ঝুলন্ত মামলায় জর্জরিত দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতগুলো। প্রতিবছর বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বাড়ছেই। এখন সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখের বেশি। ২০০৭ সালের
১ নভেম্বর দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। মাত্র সাত বছরেই ঝুলন্ত মামলার সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মামলাজটই এখন বিচার বিভাগের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মামলাজট কমাতে প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন নির্দেশনা, পরামর্শ দিচ্ছেন; বিচারকদের, আইনজীবীদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলছেন। কিন্তু কোনো কাজেই আসছে না সেসব। মামলার সংখ্যা বাড়ছেই। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৪৭ হাজার ৪৬৮। গত জুনের শেষ দিনে ওই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ৩৩ হাজার ৩১০। অর্থাৎ ছয় মাসে বিচারাধীন মামলা বেড়েছে দুই লাখ ৮৫ হাজার ৮৪২টি। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হারে মামলাজট বাড়লে দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থা হারাবে। বিচারপ্রার্থী মানুষের হয়রানিও দিন দিন বাড়বে। মামলাজট বাড়ার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি হবে। বিচারব্যবস্থা অচল হয়ে পড়বে। বিচার বিভাগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, দেশে বিচারকের স্বল্পতা, আদালতগুলোতে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা না বাড়ানো, গ্রাম আদালত যথাযথভাবে কার্যকর না করা, অভিজ্ঞ সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগ না দেওয়া, মামলা নিষ্পত্তিতে আইনজীবীদের অনীহা, সময়মতো সাক্ষী হাজির না করা, আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ না নেওয়া, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন প্রণয়ন না করা ইত্যাদি মামলাজট বাড়ার প্রধান কারণ। এ ছাড়া সারা দেশের আদালতগুলোর মামলা ব্যবস্থাপনা কমিটির সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করাও মামলাজট বাড়ার অন্যতম কারণ। আবার আইনগত ফাঁকফোকরের দোহাই দিয়ে উচ্চ আদালতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হওয়াও এর আরেক কারণ। মামলা নিষ্পত্তির তুলনায় নতুন মামলা দায়ের বেশি হওয়াও আরেক কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, মামলাজট একটি পুরনো সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে সরকার ও বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনোযোগী হতে হবে। এই সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালতের মামলার সংখ্যা বিবেচনা করলে কয়জন ব্যক্তি সঠিক সময়ে ন্যায়বিচার পাবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। আদালতের অবকাঠামো উন্নয়ন, বিচার বিভাগে জনবল বৃদ্ধি ও বিচারব্যবস্থা আধুনিক করা ছাড়া এই মামলাজট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় নেই। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের রুল অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ ও নিম্ন আদালতের নানা সমস্যা মনিটরিং ও সমাধানার উপায় খুঁজে বের করার জন্য বিচারপতিদের নিয়ে দুটি কমিটি থাকার কথা। এই কমিটি যদি সঠিকভাবে কাজ করে আর প্রধান বিচারপতি তাদের সুপারিশ আমলে নিয়ে পদক্ষেপ নেন, সেটা ভালো কাজ দিতে পারে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, সারা দেশে মামলাজট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এটা কমাতে আইন কমিশনের পক্ষ থেকে একটি সুপারিশ সংসদের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। সেই সুপারিশে নিম্ন আদালত ও সুপ্রিম কোর্টে মামলাজট কমাতে পৃথক উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, নিম্ন আদালতে মাত্র ১৭০০ বিচারক বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। আরো তিন হাজার বিচারক নিয়োগ না দিলে এই জট কোনোভাবেই কমানো সম্ভব নয়। এ ছাড়া নিম্ন আদালতে লজিস্টিক সাপোর্ট একেবারে নেই বললেই চলে। আইন কমিশনের সুপারিশে সেসব লজিস্টিক সাপোর্ট ও বিচারব্যবস্থার অধুনিকায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া নিম্ন আদালতের বিভিন্ন মামলায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পিত্তি পদ্ধতির (এডিআর) প্রয়োগ, বিচারকদের সঠিক সময়ে এজলাসে বসা ও নিম্ন আদালতের ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য একটি টিম বা কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, মামলাজট জরুরি ভিত্তিতে কমানোর লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে সৎ ও কর্মঠ অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পদায়ন করলে পুরনো বিচারাধীন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার শুনানি, আপিল ও রিভিশন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। আর আইন কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি মনিটরিং সেল থাকবে, যা প্রধানত মামলা দাখিল ও নিষ্পত্তির সংখ্যা কী কী কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নিরূপণ করে সমাধানের পদক্ষেপ নেবে। মামলার হিসাব : সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মামলার পরিসংখ্যান প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও সারা দেশের নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৪৭ হাজার ৪৬৮। এর আগের বছর সব মিলে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৪৫ হাজার ৪৩৫। এক বছরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেড়েছিল তিন লাখ দুই হাজার ৩৩টি। জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় বিচারাধীন মামলার সংখ্যা আরো দ্বিগুণ বেড়েছে। গত জুন পর্যন্ত দুই লাখ ৮৫ হাজার বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখের বেশি। এ বছরের শেষ নাগাদ বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যেসব কারণে মামলা বাড়ছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, মামলা বর্তমান হারে নিষ্পত্তি হলে আগামী ১০ বছরে দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এক কোটিরও বেশি হবে। এতে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের সুফল ভোগ করার পরিবর্তে একসময় বিচার বিভাগের প্রতি অনাস্থা আসবে জনগণের মধ্যে। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা অত্যধিক বাড়ার কারণগুলো হচ্ছে- বিচারকস্বল্পতা : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তিতে যত বিচারক প্রয়োজন, দেশে তার তিন ভাগের এক ভাগ বিচারকের পদ রয়েছে- সারা দেশে ১৭০০। প্রয়োজন আরো তিন হাজার। আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই ১৭০০ বিচারকের মধ্যে এই মুহূর্তে ৪০০ বিচাকের পদ শূন্য রয়েছে। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব : বিচারকদের কাজ করার জন্য অবকাঠামোগত যেসব সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন তা নেই বলে বিচারকদের কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। ফলে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। আদালতগুলোয় জনবলের অভাব, পর্যাপ্ত আদালত কক্ষ, বিচারকদের পর্যাপ্ত খাস কামরার অভাব বিচারকাজকে ব্যাহত করছে। গ্রাম আদালতের কার্যকারিতা না থাকা : গ্রাম আদালত আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও তাঁর কার্যকারিতা না থাকায় নিম্ন আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। আইনে কিছু তুচ্ছ ঘটনায় দায়ের করা মামলা গ্রাম আদালতে বিচারের বিধান রয়েছে। কিন্তু ওই আদালত কাজ করে না বলেও তুচ্ছ ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচারকাজ করতে হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন না থাকা : ফৌজদারি মামলায় বিচারকাজের পরিবর্তে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা করার জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন (এডিআর) প্রণয়ন না করার কারণে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এর আগে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই আইনটি প্রণয়নের কথা বারবার বলা হলেও আজ পর্যন্ত তা হচ্ছে না। দেওয়ানি মামলায় এডিআরের বিধান থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর করা হয় না। মামলা নিষ্পত্তিতে আইনজীবীদের অনীহা : নিজ নিজ মক্কেলের পক্ষে বারবার সময়ের আবেদন করে আইনজীবীরা মামলাগুলোর শুনানিতে সময় নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে বিচারকাজের পরিবর্তে মামলার তারিখ পরিবর্তন হতে থাকে এবং মামলাজট বাড়তে থাকে। সময়মতো সাক্ষী হাজির না করা : বিচারাধীন মামলায় সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় বা না করায় মামলা নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি হয় না। বিচারকাজ এতে পিছিয়ে যায়। সাক্ষীদের প্রতি জারি করা সমন বা নোটিশ এক শ্রেণির জারিকারক ও পুলিশ না পাঠানোয় বা লুকিয়ে রাখায় মামলার বিচারে বিলম্ব হয়। এ ছাড়া বারবার নিম্ন আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাওয়ার কারণেও বিচারাধীন মামলার শুনানি পিছিয়ে যায়। ফলে মামলা বিচারের অগ্রগতি হয় না। অনেক সময় উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়ায় মামলার নিষ্পত্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আইনগত ফাঁকফোকরের কারণেও মামলার বিচার বিলম্বিত হয়। কিছু মামলা নিষ্পত্তির নির্দিষ্ট সময়সীমা আইনে উল্লেখ থাকলেও বিচারকরা ওইসব মামলা নিষ্পত্তিতে আগ্রহ দেখান না। অনেক সময় বিচারকরা সময়মতো এজলাসে না ওঠার কারণেও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আইন কমিশনের সুপারিশ : বিচারাধীন মামলার জট দূরীকরণ ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণের জন্য গত ২১ মে আইন কমিশন কিছু সুপারিশ করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। গত ১৯ এপ্রিল জাতীয় সংসদের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভায় এসব সুপারিশ করা হয়। ওই সভায় বলা হয়, মামলার জট কমাতে হলে জরুরিভিত্তিতে কয়েক ধাপে কমপক্ষে আরো তিন হাজার নতুন বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। এ জন্য সহায়ক কর্মচারী, নতুন এজলাস কক্ষসহ ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলারও সুপারিশ করা হয়। প্রয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে বিচারকাজ চালানোরও পরামর্শ দেওয়া হয়। দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধি ও আদেশ মোতাবেক হাইকোর্ট বিভাগ নিম্ন আদালতগুলোর বিচারিক কাজ সম্পাদন করার জন্য প্রতি কর্মদিবস সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার কথা উল্লেখ করে সভায় বলা হয়, সময়মতো বেশির ভাগ বিচারক এজলাসে ওঠেন না। এটি নিশ্চিত করতে হবে। টানা সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে (প্রতিদিন) মামলার বিচারকাজ শেষ করতে হবে। জেলা জজদের নিয়মিত তাঁর অধীন আদালত পরিদর্শন করে সুপ্রিম কোর্টে প্রতিবেদন পাঠানোরও সুপারিশ করা হয়। প্রত্যেক জেলায় নিয়মিত মামলা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সুপারিশে। আদালতের সমন জারি, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি যাতে সঠিকভাবে হয় তারও মনিটারিং করার ওপর জোর দেওয়া হয় আইন কমিশনের সুপারিশে।
No comments:
Post a Comment