বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন ঢাকা মেডিকেল কলেজের নবীন চিকিৎসক হাসিময় হাজরা ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক মানুষ। ১৯৬৯ সালে আদমজী পাটকলের শ্রমিকেরা কারফিউ ভেঙে বেরিয়ে পড়লে পাকিস্তানি সেনারা গুলি চালায়। মেডিকেল শেষ পর্বের ছা
ত্র হাসিময় তখন আদমজীতে ছুটে গিয়েছিলেন আহত ব্যক্তিদের সেবা করতে। নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নামের মতো ডা. হাসিময় হাজরার মুখটিও সব সময় হাসিময় থাকত। সাংবাদিক-সাহিত্যিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের পরিবারের সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে কখনোই প্রশ্রয় দেননি। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় যখন ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, তখন তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা ড্রেনের মোটা পাইপের মধ্যে লুকিয়ে থেকে আত্মরক্ষা করেছিলেন। এ ঘটনার পর তাঁর মা ও অন্যান্য ভাইবোন ভারতে চলে গেলেও তিনি যাননি, তাঁর বাবাও যাননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকে হাসিময় হাজরাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে পরামর্শ উপেক্ষা করে ঢাকাতেই থেকে যান। জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের কাজে। গোপনে আহত মানুষদের চিকিৎসাসেবা দিতেন। ডা. হাসিময় হাজরা থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে। ২৭ মার্চের পর থেকে তিনি কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের পরিবারের আশ্রয়ে ছিলেন। ২ মে দুপুরের দিকে তাঁর বাসা থেকে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের দিকে রওনা হন। তার পর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ তথ্য জানা যায় কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের মেয়ে ডা. কাজী তামান্নার ‘আমার ভাই’ রচনা থেকে। তামান্না আরও লিখেছেন, ‘...আমি বার বার তাকে অনুরোধ করি ঢাকা ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য। প্রথম প্রথম হাসিময় যেতে চায় নি। ওর এক কথা—বাংলাদেশের সবাই কি ওপারে যেতে পারবে? ও যে হিন্দু, ওর ব্যাপারটা যে একটু অন্যরকম সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। এই সময় ঢাকাতেই ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আমি বুঝতে পারতাম ও কিছু করছে, কিন্তু আমাকে পরিষ্কার করে কিছু বলে নি। এপ্রিলের আঠাশ-উনত্রিশ তারিখে আমাকে বলল—“দিদি আমি একটা কাজ নিয়ে মে’র চার-পাঁচ তারিখে ওপারে যাচ্ছি।” কিন্তু হাসির আর ভারতে যাওয়া হয় নি। দোসরা মে দুপুর দুটোর দিকে ওর সাদা ভেসপা নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে যায়। ও আর ফিরে আসে নি। সারারাত দারুণ উৎকণ্ঠায় কাটিয়ে পরের দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালের সুপারেনটেনডেন্টের সাথে দেখা করলাম। ও প্রফেসর লস্করের অধীনে কাজ করত। যদি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কোনো খবর নিতে পারি। কিন্তু সকলের এক কথা হাসিময় হিন্দু। সুতরাং তার খবর নেয়া যাবে না।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রকাশ ১৯৮৯, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)। প্রখ্যাত ফুটবল ও হকি খেলোয়াড় প্রতাপ শংকর হাজরা তাঁর দূর সম্পর্কের কাকা হতেন। একই গ্রামে তাঁদের বাড়ি। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, স্বাধীনতার পর ভারত থেকে ফিরে তিনি হাসিময় হাজরার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা অনুসন্ধান করেছিলেন। তিনি জানতে পারেন, রহমত বক্সার (মুষ্টিযোদ্ধা) নামে একজন অবাঙালির নেতৃত্বে কয়েকজন হাসিময় হাজরাকে পিজি হাসপাতালের সামনে থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে তারা হত্যা করে। হত্যার পর তাঁর মরদেহ তারা কয়েক টুকরো করে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দেয়। ১৯৪৬ সালের ২৩ জানুয়ারি হাসিময় হাজরার জন্ম। তাঁর বাবা অনন্ত মাধব হাজরাও ছিলেন চিকিৎসক। ঢাকেশ্বরী কটন মিলস ছিল তাঁর কর্মস্থল। অনন্ত মাধবের ভাই অমৃত লাল হাজরা ছিলেন ব্রিটিশ যুগের বিপ্লবী। এ জন্য তিনি দ্বীপান্তরও খেটেছেন। হাসিময় মিলের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ থেকে আইএসবি ও ১৯৭০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার দোগাছী গ্রামে। স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭) থেকে। গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান rashedtr@prothom-alo.info
No comments:
Post a Comment