অবরোধ–হরতালে নাশকতার ঘটনায় সারা দেশে করা প্রায় দেড় হাজার মামলার মধ্যে তদন্ত শেষে ৪৫টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এতে বিএনপি-জামায়াতের সাড়ে আট শ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সব মামলাতেই যাতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে অলিখিত নির্দেশনা আছে। এ কারণে অবরোধ-হরতালে যেসব মামলার তদন্ত বাকি আছে, সেগুলোতেও যাতে অভিযোগপত্র দেওয়া যায়, সে ব্যাপ
ারে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। অবশ্য পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা এ ধরনের নির্দেশের কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেছেন, মামলা তদন্তের পর অভিযোগপত্র দেওয়া হবে, না চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে, সেটা তদন্তকারীর ব্যাপার। জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তকারীরা স্বাধীনভাবেই তদন্ত করছেন। তাঁদের তদন্তে কোনো হস্তক্ষেপ করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে সবাইকে বলা হয়েছে, প্রকৃত অপরাধী যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। পুলিশ সূত্র জানায়, গত ৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী বলে জানা গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে দেড় হাজার মামলা হয়েছে। এতে তিন হাজার ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে এবং চার হাজার ব্যক্তিকে বেনামে আসামি করা হয়েছে। প্রথম আলোর কাছে থাকা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৫ মার্চ পর্যন্ত তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়া ৪৫টি মামলার মধ্যে ঢাকা মহানগরে রয়েছে দুটি, ঢাকা রেঞ্জের জেলাগুলোতে ১২টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জের চার জেলায় চারটি, রাজশাহী বিভাগে একটি, সিলেটে ছয়টি, বরিশাল মহানগরে দুটি ও বরিশাল বিভাগে ১৮টি। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরে নাশকতার মামলা রয়েছে ৩৬৭টি। এর মধ্যে রমনা থানায় করা নাশকতার মামলায় ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক দুলাল চন্দ্র শীলকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আর লালবাগ থানার মামলার ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার হাজি আলতাফ হোসেনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পুলিশের সিলেট বিভাগের (মহানগর পুলিশ বাদে) ৩৮টি থানায় মামলা হয়েছে ৬০টি। এর মধ্যে সিলেট জেলার ১১ থানায় ১৫টি, সুনামগঞ্জের ১১ থানায় সাতটি, মৌলভীবাজারের সাত থানায় ১৬টি ও হবিগঞ্জের নয়টি থানায় ২২টি। এসব মামলার মধ্যে দ্রুত বিচার আইনে পাঁচটি ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটিসহ মোট ছয়টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ছয় মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের ২৫৩ নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। হবিগঞ্জের বাহুবল থানায় ৫ জানুয়ারি দ্রুত বিচার আইনে নাশকতার একটি মামলা করা হয়। ১২ জানুয়ারি ওই মামলায় ৫৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন থানা বিএনপির সভাপতি আকদ্দস মিয়া ওরফে বাবুল, থানা জামায়াতের আমির কাজী আবদুর রউফ বাহার, থানা জামায়াতের সেক্রেটারি জালাল উিদ্দন আকঞ্জি, থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আবদুল আহাদ কাজলসহ জামায়াত-বিএনপির ৫৪ জন নেতা-কর্মী। চুনারুঘাট থানার আরেকটি মামলায় বিএনপি, ছাত্রদল ও জামায়াতের ৪৭ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। সুনামগঞ্জের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানায় গত ৭ জানুয়ারি নাশকতার ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় ১৫ জানুয়ারি ২২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় দুজনকে। মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ‘বিএনপির নেতা-কর্মী’ উল্লেখ করা হয়। তবে কারও পদ বা পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা দেওয়া হয়নি। ২২ জনের মধ্যে সাব্বির আহমদ ও আবদুল মজিদ নামের দুজনের পূর্ণাঙ্গ নাম রয়েছে। সিলেটের কানাইঘাট থানায় দ্রুত বিচার আইনে দুটি মামলার অভিযোগপত্রে ৩৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে গ্রেপ্তার তিনজনই জামায়াত-শিবিরের কর্মী। অপর মামলায় ছয়জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ছয়জনের মধ্যে গ্রেপ্তার দুজন জামায়াত-শিবিরের কর্মী। বরিশাল মহানগর ও বিভাগে ২০টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। মহানগরের দুটি মামলার মধ্যে একটির অভিযোগপত্রে মহানগর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান, মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মশিউর রহমানসহ জেলা এবং মহানগর যুবদল ও ছাত্রদলের ১৩ জন নেতা-কর্মীর নাম রয়েছে। অন্যটিতেও ছাত্রদল ও যুবদলের সাত নেতা-কর্মীর নাম রয়েছে। বরিশাল বিভাগে ১৮টি মামলায় বিএনপি-জামায়াতের ১০৩ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। রংপুর বিভাগে চারটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধার সাঘাটা থানার একটি নাশকতার মামলায় ১৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাঘাটা থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মো. নূরুজ্জামান ওরফে টিটু ও সভাপতি মো. আহমেদ কবির ওরফে শাহীন। গাইবান্ধা থানার আরেকটি মামলায় বিএনপি-জামায়াতের আটজন নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়। নীলফামারীর সৈয়দপুর থানায় করা একটি মামলায় নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। তাঁরা সবাই বিএনপির নেতা-কর্মী। পঞ্চগড় থানায় করা আরেকটি মামলায় জামায়াতের ১৬ কর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। খোদ পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ স্বীকার করেছেন, চাপের মুখে এসব মামলায় অভিযোগপত্র দিলেও নাশকতার মামলাগুলোতে ঢালাওভাবে বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়ী করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু দেখা যাবে, বিচারে এসব মামলা টিকবে না। অথচ তদন্তের আগে দরকার ছিল বোমার কারিগর, সরবরাহকারী ও যারা রাস্তাঘাটে বোমা ছুড়ছে, তাদের শনাক্ত করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ সেটাই করতে পারেনি। জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের পরিচালক শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশকে ক্রমাগতভাবে রাজনৈতিক উদ্দশ্যে ব্যবহার করলে একটা বাহিনী হিসেবে দক্ষতা-যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। পুলিশের দক্ষতা ভোঁতা হলে এর খেসারত দিতে হবে জনগণকে। এভাবে চলতে থাকলে যখন আমরা অপরাধের শিকার হব, তখন পুলিশ চাইলেও আর অপরাধীদের খুঁজে বের করতে পারবে না।’
No comments:
Post a Comment