Friday, January 16, 2015

শ্রমজীবীদের নাভিশ্বাস হরতাল-অবরোধে:কালের কন্ঠ

কাজে গেলে দিনে আয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, হাতখরচ মালিকের। ঘরে বসে থাকলে এক টাকাও কামাই নেই, উল্টো শখানেক টাকা চলে যায় চা-নাশতার পেছনে। দেড় টনি মিনি ট্রাকের চালকের সহকারী ব
া হেলপার গোলাম রসুলকে তাই ট্রাক নিয়ে বের হতে হয় হরতাল-অবরোধের মধ্যেও। প্রতিদিনই বাস-ট্রাকের হেলপারদের পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা গোলাম রসুলের জানা আছে, মনে ভয়ও আছে; কিন্তু কিছু করার নেই। নিজের খরচ আছে, পরিবারকে টাকা পাঠাতে হয়। তাই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গোলাম রসুলকে রাস্তায় নামতেই হয়। এটা একজনের কথা। গোটা বাংলাদেশে এমন শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা কত, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। গত ৬ জানুয়ারি শুরু হওয়া টানা অবরোধ ও মাঝেমধ্যে ডাকা হরতালে সবচেয়ে কষ্টে আছে এই শ্রমজীবীরা। দিনের আয় দিয়ে তাদের পরিবার চলে। মাঝে দু-তিন দিন কাজ করলে জমানো টাকা খরচ করে চলতে পারে তাদের পরিবার। কিন্তু এক-দুই দিন নয়; টানা ১১ দিন কাজ না করে থাকার সুযোগ তাদের নেই। ফলে এসব শ্রমজীবী মানুষ পেটের টানে রাস্তায় নামছে, অনেকেই অবরোধের আগুনে পুড়ছে, তার পরও ঘরে থাকছে না তারা। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাজের খোঁজে মানুষের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাওয়ার হার বহু গুণ বেড়েছে। যেখানে কাজের সুযোগ বেশি, সেখানে শ্রমজীবী মানুষের যাওয়ার হারও বেশি। দেড় কোটি মানুষের বিশাল শহর ঢাকায় কাজ পাওয়া যায় অনেক বেশি। তাই শ্রমজীবীদের যাতায়াত রাজধানীকেন্দ্রিকই বেশি। সেই সঙ্গে বিভিন্ন জেলা শহর, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়ও প্রচুর মানুষ কাজের খোঁজে যায়। উত্তরবঙ্গ থেকে প্রচুর মানুষ ঢাকায় এসে দিনমজুরি করে, রিকশা চালায়- কিছুদিন কাজ করে বেশ কিছু টাকা জমিয়ে তারা গ্রামে ফিরে যায়। আবার কিছুদিন পর ঢাকায় ফেরে তারা। প্রতিদিন বহু ফড়িয়া ব্যবসায়ী সবজি নিয়ে ঢাকায় আসে। বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বিভাগীয় শহরগুলোতে। জীবিকার টানেই তাদের অবরোধের মধ্যেও বাসে উঠতে হয়, ট্রাকের স্টিয়ারিং ধরতে হয়। তাদেরই আবার পুড়তে হয় অবরোধের আগুনে। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে রংপুরের মিঠাপুকুরে যাত্রীবাসে অবরোধ সমর্থক জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ছোড়া পেট্রলবোমায় পুড়ে মারা গেছে পাঁচজন। দগ্ধ হয়েছে ২৫ জন। হতাহতদের বেশ কয়েকজনই শ্রমজীবী মানুষ। জীবিকার তাগিদে তারা চলেছিল ঢাকায়। তাদের একজন গার্মেন্টকর্মী রাশেদা। ছুটি শেষে ঢাকায় কারখানায় ফেরার বদলে আগুনে পুড়ে তাঁর স্থান হয়েছে রংপুর মেডিক্যালে। ঢাকার বাদাম বিক্রেতা রহিম বাদশা ও তাঁর মা রহিমা বেওয়া ছিলেন মিঠাপুকুরে নাশকতার কবলে পড়া বাসে। দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে। গতকাল গ্রামের বাড়িতে পাশাপাশি কবরে তাঁদের দাফন করা হয়। রহিম বাদশার কবরের সঙ্গে শায়িত হয়েছে স্ত্রী নিলুফার সর্বস্ব। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে স্বামীকে হারিয়ে চোখে এখন শুধুই অন্ধকার তাঁর। অবরোধের ১০ দিনে এখন পর্যন্ত পেট্রলবোমার আগুনে ৯ জন নিহত হয়েছে। তাদের অনেকেই শ্রমজীবী মানুষ। তারা একদিকে যেমন কাজের খোঁজে দূর-দূরান্তে যেতে পারছে না, তেমনি ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে অনেকে আর কর্মস্থলে ফিরতে পারছে না। এমনকি রাস্তার ধারে থামিয়ে রাখা বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে হেলপারদের, যাদের নিজস্ব বাসা থাকে না, রাতে বাসেই ঘুমাতে হয়। বাস পোড়ার পরও ঝুঁকি নিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে কাজের খোঁজে বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার তাড়ার কমতি নেই শ্রমজীবীদের মধ্যে। কুড়িগ্রামের যাত্রাপুরের দিনমজুর আজাদ আলী এলাকায় কাজ না থাকায় কাজের সন্ধানে ফেনী যাওয়ার চেষ্টা করছেন সপ্তাহখানেক ধরে, কিন্তু যেতে পারেননি। বৃহস্পতিবার দুপুরে কুড়িগ্রাম শহরের ঘোষপাড়ায় কর্ণফুলী পরিবহনের কাউন্টারে এসে খোঁজ নিচ্ছিলেন- বাস ছাড়বে কি না। একই কাউন্টারে যাত্রাপুরের ঝুনকার চরের শাহীন আলম, আল আমিন ও বাদশা; গোয়ালপুরির তাইজুলসহ অনেকেই সকাল থেকে ঘোরাঘুরি করছেন। তাঁরা কাজের সন্ধানে ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফেনী ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে চান। তাঁদের কেউ দিনমজুর, তাঁতি, মিস্ত্রি আবার কেউ রিকশাওয়ালা। কুড়িগ্রামের উলিপুরের গোড়াই গ্রামের মো. মোজাম্মেল ঢাকায় একটি গার্মেন্টে কাজ করেন। বাবার মৃত্যুতে তিনি বাড়িতে গিয়ে অবরোধের কারণে আর ঢাকায় ফিরতে পারেননি। যাত্রাপুরের দিনমজুর জলিল মিয়া জানান, তিনি এর মধ্যে তিন হাজার টাকা সুদের ওপর কর্জ নিয়েছেন। প্রতি হাজারে মাসে ১০০ টাকা সুদ দিতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি যেতে চান কাজ করতে। কিন্তু অবরোধের কারণে বাস চলছে না। বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের মৃত জাহাঙ্গীর হাওলাদারের ছেলে সাকিব হাওলাদার। চার সদস্যের পরিবারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম। লরিতে পণ্য পরিবহন করে যে আয় হয় তা দিয়ে চলে সাকিবের পরিবার। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম থেকে লড়ি বোঝাই করে সবজি নিয়ে ফেরার পথে বরিশালের দপদপিয়া ব্রিজের ঢালে তাঁর ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয় অবরোধকারীরা। দগ্ধ হন সাকিব। এখন শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তিনি। কিশোরগঞ্জের নিকলীর কামালপুরের ইদু মিয়া (৬০) চট্টগ্রামের একটি বাসার দারোয়ান হিসেবে চাকরি করেন। তাঁর স্ত্রী মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করেন। ইদু মিয়া জানান, অবরোধের আগে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়ি এসেছিলেন। নিকলী-চট্টগ্রাম রুটের বাস চলাচল বন্ধ থাকায় তাঁরা চট্টগ্রামে যেতে পারছেন না। এতে একদিকে যেমন অভাব-অনটনে কষ্ট করছেন, অন্যদিকে কাজ ছুটে (চাকরি চলে যাওয়া) যাওয়ারও আশঙ্কা আছে তাঁদের মধ্যে। ঢাকার ইন্দিরা রোডের রিকশাচালক আনোয়ার মিয়ার বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায়। গ্রাম থেকে ফিরেছেন গত শনিবার, গিয়েছিলেন গত ২৪ ডিসেম্বর। মঙ্গলবার রংপুরে বাসের আগুনের খবর শুনেছেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি নিজেও অবরোধের মধ্যেই এসেছি। সপ্তাহখানেক থাকার পরই ফেরার কথা ছিল। কিন্তু অবরোধে আটকা পড়ে ফিরতে দেরি হয়েছে।' ইজতেমার সময় অবরোধ শিথিল থাকার সুযোগে ফিরতে পেরেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কামাই ছাড়া কত দিন থাকা যায়? ঘরে চাল না থাকলে স্ত্রী-সন্তানদের খাওয়াব কী?' মাগুরা শহরের নতুনবাজারে রবি ও বৃহস্পতিবার দিনমজুরির হাট বসে। মাগুরাসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ যেমন এখানে শ্রম বিক্রি করতে আসে, তেমনি শ্রমিক কিনতে আসে বিভিন্ন এলাকার মানুষ। হরতাল-অবরোধের কারণে এখানে এখন দুই পক্ষের উপস্থিতিই কম। সেই সঙ্গে কমে গেছে মজুরি। মাগুরার মহম্মদপুরের রুইজানি গ্রামের দিনমজুর মোজাম মোল্যা জানান, ক্রেতা না থাকায় মজুরি কমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। আগে তিন বেলা খাবারসহ দৈনিক মজুরির চুক্তি যেখানে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা ছিল, এখন তা ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় নেমে এসেছে। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার বানীনগরের বাসিন্দা লাজু মিয়া বিভিন্ন হাট আর গ্রামে ঘুরে দেশি মুরগি কেনেন। সন্ধ্যায় সেগুলো নিয়ে গিয়ে মহাজনের কাছে বিক্রি করেন। লাজুর মতো কালীগঞ্জ উপজেলার শখানেক মানুষ আছে যারা লালমনিরহাট-বুড়িমারী আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে কাকিনা রেলগেট এলাকায় গড়ে ওঠা মুরগি আড়তগুলোকে ঘিরে বছরের পর বছর ধরে জীবন-জীবিকা চালিয়ে আসছেন। কিন্তু টানা অবরোধ আর মাঝেমধ্যে দেওয়া হরতালের কারণে গত ১০ দিন ধরে বন্ধ আছে রাজধানীতে মুরগি পাঠানো। ফলে লাজুদের মুরগি কেনা বন্ধ, আয়-রোজগার বন্ধ। আয় নেমেছে অর্ধেকে : এত ভয়ের মধ্যেও জীবিকার টানে রাস্তায় নামা মানুষের কমতি নেই ঢাকায়। ঢাকা শহর ও জেলায়-জেলায় পরিবহন চলছে, ক্ষুদ্র ব্যবসা চলছে, দিনমজুরি চলছে, রিকশা-অটোরিকশা চলছে- তারাও যে ভালো আছেন তা নয়। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজের খোঁজে নেমে অনেকেই কাজ পাচ্ছে না। সবার গড়পড়তা আয় নেমেছে অর্ধেকে। মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের রাস্তার পাশে প্রতিদিনই শ-দুয়েক ছোট ট্রাক 'খ্যাপের' (ট্রিপ) অপেক্ষায় থাকে। এক-একটি ট্রাকে একজন চালক ও একজন হেলপার থাকেন। প্রতি ১০০ টাকা ভাড়ার ২০ টাকা পান চালক, ১০ টাকা পান হেলপার ও বাকি টাকা পান মালিক। গতকাল বৃহস্পতিবার অবরোধ ও হরতালের দিনে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কোনো 'খ্যাপ' জোটেনি গোলাম রসুলের। বুধবার মালিকের কাছ থেকে ভাড়ার ভাগ জুটেছিল ৪০০ টাকা; যার ১২০ টাকা পেয়েছিলেন তিনি। গোলাম রসুল বলেন, কোনো কোনো মাসে তাদের আয় ২০ হাজার টাকাও হয়। তবে কয়েক মাস ধরে বাজার খুব খারাপ। মিরপুর এলাকা থেকে গার্মেন্ট সরে যাওয়ায় 'খ্যাপ' কমেছে। তার ওপর অবরোধে এখন দিনে দু-একটা ট্রিপও মারা যাচ্ছে না। মিনি ট্রাকের চালক মো. আলবি জানান, গত ১০-১২ দিনে তিনি একবারও দূরের যাত্রায় যাননি। ঢাকার ভেতরে বা আশপাশে যে 'খ্যাপ' পেয়েছেন কেবল সেখানেই গেছেন। তিনি বলেন, সাধারণ সময় হলে ১৫ দিনে ছয়-সাত হাজার টাকা আয় হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এ মাসের অর্ধেকে আয়ও হয়েছে অর্ধেক। রাজধানীর কাজীপাড়ার ঠেলাগাড়ি চালক মো. ফারুক ও মো. হারুন জানান, রড-সিমেন্টের দোকানে বিক্রি ভালো হলে তাঁরা ভাড়াও বেশি পান। কিন্তু গতকাল হরতালে বিক্রি কম হয়েছে। একটি স্বাভাবিক দিনে ঠেলাগাড়ি চালিয়ে তাদের একেকজনের আয় হয় ৫০০-৬০০ টাকা। কিন্তু গতকাল হয়েছে ২০০ টাকার কম। মো. ফারুক বলেন, 'জানের ভয়ে মানুষ রাস্তায় বাহির হয় না। আমরা খ্যাপ পামু কই?' (প্রতিবেদনটি লিখতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক রফিকুল ইসলাম, হাওরাঞ্চলের নিজস্ব প্রতিবেদক নাসরুল আনোয়ার, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আবদুল খালেক ফারুক, মাগুরা প্রতিনিধি শামীম খান ও লালমনিরহাট প্রতিনিধি হায়দার আলী বাবু)।    

No comments:

Post a Comment