Sunday, May 24, 2015

২০৩ জনকে আজই ফেরত পাঠাতে চায় মিয়ানমার:কালের কন্ঠ

আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনার মুখে সাগরে উদ্ধারকাজে নামা মিয়ানমার গত শুক্রবার দুই শরও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছিল। এরপর ঘটা করে তা প্রচারও করেছিল দেশটি।  মিয়ানমারের দাবি, তারা দুই শরও বেশি ‘বাঙালি’কে উদ্ধার করেছে। দেশটি তার জনগোষ্ঠী ‘রোহিঙ্গা’দের ‘বাঙালি’ বলে অভিহিত করে। তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা তো দূরের কথা, ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও মুখে আনতে চায় না মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এবার কথিত সেই ‘বাঙ
ালি’ ২০৩ জনকে ‘বাংলাদেশি’ বলে দাবি করে আজই ফেরত পাঠাতে মরিয়া দেশটি। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের কর্মকর্তারা একদল অভিবাসীকে বাংলাদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন। প্রায় দুই হাজার লোক সাগরে ভাসছে এবং তাদের বড় একটি অংশ মানবপাচারের শিকার বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সাগরে ভাসা ওই লোকদের বেশির ভাগই মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের মুসলমান রোহিঙ্গা। মিয়ানমার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে ‘বাঙালি’ বা ‘বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করে। মিয়ানমারের কর্মকর্তারা বলেছেন, গত শুক্রবার তাঁরা ২০৮ জন অভিবাসীকে সাগর থেকে উদ্ধার করেছেন এবং তাদের সবাই ‘বাংলাদেশি’। এএফপি ওই অভিবাসীদের জাতীয়তা নিশ্চিত করতে পারেনি। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের দপ্তরের পরিচালক জ তে গতকাল শনিবার এএফপিকে বলেছেন, ‘আমরা তাদের মানবিক সহায়তা দিচ্ছি। এরপর আমরা তাদের দেশে পাঠাব।’ তিনি বলেন, ‘ওই ব্যক্তিদের মিয়ানমারে আসা প্রসঙ্গে আমরা বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।’ এদিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, সম্প্রতি অভিবাসী সংকট শুরু হওয়ার পর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশ থেকে বারবার ফোন করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। আরো একটি দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এমন সমস্যায় পড়েছে। অবৈধ অভিবাসন বা রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে দেশকে ডেকেও এত দিন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি, সেই দেশই এখন নিজে থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তড়িঘড়ি কথিত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে চাচ্ছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কক্সবাজার সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মো. খালেকুজ্জামান গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। একটু আগেও কথা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তারা (মিয়ানমার) জানিয়েছে, যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে ২০৩/২০৪ জন বাংলাদেশি। আমরা তাদের বলেছি তালিকা দিতে। নিশ্চিত হতে চাই তারা আসলেই বাংলাদেশি কি না।’ তিনি আরো বলেন, ‘রবিবার (আজ) মংডুতে যাওয়ার জন্য তারা (মিয়ানমার) আমন্ত্রণ জানিয়েছে।’ বিজিবি ও সরকারি অন্য সূত্রগুলো জানায়, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা বাংলাদেশি কি না তা নিশ্চিত না হয়ে ফিরিয়ে আনা ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক যে প্রক্রিয়া আছে তা-ই অনুসরণ করা উচিত। তাই আজ রবিবার বিজিবি দলের মংডু যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরো জানায়, ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে নিশ্চিত হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তবে নিশ্চিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। ‘বাঙালি’ অভিহিত করে রোহিঙ্গাদের দায় বাংলাদেশের ওপর চাপাতে চায় মিয়ানমার কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি মিয়ানমারের কাছে স্পর্শকাতর হওয়ায় দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ (মিয়ানমার ন্যাশনালস) হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ। গত বছরের ৩০ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল মিয়ানমারে আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেই আদমশুমারি শুরুর আগের দিন অর্থাৎ ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ দেশটির সরকার ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে নিবন্ধনের আহ্বান জানায়। মিয়ানমারে স্বীকৃত ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীর মধ্যে ‘রোহিঙ্গা’দের স্থান হয়নি। ‘বাঙালি’ হিসেবে নিবন্ধিত হলে ভবিষ্যতে কোনো দিন বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হবে এমন আশঙ্কায় রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ আদমশুমারির প্রতি আগ্রহী ছিল না। রোহিঙ্গারা ‘বাঙালি’ বা তারা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ঢুকেছে-এমন বক্তব্য মিয়ানমারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ বা রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন সময় দিয়েছেন। ২০১২ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির নেত্রী (বর্তমানে বিরোধী নেত্রী) অং সান সু চি ভারত সফরের সময় বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নয়। সুচির দাবি, তারা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ঢুকেছে। সু চির এমন বক্তব্য নজরে আসার পর বাংলাদেশ তা নাকচ করে। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান হলো, ‘ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণে দেখা যায়, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর জনগণ কয়েক শতাব্দী ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তার আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত ওই লোকজনকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো কারণ নেই।’ তা ছাড়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই মিয়ানমারের নাগরিকরা অভ্যন্তরীণ কারণে সেখান থেকে এ দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। সর্বশেষ বড় ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৯১-৯২ সালে। সে সময় দুই লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমার, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ও বাংলাদেশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় পরিচয় যাচাই করেই মিয়ানমার সরকার শরণার্থীদের মধ্যে দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জনকে ফেরত নেয়। অবশিষ্ট শরণার্থী ও তাঁদের সন্তানরা বাংলাদেশের দুটি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের যুক্তি, মিয়ানমার সরকার তার দেশের রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জনকে নিজস্ব যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গ্রহণ করেছে। তাই তারা যে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে এবং তারা যে বাঙালি নন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। গত বছর ঢাকায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে মিয়ানমার এর আগে নাগরিক হিসেবে নিশ্চিত করা দুই হাজার ৪১৫ জনকে ফিরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু তা এখনো ঝুলে আছে। বাস্তবতা হলো ২০০৫ সালের পর মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি। কক্সবাজার জেলার দুটি আশ্রয় শিবিরে প্রায় ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। এর বাইরে শরণার্থীর মর্যাদা পায়নি এমন রোহিঙ্গার সংখ্যা পাঁচ লাখ পর্যন্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এ দেশে এসে পরে তাদের অবৈধভাবে অন্যত্র চলে যাওয়ার খবরও বিরল নয়। বরং সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধভাবে সাগরপথে বিদেশ যাওয়ার পথটিও রোহিঙ্গাদের দেখানো বলে মনে করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অতীতে বিভিন্ন সময় বিদেশে অবৈধ অভিবাসনের সময় ধরে পড়ে নিজেদের ‘বাংলাদেশি’ বলে দাবি করা অনেকেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাদের বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনবে না। এ দায়িত্বও ঢাকার নয়। মিয়ানমার যদি এখন নিজ দেশের রোহিঙ্গাদের সাগর থেকে উদ্ধার করে ‘বাঙালি’ বা ‘বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়, তাহলে এ সমস্যার সমাধান আরো কঠিন হবে।  

No comments:

Post a Comment