেন-ট্রাক সংঘর্ষ : ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় ট্রেন ও ট্রাকের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে ট্রাকচালকের সহকারী আহত হয়েছেন। গত রবিবার রাত ২টার দিকে আখাউড়া পৌর এলাকার রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনের লেভেলক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আখাউড়া রেলওয়ে থানার ওসি ইয়াছিন ফারুক কালের কণ্ঠকে জানান, সিলেট থেকে আখাউড়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসা কুশিয়ারা এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে ট্রাকটির সংঘর্ষ হয়। পাথরবাহী ট্রাকটি লেভেলক্রসিং পার হচ্ছিল। ঘন কুয়াশার কারণে ট্রাকচালক হয়তো ট্রেনটি দেখতে পাননি। ট্রেনের ধাক্কায় ট্রাক কাত হয়ে যায়। রেকারের মাধ্যমে ভোর ৫টায় সেটিকে সরানো হয়। তবে বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
No comments:
Post a Comment