Wednesday, December 24, 2014

৩ ধাক্কায় বিধ্বস্ত আবাসন:কালের কন্ঠ

একসঙ্গে তিন ধাক্কা- পুঁজিবাজারে ধস, আবাসিক ভবনে গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ আর ৩০০ কোটি টাকার ঘূর্ণায়মান তহবিল বন্ধ। ২০১০ সালের এ ঘটনাগুলো আবাসন খাতে যে স্থবিরতার সূচনা কর
েছিল, তা এখনো কাটছে না। ফ্ল্যাট ও জমি বিক্রিতে মন্দার শুরু হয়েছে ২০১১ সালে। ২০১২ সালে তা আরো গভীর হয়েছে। ২০১৩ সাল গেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতায়। ২০১৪-তে এসে ফ্ল্যাটের জটিল জট তৈরি হয়েছে আবাসন ব্যবসায়। চলতি বছর ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন আবাসন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছিলেন, কিন্তু বিক্রির সময় দেখা গেল ক্রেতা নেই। ফলে অবিক্রীত ফ্ল্যাটের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। আবাসন ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরেই বলছিলেন, তাঁদের ব্যবসায় মন্দা চলছে। কিন্তু কতটুকু খারাপ অবস্থা, তার হালনাগাদ সমীক্ষাভিত্তিক কোনো তথ্য ছিল না। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সম্প্রতি আনুষ্ঠানিক একটি জরিপ শুরু করেছে আবাসন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। গত সোমবার পর্যন্ত ২০৯টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংগ্রহ করা তথ্য অনুযায়ী, এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ১২ হাজার ১৮৫টি ফ্ল্যাট বা ইউনিট অবিক্রীত আছে। আর এতে আটকে আছে প্রায় আট হাজার ৮১১ কোটি টাকা। এ অবস্থার মধ্যে বুকে আশা-নিরাশার দোলা নিয়ে, বড় ছাড়ের অফার দিয়ে আজ বুধবার থেকে ঢাকায় শুরু হচ্ছে আবাসন মেলা। আবাসন ব্যবসায়ীদের মতে, স্বাভাবিক সময়ে তাঁদের যা বিক্রি হয় তার থেকে ৫০ শতাংশ বিক্রি কমে গিয়েছিল। এখন সামান্য বেড়েছে। কিন্তু জট কাটাতে তা তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। বহু প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন দিতে, ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে লাভ ছাড়াই ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে দাম কমে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। অনেক বড় বড় গ্রুপ আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে মারাত্মক সংকটে পড়েছে। তারা এখন এ খাত থেকে হাত গুটাতেও পারছে না। ফলে গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে তারা। দেশের অর্থনীতির বড় খাতগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে আবাসন খাত। এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। আবাসন খাতের সঙ্গে ২৬৯টি শিল্প জড়িত, যেগুলোর অস্তিত্ব নির্ভর করছে আবাসন খাতের ওপর। এগুলোর পণ্য বিক্রি বাড়ে আবাসন খাতে গতি থাকলে। যার ইতিবাচক প্রভাব শেষ পর্যন্ত গিয়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ওপর পড়ে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুলের পরিচালক ও সাবেক ব্যাংকার মামুন রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, আবাসন খাতের অবস্থা কী তা জানার জন্য সরকারিভাবে একটি সমীক্ষা হওয়া উচিত। এ খাতকে সরকারের অবহেলা করা উচিত নয়, কারণ দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে এ খাতের বড় ভূমিকা আছে। অনেকগুলো খাত আবাসন খাতের ওপর নির্ভরশীল। মামুন রশীদ মনে করেন, এখন পুঁজিবাজার থেকে 'ইজি মানি' বা সহজে কামাই করা টাকা নেই। অর্থনীতিও এক ধরনের মন্থরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে অনেক ফ্ল্যাট অবিক্রীত পড়ে আছে। এ খাতের যখন খারাপ অবস্থা শুরু হয়েছে, তখন ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকগুলোও ঋণ দেওয়া বন্ধ করেছে। ফলে অনেক প্রকল্প শেষ হতে পারেনি। আবার কিছু আবাসন প্রতিষ্ঠানের ঠিক সময়ে প্রকল্প শেষ না করার প্রবণতা আছে বলে ক্রেতার মধ্যে আস্থার সংকটও আছে। ২০১১ সালের পর থেকে বিক্রিতে ধস নামায় ফ্ল্যাটের দাম ৩০ শতাংশ কমে গেছে বলে দাবি করেন আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান শেলটেক (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তৌফিক এম সেরাজ। সম্প্রতি কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে ওই প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাবিদ বলেন, ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালের তুলনায় এখন ফ্ল্যাটের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কম। এর কারণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা এবং তিন বছর ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ মন্দাবস্থা কবে কাটবে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে এ ধরনের মন্দা কাটাতে আমেরিকা, জাপানে সাত-আট বছরও লাগে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ড. তৌফিক এম সেরাজ মনে করেন, অনেক প্রকল্প আর হস্তান্তর হবে না। সারা দুনিয়াতে মন্দা এলে এটা হয়। ১৯৯৭ সালে হংকংয়ে এমন একটা ধস নেমেছিল। তখনকার অনেক প্রকল্প ১০ বছরের মধ্যেও আলোর মুখ দেখেনি। চট্টগ্রামের একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ কয়েক বছর আগে আবাসন ব্যবসায় নামে। কিন্তু সেখানে বড় পুঁজি আটকে পড়ায় তারা এখন চরম বিপাকে আছে। আবাসন ব্যবসা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারছে না। ফলে চাপ পড়েছে তাদের অন্য ব্যবসাগুলোর ওপর। ইতিমধ্যে তাদের দুটি কম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকের দায় ছাড়িয়ে গেছে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে। ঢাকার একটি ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ব্যবসায়ী গ্রুপ তাদের আবাসন কম্পানিটি নিয়ে বিপাকে পড়েছে বলে জানা গেছে। আবাসন ব্যবসায় তাদের বড় অঙ্কের টাকা আটকে থাকায় অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা নিয়ে ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। আবাসনের সহযোগী শিল্পগুলোও এখন বিপাকে আছে। রড, সিমেন্ট, ইট, আসবাবপত্র, রং, সিরামিকসহ বহু শিল্পের পণ্য বিক্রি কমে গেছে। ওই সব শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে কর্মীদের ছাঁটাই চলছে। রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর সামসুল আলামিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আসলে ভালো কেউ নেই। কারো কারো অবস্থা খুব বেশি খারাপ।' ফ্ল্যাটের দাম কমে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন আবাসন ব্যবসায়ীরা যে দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করছেন তাতে তাঁদের পকেটের টাকা চলে যাচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় চিন্তা : ২০১৩ সালের ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতার পর দেশজুড়ে শান্তি এসেছিল গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে। গত এক বছর কোনো রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল না। তাতে ধীরে ধীরে আস্থা ফিরতে শুরু করেছিল। কিন্তু নতুন করে বিরোধী দলের আন্দোলনের প্রস্তুতি শঙ্কায় ফেলছে ব্যবসায়ীদের। আলমগীর সামসুল আলামিন বলেন, মানুষের আস্থা ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করেছিল। আস্থা ফিরলে আবাসন খাতের সংকট কাটত। কিন্তু আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে অনিশ্চয়তা শুরু হতে পারে। তিনি বলেন, 'আবাসন খাতে বিনিয়োগ হয় দীর্ঘমেয়াদে। গ্রাহক অনেক ভেবেচিন্তে বিনিয়োগ করেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে এ খাতে বিনিয়োগ কমে যায়। বিগত সময়ের প্রলম্বিত রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে এখনো আমরা ভুগছি।' ড. তৌফিক এম সেরাজ বলেন, 'এখন বিক্রি কিছু কিছু করে বাড়ছে। তবে খুশি হওয়ার মতো নয়। আগে ১০০টা বিক্রি হলে সেটা ৫০-এ নেমে গেছিল; এখন ৫৫টা বিক্রি হচ্ছে। এ সামান্য বাড়তি বাস্তবিক সুলক্ষণ নয়। এ খাতে স্থিরতা আনতে হবে।' ক্রেতাদের জন্য ঋণ দাবি ব্যবসায়ীদের : আবাসন খাতের বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে ক্রেতাদের ঋণ দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ জন্য তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘূর্ণায়মান তহবিল আবার চালুর দাবি জানিয়েছেন। ড. তৌফিক এম সেরাজ মনে করেন, আবাসন মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আবাসন চাহিদা পূরণের জন্য সরকারের কম সুদে ঋণ দেওয়া উচিত। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘূর্ণায়মান তহবিল আবার চালুর পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, প্রয়োজনে এ তহবিল থেকে শুধু প্রথমবার ফ্ল্যাট অথবা জমি কেনার জন্য গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া যেতে পারে। ২০১০ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া পুনরর্থায়ন তহবিল থেকে একজন আবেদনকারীকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে মাত্র ৫ শতাংশ সুদে এই ঋণ দিত। বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে সুদ নিত ৯ শতাংশ হারে। ঘূর্ণায়মান এ তহবিলটি ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৭০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০১০ সালের ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত এ তহবিল থেকে ৬১০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। ওই তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গ্রাহকদের ভরসা এখন বাণিজ্যিক ব্যাংক। সিঙ্গাপুরের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ২.৮ থেকে ৩ শতাংশ সুদ হারে, মালয়েশিয়ায় ৪.৩৯-৪.৬৫ শতাংশ আর ভারতে ১০-১০.৭৫ শতাংশ সুদে গ্রাহকদের আবাসন ঋণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ঘোষিত সুদ হার ১১ থেকে ১৯.৫০ হলেও নানা ধরনের প্রকাশ্য ও গোপন চার্জসহ ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ হারে সুদ দাঁড়ায়। আলমগীর সামসুল আলামিন বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ সাধারণ মানুষের পক্ষে নেওয়া কষ্টকর। কারণ এতে সুদ বেশি ও স্বল্প সময়ের জন্য এ ঋণ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, বিদেশে ভাড়ার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি কিস্তি ধরে গ্রাহকদের দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেওয়া হয়, যাতে তাদের ওপর চাপ না পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো মাসিক ভাড়া খরচের ১০ গুণ হারে কিস্তি ধরে। ফলে চাকরিজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে ঋণ নেওয়া সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, আবাসনে ঋণ দেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ এখানে ১০০ ভাগ জামানত থাকে। যাঁর বয়স ৪০ বছর, তাঁকে ২০ বছর মেয়াদি ঋণ দেওয়া উচিত। যাঁর ৩০ বছর তাকে ৩০ বছর মেয়াদি ঋণ দেওয়া উচিত। বিদেশে এভাবেই আবাসন খাতে ঋণ দেওয়া হয়। রিহ্যাবের সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া জানান, তাঁরা ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, যেখান থেকে ক্রেতাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এ তহবিল গঠনের আশ্বাসও দিয়েছেন। ফ্ল্যাট কিনলে জবাবদিহি, তাই টাকা পাচার : ফ্ল্যাট কিনলে আগে আয়কর আইনে কোনো রকম জবাবদিহি করতে হতো না। কিন্তু এ বিশেষ সুযোগটি সরকার প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে দেশে নিরাপদ মনে না করে অনেকে টাকা বিদেশে পাচার করছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেবল ২০১২ সালেই বাংলাদেশ থেকে ১৭৮ কোটি ডলার বা ১৩ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। গত এক দশকে (২০০৩-২০১২) বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা। পাচারের হার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেকোনো সরকারের প্রথম দিকে টাকা কম পাচার হয় এবং শেষ সময়ে অস্থিরতা তৈরি হলে পাচারের মাত্রা বেড়ে যায়।      

No comments:

Post a Comment