Monday, December 15, 2014

কারওয়ানবাজার রেললাইন মাদকের প্রকাশ্য হাট:নয়াদিগন্ত

দুপুর ১২টা। কারওয়ানবাজার চালের আড়তের পেছনের রেললাইন। হুইসেল বাজিয়ে কমলাপুরের দিকে ছুটে যাচ্ছে একটি ট্রেন। হুইসেল শুনতেই হুড়াহুড়ি শুরু হলো রেললাইনের দুই পাশের বস্তির মানুষদের। কয়েক সেকেন্ড পর ট্রেন চলে গেলেই যে যার মতো। ঠিক সে সময় রেললাইন দিয়ে হাঁটতেই ৩০-৩৫ বছরের এক ব্যক্তি সামনে হাজির। নিজের মোবাইল চাপাচাপির ছলে জানতে চাইল ‘মামা ছোট না বড়। কয়টা লাগবো।’ এর পরের দৃশ্য দেখে চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। 
রেলওয়ে বস্তির দুই পাশে খুপরিঘরের সামনে গাঁজার ডালা সাজিয়ে বসেছে নানা বয়সের নারী-পুরুষ। আগে রাতে মাদকের জমজমাট বাজার বসলেও এখন দিনদুপুরে বসছে ভয়ঙ্কর মাদকের প্রকাশ্য হাট। প্রকাশ্যে গাঁজার ডালি সাজিয়ে বসলেও ক্রেতারা চাইলে ইয়াবা, ফেনসিডিল ভেতর থেকে এনে দেয়া হয়। কিছু দূরে টহল পুলিশ দেখলেও তারা কেয়ার করছে না। উল্টো বলছে, পুলিশ আমাদের ধরবে আপনার সমস্যা কী?  সরেজমিন দেখা যায় কারওয়ানবাজার চালের আড়তসংলগ্ন একটি খুপরিঘরের সামনে গাঁজার ডালি সাজিয়ে বসে আছেন মধ্যবয়স্ক এক পুরুষ। মাদক সেবনে নিজের শরীরের হাড়গুলো বেরিয়ে আছে। তার এক হাতের মুঠে ইয়াবা অন্য মুঠে গাঁজা। এই প্রতিবেদকের কাছে এসে জানতে চান কোনটা লাগবে। ছোট বাবা (ইয়াবা) দেড় শ’, বড় তিন শ’ টাকা। একটু ভালো বা ফ্রেস নিলে বড় সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দেয়া যাবে। নাম জানতে চাইলে প্রথমে বলতে চাননি। পরে বলেন, তার নাম সেলিম। তবে সেটি তার প্রকৃত নাম না ভুয়া সেটা বুঝা যায়নি। সেলিম খুব ঘনিষ্ঠভাবে বলতে শুরু করেন নানা কথা। তিনি বলেন, স্যার সব টাউট বাটপার। কাকে বিশ্বাস করবেন। আমার কাছে টাকা দ্যান। আমি ফ্রেস মাল দেবো। অন্যরা আপনার টাকা মেরে দিতে পারে। আবার কেউ নকল মাল ধরিয়ে দিতে পারে। আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন। আমি সলিট মাল দেবো। আপনার কী লাগবে বলেন? গাঁজা ইয়াবা হলে আমার কাছে আছে। আর অন্য কিছু লাগলে ঘর থেকে আনতে হবে। জানতে চাইলে সেলিম বলেন, এখানে গাঁজা, কয়েক প্রকারের ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, প্যাথেডিনসহ সব ধরনের নেশা (নেশা জাতীয়দ্রব্য) পাওয়া যায়। এসব বলার মধ্যেই অপর একজন ছুটে আসেন। তিনি বলেন, ‘মামা ও নিজে বড় বাটপার। ওর কাছ থেকে নেবেন না। আমার কাছে সলিট মাল আছে। কী লাগবে বলেন? ঠিক ওই সময় কয়েকজন টহল পুলিশ দেখা যায়। পুলিশ দেখিয়ে জানতে চাইলে নতুন আগন্তুক জানান, ‘আরে মামা আপনি ভয় পান ক্যান। পুলিশ আর আমরা ভাই ভাই। আর যদি ধরেও ছাড়া পেতে সময় লাগবো না।’  তিনি বলেন, সন্ধ্যা নামার পর থেকে চালের আড়ত থেকে তেজগাঁও ফকিরনি বাজার পর্যন্ত রেললাইনের দুই পাশের বস্তিতে মাদকের পাইকারি বাজার বসে। আর দিনে খুচরা বিক্রি করা হয়। দিনের বেলা সব মাল ঘর থেকে বের করা হয় না। রেললাইনের ওই এলাকায় ঢুকলেই শিশু থেকে শুরু করে নারীরা পর্যন্ত জানতে চান ‘মামা কোনটা লাগবে’। চালের আড়তের কর্মচারী মামুন জানান, তাকে প্রতিদিন এই রেললাইন দিয়ে আসা যাওয়া করতে হয়। কয়টা লাগবে কি লাগবে শুনে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। তা ছাড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকেই এখন তাকে চিনেন। যার কারণে তার কাছে কম আসে। তবে মাঝে মধ্যে শিশুরা মাদক নেয়ার জন্য ঘিরে ধরে তাকে।  অনুসন্ধানে জানা গেছে, টঙ্গীর এরশাদনগরের বাস্তুহারা এলাকার সিরাজ ওরফে কমান্ডার সিরাজ, দণি বেগুনবাড়ির পটাশ হান্নান, জামাল খান, মগবাজারের গাবতলার আশরাফ আলী, মাদক সম্রাজ্ঞী মাহমুদা কারওয়ানবাজার রেলওয়ে বস্তির মাদকব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের সাথে রয়েছে দাড়িওয়ালা শামসু, ফর্মা মিলন, আলমগীর, ভাগ্নে সিরাজ, রুবেল, বড় লিটন, কানা লিটন, মোস্তফা, হাবিব, শাহিদা, নুরুন্নাহার ওরফে জলিলের বউ, পারভীন, পিয়ারা ওরফে বাহারের স্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন। এই চক্রটি নিজেদের প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রীর লোক পরিচয় দিয়ে প্রভাব খাটান। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের তেজগাঁও ও শিল্পাঞ্চল থানার কয়েকজন নেতার ছত্রছায়ায় নিয়ন্ত্রণ করা হয় রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তি ও মাদক ব্যবসায়ের। ওই বস্তিতে আট শতাধিক খুপরিঘর রয়েছে। প্রতিটি খুপরিঘরই যেন এক-একটি মাদকের দোকান। এই মাদকের হাটের প্রতিটি ঘর থেকে মাসোহারা আদায় করে সিরাজ চক্র। সিরাজের সহযোগিতায় বস্তির মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণে পরিচিত মাহমুদা। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হাতে একাধিকবার গ্রেফতার হলেও বেশি সময় জেলে থাকতে হয় না তাকে।  এ ব্যাপারে তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলামের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে থানার অপর এক কর্মকর্তা বলেন, রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তি উচ্ছেদ না করলে এখানকার মাদকব্যবসায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, কারওয়ানবাজার রেললাইন বস্তি থেকে প্রায় প্রতিদিন এক-দুইজনকে মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু কয়েকদিন পর জেল থেকে বের হয়ে আবার মাদকব্যবসায় শুরু করে। তিনি বলেন, এমনও লোক আছে যাকে মাদকের অভিযোগে তিন-চারবার গ্রেফতার করা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment