Saturday, April 11, 2015

ভালো বীজের উদ্যোক্তা:প্রথম অালো

বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করার সময় নাসরিন নাহার দেখলেন, সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই নারীর অসামান্য অবদান রয়েছে। কিন্তু কৃষির উন্নয়নে গুণগত বীজ উৎপাদনে তেমন ভূমিকা নেই। তাই চাকরি ছেড়ে তিনি মানসম্মত বীজ উৎপাদনে লেগে পড়লেন। সরকারি বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির তত্ত্বাবধানে প্রতিবছর ধান, গম, মসুর ডাল, আলু ও সরিষার বীজ উৎপাদন করছেন তিনি। চাকরি করে তিনি যা আয় করতেন, এখন তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আয় হয়। যশোরের ঝিকরগাছা উপ
জেলার পানিসারা গ্রামের নাসরিনের (৪৪) জন্য কাজটা শুরু করা সহজ ছিল না। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) গাজীপুর দপ্তর থেকে প্রজনন বীজ বা মা বীজ সংগ্রহ করে তা কৃষককে দেওয়া, এরপর কৃষক ওই বীজ থেকে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করলে সেগুলো কেনা, তারপর সরকারের বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির কাছ থেকে ওই বীজের গুণগত মানের সনদ নেওয়া, তারপর বাজারজাত। সব মিলিয়ে কঠিন কাজ। এর চেয়েও বড় ছিল ‘গ্রামের নারী হয়ে সারা দিন বাইরে বাইরে থাকা’। এটা শুরুর দিকে গ্রামের লোকজন তো বটেই, পরিবারের লোকজনও ভালোভাবে নেননি। তবু লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন নাসরিন। এখন তিনি গ্রামের নারী আর কৃষকদের কাছে উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। নাসরিন নাহার বলেন, ‘এলাকার নারীরা এখন আমার ওপর আস্থা রাখেন। সুবিধা-অসুবিধায় তাঁরা আমার কাছে ছুটে আসেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে জড়িত থাকায় অনেকের সমস্যার সমাধান করাও সম্ভব হচ্ছে। বীজ উৎপাদনের কাজ করে সামাজিক সম্মান যেমন বেড়েছে, তেমনি এসেছে আর্থিক সচ্ছলতাও।’ সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক পাস করে পরে বিএড করা নাসরিন ১৫ বছর বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেছেন। জানালেন, সম্ভবত তিনিই পানিসারা গ্রামের প্রথম স্নাতক পাস নারী। ২০০৬ সালে চাকরি ছেড়ে স্বামীর প্রতিষ্ঠিত উতসব (উৎপাদন, তথ্যপ্রযুক্তি, সম্প্রসারণ ও বাজারজাত) সিড ফার্মে কাজ শুরু করলেন। শুরু করলেন গুণগত মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের কাজ। ওই বীজ নির্দিষ্ট ডিলারের মাধ্যমে যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করেন।  নাসরিন জানালেন, উতসব ফার্মের চুক্তিবদ্ধ ২০ জন কৃষক আছেন। তাঁরা ফার্ম থেকে প্রজনন বীজ সংগ্রহ করে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করে আবার ফার্মের কাছে বিক্রি করেন। চুক্তিবদ্ধ কৃষক স্থানীয় গদখালী গ্রামের আজিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলামতি ধানের প্রজনন বীজ সংগ্রহ করে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করি। সেই বীজ ওই ফার্মেই বিক্রি করি। এতে সাধারণ কৃষকদের চেয়ে প্রতি মণ ধানে অন্তত ১০০ টাকা বেশি পাই।’ উতসব ফার্মের ব্যাপারে সরকারি বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির যশোর জেলা কর্মকর্তা পরেশ কুমার রায় বলেন, ‘নাসরিন নাহার তাঁর ফার্মের নামে গাজীপুর বিএডিসি দপ্তর থেকে প্রজনন বীজ সংগ্রহ করে উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট কয়েকজন কৃষককে দেন। বীজ বপন থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত আমরা কৃষকের খেত দেখভাল করি। এরপর ওই ফসল বিএডিসির গুদামে সংরক্ষণ করে বীজের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মান সন্তোষজনক হলে গুণগত মানসম্পন্ন হিসেবে উতসব সিড ফার্মের নামে ট্যাগ দেওয়া হয়।’ তিনি জানালেন, এখন ওই এলাকার অন্তত ৪৫ শতাংশ কৃষক নিজেদের ঘরে ধানের বীজ সংরক্ষণ করেন। বিএডিসির বীজের ওপর তাঁদের নির্ভরশীলতা কমেছে। সমিতি: নিজে সফল হয়ে থেমে থাকেননি নাসরিন। কৃষিতে নারীদের এগিয়ে নিতে গড়ে তুলেছেন উতসব অ্যাগ্রো মহিলা সমবায় সমিতি। সমিতিতে ২০০ নারী কৃষক সদস্য আছেন। প্রতি মাসের শেষ শুক্রবার বিকেলে স্থানীয় হাড়িয়া গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বীজ সংরক্ষণ ও চাষ পদ্ধতি নিয়ে নারী কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া পুষ্টি ও বাল্যবিবাহ নিয়ে আলোচনা হয়। নাসরিন জানালেন, এর বাইরে সমিতির প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতে ১০টি করে দেশি মুরগি ও পাঁচটি করে হাঁস থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিজের নলকূপের পানি যে জায়গাটায় জমে, তা পরিচ্ছন্ন করে মাছের চাষ করার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন মাছ চাষ শুরুও করেছেন। ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাড়িয়া গ্রামের সাজেদা খাতুন বলেন, ‘সমিতির বয়স এক বছরের মতো। প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে আমরা সঞ্চয় করছি। ইচ্ছা আছে, একটু বেশি টাকা হলে পুকুর বা কোনো বাঁওড় ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করব।’ স্থানীয় নাভারণ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বলেন, ‘ওই সমিতির বিভিন্ন কর্মসূচিতে মাঝে মাঝে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওরা খুবই ভালো কাজ করছে। বিশেষ করে নাসরিন নাহার দারুণ আত্মবিশ্বাসী।’ ফুলের বীজ সংরক্ষণ: ফসলের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি ফুলচাষিদের ফুলের বীজ সংরক্ষণ করেন নাসরিন। গত বছর নাসরিনের বীজ খামারের মাধ্যমে ফুলচাষিরা ৫০ হাজার গ্লাডিওলাস ও পাঁচ হাজার রজনীগন্ধা হিমাগারে সংরক্ষণ করেন। স্বীকৃতি: কৃষিতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক নাসরিনকে পুরস্কৃত করে। ওই বছরই নাসরিন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ‘পোস্ট হারভেস্ট এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ পান। বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান ‘বিবিসি জানালা’তে তাঁকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান হয়েছে। কৃষিতে নারীর অবদান নিয়ে বিটিভির টক শোতে অংশ নিয়ে কৃষিতে নারীদের এগিয়ে নিতে স্বল্প সুদে বড় আকারের ঋণের দাবি তোলেন। নাসরিনের এগিয়ে যাওয়া বিষয়ে স্বামী গদখালী ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ‘সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার কারণে গ্রামের অন্য নারীরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস দেখান।’ কৃষিতে তাঁর মতো উদ্যোগে নারীদের এগিয়ে নিতে বড় ধরনের মূলধনের দরকার হয় বলে জানালেন নাসরিন। এ জন্য সুযোগ পেলেই স্বল্প সুদে বড় আকারে ঋণসুবিধা দেওয়ার দাবি তোলেন তিনি। নাসরিন স্বপ্ন দেখেন—ভবিষ্যতে তাঁর ফার্মটি জাতীয় পর্যায়ে ভালো বীজ উৎপাদনের একটি প্রতিষ্ঠান হয়েছে। কৃষকেরা গুণগত মানসম্পন্ন বীজ দিয়ে ফসল ফলাচ্ছেন। নারীরা কৃষিতে এগিয়ে এসেছেন। গ্রামে কোনো অভাব নেই। নারীরা বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন।

No comments:

Post a Comment