Saturday, May 23, 2015

প্রচার না থাকায় অন্ধকারে ওষুধ:কালের কন্ঠ

'ডাক্তার সাহেব ওষুধ লিখে দেন; আমরা ফার্মেসি থেকে তা কিনে খাই। কিন্তু কোনটা আসল, কোনটা নকল তা জানতে পারি না। ওই ওষুধ ভালো না মন্দ তাও বুঝতে পারি না। একই জেনেরিকের বিভিন্ন কম্পানির ওষুধের মধ্যে গুণ-মানগত পার্থক্য নিয়েও আছে উদ্বেগ। কিন্তু ডাক্তার বা ফার্মেসির লোকজনের কাছে এসব ব্যাপারে বেশি জানতে চাইলে ধমক খেতে হয়। আবার নকল-ভেজাল ওষুধের ছড়াছড়িও দেখছি। নিজের টাকা খরচ করে ওষুধ খাব কিন্তু কী ওষুধ খাচ্ছি
না-খাচ্ছি তা জানার অধিকার থাকবে না- একজন রোগী বা ওষুধের ভোক্তা হিসেবে এটা হতে পারে না।' গত বুধবার সকালে ধানমণ্ডির ডায়াবেটিক হাসপাতালের সামনে রোগী হারুন অর রশিদ এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পাশে দাঁড়ানো কানাডাপ্রবাসী ব্যবসায়ী ডায়াবেটিক রোগী সুলতান আহম্মেদ যোগ করেন, 'টাকা দিয়ে ওষুধ খাব আবার ডাক্তারের ধমকও খাব, কী আজব দেশ আমাদের! বিদেশে তো দেখি ওষুধের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা হয়। বিশেষ কিছু ওষুধ বাদে বেশির ভাগ ওষুধেরই প্রচার চালানো হয় গণমাধ্যমে। কখন কোন রোগের কোন কম্পানির কী ওষুধ আসছে তা শুরু থেকেই মানুষের জানা থাকে। ফলে ওষুধ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি থাকে না, আবার ওষুধ নকল বা ভেজাল করারও সুযোগ থাকে না।' প্রবাসী এই ব্যবসায়ী বলেন, 'আমাদের দেশে ওষুধের ভোক্তাদের একরকম অন্ধকারে রাখার পেছনে ওষুধ কম্পানিগুলোর কারসাজি রয়েছে বলে মনে হয়। বিশেষ করে কম্পানিগুলোর ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে অসাধু বা অনৈতিক বাণিজ্যকে আড়াল করার স্বার্থেই ওষুধ নিয়ে প্রচারণা নেই বললেই চলে। এমনকি নতুন ওষুধ বাজারে ছাড়ার আগেও মানুষের মধ্যে এ সম্পর্কে কোনো রকম ধারণা এখানে দেওয়া হয় না।' অনেক জনস্বাস্থ্যবিদের মধ্যেও বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে একধরনের লুকোচুরি বা গোপনীয়তার অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক অধ্যাপক কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন সব ওষুধের প্রচারণা থাকা উচিত নয়, তেমনি পাল্টা সব ওষুধই গোপন করে রাখাও উচিত নয়। এটা রোগীদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। কারণ ওষুধের গুণগত মান সম্পর্কে সাধারণ মানুষ বা রোগী বা রোগীর স্বজনদের জানার অধিকার আছে। এ ছাড়া এ দেশে যেহেতু নকল-ভেজাল ওষুধের প্রবণতা বেশি, তাই এ ক্ষেত্রে মানুষকে সচেতন করা জরুরি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক চিকিৎসক বলেন, 'অনেক ওষুধের প্যাকেটের ভেতরে ওষুধের নানা দিক সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ বা লিটারেচার দেওয়া থাকে। কিন্তু রোগী বা ভোক্তারা ওই ওষুধ আস্ত বাক্স ধরে না কেনা পর্যন্ত তা দেখতে পারে না। আর বিভিন্ন কম্পানি যেসব প্রচারপত্র ছাপায় তাও কেবল আমাদের মধ্যেই বিতরণ করা হয়, যা সাধারণ মানুষকে দেওয়া হয় না। আবার অনেক কম্পানি পোস্টার আকারে ডাক্তারদের চেম্বারের ভেতরে বিভিন্ন ওষুধের প্রচার চালায়। পুরোটাই এক ধরনের লুকোচুরির মতো ব্যবস্থা।' ওই চিকিৎসক বলেন, ওষুধ কম্পানিগুলোর এমন আচরণের কারণেই সাধারণ মানুষ চিকিৎসক সমাজের বিরুদ্ধে ওষুধ কম্পানির সঙ্গে অনৈতিক স্বার্থকেন্দ্রিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে থাকে। রোগীরা যদি ওষুধ সম্পর্কে ধারণা পেতে চায় তাকে তা জানাতে হবে। এটা সরকারের দিক থেকেও দায়িত্ব। এ ছাড়া নতুন যেসব ওষুধ বাজারে আসছে সেগুলোর ব্যাপারে ডাক্তারদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারণা চালালে উপকারই বেশি হবে। ভালো খবর হলো, ওষুধ নিয়ে প্রচারণার বিষয়ে আগে রাখঢাক থাকলেও এখন খোদ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরই সরব হয়ে উঠেছে। গত ১০ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে 'ওষুধ শিল্পের বিকাশ, উন্নয়ন ও নকল-ভেজাল রোধকল্পে মতবিনিময় সভা'য় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত সুপারিশগুলোর মধ্যে বেশ জোর দিয়েই বলা হয়েছে, ওষুধের ব্যবহার সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব রয়েছে। ওষুধের অপব্যবহার এবং অপচিকিৎসা রোধে ও ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যবস্থা করা জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনীর উদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের কাছে খুবই অবাক লাগে, এখনো দেশে ৭৫ বছর আগের আইন ধরে ওষুধ সেক্টর চলছে। নকল-ভেজাল বা বিষাক্ত ওষুধ খাইয়ে মানুষ মেরে ফেললেও মাত্র কয়েক লাখ টাকা জরিমানা আর অল্প কয়েক দিনের সাজা হয়। কিন্তু এমন ঘটনায় তো মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। সেই একই মান্ধাতা আমলের আইনের অজুহাতে দেশে এখনো ওষুধের প্রচার-প্রচারণা অনেকাংশে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ওষুধের ওপর থেকে প্রচারণা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ যত দ্রুত সময়োপযোগী করা হবে ততই মানুষের উপকার হবে। মানুষ জেনে শুনে বুঝে ওষুধ সেবন করতে পারবে।' ওষুধ প্রশাসন সূত্র জানায়, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোনো ধরনের প্রচারমাধ্যমে ওষুধের কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স ১৯৮২-এর ১৪ ও ২১ ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে ওষুধ কম্পানি নিজ নিজ ওষুধ সম্পর্কে চিকিৎসকদের মাঝে প্রচারণা চালাতে পারবে। এ আইনের ফাঁকফোকর গলে বিভিন্ন স্মারক প্রকাশনার নামে প্রতিনিয়ত ওষুধের প্রচারণা চলছে। পাশাপাশি টেলিভিশনে এক শ্রেণির হারবাল ওষুধ ও ফুড সাপ্লিমেন্টের বিজ্ঞাপন চলছে দেদার। দেশের বাইরের অনেক ওষুধের প্রচারণাও চলছে টেলিভিশনের মাধ্যমে। আবার ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে মাঝে মধ্যেই বিশেষ কিছু ওষুধের প্রচারণা চালায় কোনো কোনো কম্পানি। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ওষুধের প্রচারণা সরাসরি নিষিদ্ধ নয়, শুধু কিছু বিধিনিষেধ আছে। কোনো ওষুধের কোনো রকম প্রচারণা চালাতে হলে তা অবশ্যই আগেভাগে ওষুধ প্রশাসন থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান কালের কণ্ঠকে বলেন, জেনেরিক নাম ব্যবহার ও জনস্বার্থে ওটিসি তালিকার আওতায় ওষুধের প্রচারণার ব্যবস্থা চালু হলে একদিকে নিম্নমানের ওষুধ বেচাকেনা বন্ধ হবে, অন্যদিকে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে দামও কমে যাবে। ওষুধ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে প্রযুক্তি ও উপাদান এনে এখানে তৈরি বা বাজারজাত করা সরকার অনুমোদিত জেনেরিক ওষুধের (অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক) সংখ্যা এক হাজার ২০০। প্রায় ২৬ হাজার ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করে এসব ওষুধ প্রস্তুত করছে ৮৬০টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কেবল অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানেই ব্র্যান্ড ওষুধের সংখ্যা প্রায় ২৩ হাজার। কিন্তু এর মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনো ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) তালিকা করা হয়নি। তবে প্রক্রিয়াধীন ওষুধ নীতিতে ৪০টি ওষুধের একটি ওটিসি তালিকার প্রস্তাব রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের আরেক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, যে ওষুধগুলো মানুষের সাধারণ রোগব্যাধির উপশম করতে পারে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম থাকে কিংবা অল্পস্বল্প ভুল হলেও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না, সেগুলোকেই ওটিসি আইটেম বলে ধরা হয়। এসব ওষুধ মানুষ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই প্রয়োজনমতো কিনতে পারে। বিশ্বের বহু দেশেই ওটিসি তালিকা করে ওষুধ বেচাকেনা হয়। এতে মানুষের হয়রানি কমে। তবে ওটিসি ওষুধের ব্যাপারে সচেতনতামূলক প্রচারণা দরকার। ওষুধ বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিবছরই বিভিন্ন কম্পানি নতুন অনেক ওষুধ বাজারে আনলেও ভোক্তারা তা জানতে পারে না। কম্পানিগুলো কেবল ডাক্তারদের হাত করে রোগীদের ওষুধ খাইয়ে যাচ্ছে, রোগীদের অন্ধকারে রেখে। সময়োপযোগী ও কার্যকর কোনো আইন ও নীতিমালা না থাকার সুযোগেই এমনটা হচ্ছে। বাজারে অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয়, নিম্নমানের বা ভেজাল ওষুধের ছড়াছড়ি; তেমনি চোরাই, নিষিদ্ধ বা ক্ষতিকর ওষুধের কারবার চলছে বেপরোয়াভাবে। মানুষের মধ্যে ওষুধ নিয়ে বাড়ছে বিভ্রান্তি ও হয়রানি। বাড়ছে ওষুধজনিত ক্ষতিকর রোগের মাত্রা। দামের ক্ষেত্রেও বিরাজ করছে নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি। কয়েক দিন পরপরই ওষুধের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। আবার রয়েছে একই ওষুধের নানা দাম। এ ছাড়া দেশি ও বিদেশি বাজারের জন্য পৃথক ওষুধ উৎপাদনের মতো অনৈতিক তৎপরতারও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেবল ওষুধ কম্পানির সংখ্যা, উৎপাদনের পরিমাণ কিংবা বিশ্ববাজারে রপ্তানির সাফল্যের দিক না দেখে পাশাপাশি উৎপাদন ক্ষেত্রে ওষুধের গুণগত মান সংরক্ষণ, ওষুধ ব্যবস্থাপনা, মূল্য নির্ধারণ, ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়, প্রচারণা, চিকিৎসক ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনৈতিক ভূমিকাসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে বড় ধরনের সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আর এর সব কিছুতেই অনেকটা স্বচ্ছতা তৈরি হতে পারে ওষুধ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো গেলে। এসব ক্ষেত্রে যতই গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে ততই দেশে নিম্নমানের বা নকল ভেজাল ওষুধের তৎপরতা বাড়বে।

No comments:

Post a Comment