Sunday, January 18, 2015

নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ ক্যাম্পাস দেখে না ইউজিসি:যুগান্তর

বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি’ ধানমণ্ডির ৩ নম্বর রোডের ১৫/২ নম্বর বাড়িতে পরিচালনার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি রাজধানীতে আরও ১৩টি আলাদা ঠিকানায় ক্যাম্পাস খুলে বসেছে। এসব ক্যাম্পাসের কোনোটিই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদিত নয়। আবার ধানমণ্ডির ৪(এ) এবং ৫(এ) নম্বর রোডের পৃথক দুটি ঠিকানায় ‘ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক’ পরিচালনার অনুমতি আছে ইউজিসি থেকে
। কিন্তু এটিও আরও ৯টি ঠিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি (এআইইউবি) একইভাবে ৭টি অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে, মাত্র ২৬ মাস আগে অনুমোদন পাওয়া সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির কারওয়ান বাজারের ২৯/১ এবং মহাখালীর ওয়ারলেস রেলগেটের ১৪৬ নম্বর বাড়িতে পরিচালনার অনুমতি থাকলেও তারা কারওয়ান বাজারে ৭১ নম্বর বাড়িতে আরও একটি ক্যাম্পাস খুলেছে, যেটির অনুমোদন নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এভাবে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ), উত্তরা ইউনিভার্সিটিসহ আরও বেশ কয়েকটি ‘ভালো’ ও ‘মধ্যম’ মানের দাবিদার বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ক্যাম্পাস রয়েছে যা সরকারের অনুমোদিত নয়। কিন্তু ইউজিসির নজরে নেই এসব ক্যাম্পাস। সম্প্রতি দু’দফায় ইউজিসি প্রকাশিত ‘বৈধ ও অবৈধ ক্যাম্পাস’ সংক্রান্ত দুটি পৃথক গণবিজ্ঞপ্তি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটে দেয়া ক্যাম্পাসের যাচাই-বাছাই করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ইউজিসি প্রকাশিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ ক্যাম্পাস সম্পর্কিত গণবিজ্ঞপ্তিতে মোট ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮টি ক্যাম্পাসের তথ্য প্রকাশ করা হয়। আরেক বিজ্ঞপ্তিতে ৭৮ বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ৮১টি) বৈধ ক্যাম্পাসের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই বিজ্ঞপ্তি দুটি প্রকাশের পর অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারীদের অনেকেই চাকরি এবং পেশাগত সনদ অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে। ইউজিসির চেয়ারম্যানই এ প্রতিনিধিকে বলেছেন, তাদের গণবিজ্ঞপ্তি জারির পর ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় এখন ছাত্রছাত্রী পাচ্ছে না। তবে এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনাকারীদের ইউজিসি যদি ধরতেই চায়, তাহলে ‘খারাপ ইমেজ’ রয়েছে এমন সব প্রতিষ্ঠানকেই শুধু ধরা হবে কেন? এক্ষেত্রে ‘ভালো ইমেজ’ রয়েছে এমন সব প্রতিষ্ঠান বাদ যাবে কেন? জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘এআইইউবির ক্যাম্পাসের ব্যাপারে আমাকে বলা হয়েছে যে, তাদের ক্যাম্পাসগুলো পাশাপাশি। সেগুলোকে ভবন বলা যায়, ক্যাম্পাসও বলা যায়। তারপরও আমরা অবৈধ ক্যাম্পাসের বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখব। আর ভালো বলে চিহ্নিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবৈধ কার্যক্রমের ব্যাপারে আমরা উদাসীন- এমন অভিযোগ সঠিক নয়।’ নাম প্রকাশ না করে ইউজিসি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল গড়ে উঠেছে। এরা ভালোর দাবিদার বিশ্ববিদ্যালয়সহ খারাপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও রক্ষা করে যাচ্ছেন। এর সর্বশেষ নমুনা হচ্ছে, রেটিং করার জন্য ইউজিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ (আকস্মিক পরিদর্শন) হয় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ওই পরিদর্শন রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবৈধ ক্যাম্পাসের তথ্য স্থান পায়নি। এই মহলটিই কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ কার্যক্রমকে হালাল করছে। এর বাইরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস-কারিকুলাম, বিভাগ, অনুষদ ইত্যাদি অনুমোদনসহ নানা কাজের ফাইল আটকে রেখে অনৈতিক ‘দাবি’ করার অভিযোগও রয়েছে। এ ব্যাপারে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটা ঠিক যে, দু’চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে হয়তো দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু শিক্ষার নামে অনৈতিক কাজে জড়িতদের আমরাই চিহ্নিত করেছি। সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার পরও আমরা অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ ক্যাম্পাস বন্ধ করেছি। তাই ব্যবস্থা যে নেয়া হয়নি, তা নয়। এরপরও যাদের ব্যাপারে নতুন করে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হবে।’ গত ৩০ জুন টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাতের কাজে ১১ ঘাটে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উত্থাপন করে। সূত্র জানায়, সংস্থাটি বর্তমানে ফলোআপ প্রতিবেদন করছে। এই প্রতিবেদন তৈরির আগে সংস্থাটি মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছে। কিন্তু তারা উন্নতি খোঁজ করতে গিয়ে রীতিমতো হতবাক হয়েছে। সূত্রগুলো জানিয়েছে, টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পর যদিও শিক্ষামন্ত্রী প্রথমে বিপক্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু পরে মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেটের মূল হোতাকে সম্প্রতি সরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া শাখা পর্যায়ে দুই কর্মকর্তাকেও বদলি করা হয়। বিষয়টি ইতিবাচক হলেও সিন্ডিকেটের ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ বহাল রয়েছে। সূত্র মতে, এ শাখায় দুর্নীতি কমেনি। বরং এখন ‘ঝুঁকি ভাতা’ (!) যুক্ত হয়ে রেট বেড়েছে। শাখায় নতুন আসা জনৈক আবুল কালাম আজাদ দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটিতে প্রশাসক নিয়োগ থেকে শুরু করে, ভিসি-প্রোভিসি-ট্রেজারার, অডিটর ইত্যাদি নিয়োগসহ নানা কাজের ক্ষেত্রে এক প্রকার প্রকাশ্যেই সেবা প্রার্থীদের কাছে ‘দাবি’ করছেন। দাবি না মিটলে এ ক্ষেত্রে চিঠি ও ফাইল ফেলে রাখা আর মেটানো হলে সচিবালয়ের গেটে গিয়ে চিঠি পৌঁছে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগ সংশ্লিষ্ট শাখার অতিরিক্ত সচিবের কানে পৌঁছলে তিনি আজাদকে ডেকে একদিন ধমকও দিয়েছেন। এসব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন আবুল কালাম আজাদ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে ঘাটে ঘাটে ঘুষ গ্রহণের যে অভিযোগ টিআইবির গবেষণায় উঠে আসে তার বেশকিছু রয়েছে ইউজিসিকেন্দ্রিক। অভিযোগের পর ইউজিসি একটি লোক দেখানো তদন্ত করায়। কিন্তু প্রতিবেদন প্রকাশের পর ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও ইউজিসির ওই শাখার একজন কর্মকর্তাকেও বদলি করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, এ শাখার একজন উপপরিচালক, একজন সিনিয়র সহকারী পরিচালক, তিন সহকারী পরিচালক এবং চেয়ারম্যানের দফতরের একজন সিনিয়র সহকারী পরিচালকের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। বিশেষ করে চেয়ারম্যানের দফতরের কর্মকর্তাটির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে সফরে গিয়ে সুবিধা আদায়, বিভিন্ন কমিটি ও অনুষ্ঠানে নাম বসিয়ে দিয়ে সম্মানী উপার্জন, চেয়ারম্যানের কাছ থেকে একই প্রকল্প থেকে বারবার বিদেশ সফর আদায়, বিধিবহির্ভূতভাবে বাসা বরাদ্দ নেয়া, চেয়ারম্যানের নাম ভাঙিয়ে ইউজিসিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এদের কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এর নেপথ্যে ইউজিসির একজন শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তার অভিযুক্তদের প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ কর্মকর্তা অভিযুক্তদের রক্ষার পাশাপাশি যেসব কাজে ‘অর্থ-সংযোগ’ রয়েছে, সেসব কাজের ভারও সিন্ডিকেটের সদস্যদের পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। সম্প্রতি ‘বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়’ (সিবিএইচই) পরিচালনার কাজ পাইয়ে দেয়ার ঘটনা তার অন্যতম। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কাজটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আর একজনকে সিবিএইচই’র কাজ দেয়া হলেও এর অনুমোদন প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। সেখানে দুর্নীতির সুযোগ কী রয়েছে? নিজের দফতরের কর্মকর্তার বারবার বিদেশ সফরে পাঠানো বা দেশের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় সফরে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইউজিসিতে এর আগে ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা সফরসঙ্গী হয়নি, কারণ তখন প্রতিমন্ত্রী দায়িত্বে ছিল না। সরকারের সব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাই তাদের সঙ্গে সফরে যান।  

No comments:

Post a Comment