Wednesday, March 11, 2015

জাতীয় সংগীত মা–মাতৃভূমির অনন্য বন্দনা:প্রথম অালো

চিরন্তন এক ভালোবাসার গান আছে বাঙালির। এই গান গর্ভধারিণী মাকে ভালোবাসার, মাতৃভূমিকে ভালোবাসার। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি এই গান গেয়ে। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। এখন বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে গলা ছেড়ে গায় এই ভালোবাসার গান। গানটি আপদে-বিপদে জোগায় সাহস ও প্রেরণা। উৎসবে, উদ্যাপনে বাঙালির গভীরতম হৃদয়াবেগ প্রকাশিত হয় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই গানে। এটি আমাদ
ের জাতীয় সংগীত, জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে গাওয়া হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। তবে তার আগে থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিতে পূর্ব বাংলায় গড়ে ওঠা আন্দোলনে গানটি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। গাওয়া হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে। এ প্রসঙ্গে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো ১৯৭১ সালে তো বটেই, এর আরও অনেক আগে থেকেই গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে গাওয়া হয়েছে। গানটি উদ্দীপ্ত করেছে, প্রেরণা জুগিয়েছে। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি প্রিয় গান। অনেক অনুষ্ঠানে তিনি গানটি গাইতে বলতেন। তিনি নিজেও অনেক সময় গুনগুন করে গানটি গেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকের স্মৃতিকথায় এর উল্লেখ আছে। বিশ্বকবির এই গানটি কেমন করে আমাদের জাতীয় সংগীত হলো, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত বলেন। তিনি বলেন, ‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি যখন শেষবারের মতো জনসভা করি, যেখানে ১০ লাখ লোক হাজির হয়েছিল আর “স্বাধীন বাংলা স্বাধীন বাংলা” স্লোগান দিচ্ছিল, তখন ছেলেরা গানটা গাইতে শুরু করে। আমরা সবাই, ১০ লাখ লোক দাঁড়িয়ে গানটাকে শ্রদ্ধা জানাই। তখনই আমরা আমাদের বর্তমান জাতীয় সংগীতকে গ্রহণ করে নিই।’ বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কবিও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেছিলেন বঙ্গভঙ্গের সময়, ১৯০৫ সালে, কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। তবে মূল পাণ্ডুলিপি না পাওয়ায় গানটি রচনার তারিখ পাওয়া যায় না। বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল ওই বছরেরই ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে এক অনুষ্ঠানে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) কবির স্বাক্ষরসহ সঞ্জীবনী পত্রিকায় গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়বার গানটি ছাপা হয় ১৩২২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। জমিদারি দেখভালের কাজে ১৮৮৯-১৯০১ পর্যন্ত বহুবার কবিগুরু কুষ্টিয়া, পাবনা, নওগাঁ এলাকায় আসা-যাওয়া করেছেন, থেকেছেন। তখন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আঙ্গিকের লোকগান, বাউল গানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ঘটে। পরে স্বদেশি আন্দোলনের সময় লেখা অনেক গানে তিনি পূর্ব বাংলার লোকগানের সুর ব্যবহার করেছেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিতে তিনি সুর প্রয়োগ করেছেন কুষ্টিয়ার লোককবি ডাকপিয়ন গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুরের অনুষঙ্গে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গীতবিতানের স্বদেশ পর্বে অন্তর্ভুক্ত। এর চরণসংখ্যা ২৫। জাতীয় সংগীত হিসেবে কোনো দ্বিরুক্তি ছাড়া ‘আমার সোনার বাংলা’ থেকে ‘আমি নয়ন জলে ভাসি’ পর্যন্ত প্রথম ১০ চরণ গাওয়া হয়। প্রথম চার চরণের যন্ত্রসংগীত বাজানো হয় বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে। জাতীয় সংগীত সম্পর্কে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এই গানে দেশের বন্দনা, ঋতু ও ভূ-প্রকৃতির বর্ণনা, দেশের প্রতি ভালোবাসার কথা তুলে ধরা হয়েছে। দেশকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই অনন্য গানটিকে আমরা জাতীয় সংগীত হিসেবে পেয়েছি।’ জাতীয় সংগীত কেবল বাঙালির জাতীয় ঐক্যের অন্যতম প্রতীকই নয়, গানটি নিয়ে বিশ্ব রেকর্ডও করেছে বাঙালি। গত বছর মহান স্বাধীনতা দিবসে ঢাকায় জাতীয় প্যারেড ময়দানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ব্যবস্থাপনায় ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ নামের অনুষ্ঠানে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের গাওয়া গানের এই বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে। যান্ত্রিক গণনা হিসেবে সেদিন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন লোক একসঙ্গে জাতীয় সংগীত গেয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান করে নিয়েছে। শুধু বিশ্ব রেকর্ডই নয়, বাঙালির জীবনে চিরপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে এই গান।

No comments:

Post a Comment