Friday, January 30, 2015

ডা. অমলেন্দু দাক্ষী:প্রথম অালো

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন পাবনা শহরের দন্ত চিকিৎসক ছিলেন অমলেন্দু দাক্ষী। রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। ন্যাপের (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) ভাসানী অংশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের পাকিস্তানে সামরিক শাসনের সময় গ্রেপ্তার হ
ন। কয়েক মাস পর মুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ৬ সেপ্টেম্বর আবার আটক হন। প্রায় এক বছর জেল খাটেন। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় পাবনায় তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। দাঙ্গা প্রতিরোধে হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সবাইকে উদ্বুদ্ধ ও মানুষকে সাহস জুগিয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হলে ওই দিনই পাবনায় এক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। এই মিছিলের উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন তিনি। প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের আশ্রয়, বুদ্ধি ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। ফলে স্বার্থবাদী মানুষের বিরাগভাজন হন, একবার ছুরিকাহতও হয়েছিলেন। একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল অমলেন্দু দাক্ষীকে তাঁর শহরের পাথরতলার (দিলালপুর) বাসা থেকে রাতে ধরে নিয়ে যায়। এদিন শহরের আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটক করে। সেনাবাহিনীর এই দল সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য পাবনায় এসেছিল। তখন থেকে তারা শহরেই অবস্থান করছিল। পাকিস্তানি সেনারা অমলেন্দু দাক্ষীকে টেলিফোন ভবনে আটকে রেখে অকথ্য নির্যাতন চালায়। তারপর ২৯ মার্চ তৎকালীন ইপসিক (বর্তমানে বিসিক) শিল্পনগরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তাঁর স্ত্রী শোভারানী দাক্ষীর ‘আমার স্বামী’ রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘সেদিন ছিল শুক্রবার। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল। পাবনা শহর থমথমে। ‘ট্রাফিক মোড়ের দোকান থেকে পাথরতলার (দিলালপুর) চারতলা ভবন। এ বাড়িরই নিচতলায় ভাড়া থাকেন পাবনার খ্যাতিমান দন্ত চিকিৎসক, আমার স্বামী ডা. অমলেন্দু দাক্ষী। ‘পোশাক বদলিয়ে লুঙ্গি পরলেন ডাক্তার। খালি গায়েই খেতে বসলেন তিনি। রাত প্রায় ৯টা।...আমি বসে আছি খাবার টেবিলেই। তাঁর সঙ্গে এই শেষ বসা। এমন সময় বাইরে জিপের শব্দ। তারপর বুটের আওয়াজ। ‘সচকিত হলেন ডাক্তার। বুটের শব্দ এগিয়ে এল।... ‘দরজায় অনবরত লাথির শব্দ। বুটের লাথি। আমি এগিয়ে গেলাম দরজা খুলতে। তার আগেই পূর্ব-পাশের দরজা ভেঙ্গে ফেলেছে পাক-সেনারা। ঘরে ঢুকে পড়েছে ৪/৫ জন।—দাক্ষী কোন হ্যায়? ‘আমি। নিজেকে দেখালেন ডাক্তার বাবু। ‘শালে শুয়ার কা বাচ্চা, তুম শুনা নেহি, ম্যায় তুমকো বুলাতা হ্যায়? ‘চুপ থাকলেন ডাক্তার বাবু। পেছন থেকে একজন এসে লাথি মারলো ভাতের থালায়। সামনের সেনাটি কষে এক চড় মারলো ডাক্তারের গালে। মাথা নিচু করে সহ্য করলেন ডাক্তার।...শুরু হলো কিল...চড়...লাথি। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী। চিৎকার করে ছুটে এলাম আমি। ছুটে এল ছেলেমেয়েরা। সবাই মিলে জড়িয়ে ধরলাম ডাক্তারকে।...রাইফেলের বাঁট উঁচু করলেন একজন সেনা। ঝনঝন শব্দে খানখান হয়ে গেল কাঁচের আলমারী। শকুনের মতো হাতের ধাবায় আঁকড়ে ধরলো কচি কচি ছেলেমেয়েদের ডানা। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া হলো তাদের। হাত ধরে টেনে তোলা হলো ডাক্তারকে। তারপর বের করার জন্য দরজার দিকে ধাক্কা। ছুটে এগিয়ে গেলাম আমি। পেছন থেকে শাড়ির আাঁচল টেনে ধরলো একজন। তারপর সজোরে লাথি। চিৎকার দিয়ে বসে পড়লাম আমি। বের করে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারকে।... ‘হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া একজন জনাব আবদুল খালেক তালুকদার মারফৎ যা জেনেছি, তাতে তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটা অনুমান করতে পারি। প্রথমে শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে তাঁকে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায় ২৮ মার্চ রাত ৮টা পর্যন্ত।... ‘২৯ মার্চে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা বিসিক শিল্পনগরী আক্রমণ করলে পরাজয় আসন্ন জেনে পাক মেজর সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে এবং সবাইকে এক দড়িতে বেঁধে টেনে হেঁচড়ে একটা ট্রেঞ্চের মধ্যে ফেলে দেয়। আহত খালেক তালুকদার বেঁচে যান অলৌকিকভাবে।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রকাশ ১৯৮৯, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)। অমলেন্দু দাক্ষীর আদি পৈতৃক নিবাস রাজশাহী মহাগরের মালোপাড়ায়। বাবা পার্বতীচরণ দাক্ষী। তাঁর পরিবারের কেউই এখন বাংলাদেশে থাকেন না। তিনি এক ছেলে অসিতবরণ এবং দুই মেয়ে শিখা ও ছুটকার জনক। তাঁর ছবি পাওয়া যায়নি। গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান rashedtr@prothom-alo.info

No comments:

Post a Comment