মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের ঝুঁকি রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় মানি লন্ডারিংয়ের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশংকাও আছে। এ ছাড়া আছে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে জাল-জালিয়াতি বৃদ্ধির ভয়। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের আশংকা করা হচ্ছে। যা একসময় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালিত তদন্ত প্রতিবেদনে এস
ব মন্তব্য করা হয়েছে। প্রতিবেদনে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের বেশকিছু জাল-জালিয়াতির ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে। মানব পাচারের অর্থায়নেও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা কাজে লাগানো হচ্ছে বলে পৃথক একাধিক সূত্র আশংকা প্রকাশ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডাচ্-বাংলা ও বিকাশের মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে দিনাজপুর, নওগাঁ, নাটোর ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে কক্সবাজার ও টেকনাফের বিভিন্ন এজেন্টের কাছে বিপুল অংকের টাকা পাঠানোর তথ্য পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমেও ওই সব অঞ্চলে টাকা পাঠানোর তথ্য মিলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো এক বছর ধরে ব্র্যাক, ডাচ্-বাংলা, পূবালী, ইউসিবিএলের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোয় তদন্ত করে প্রায় ১৭৮ কোটি টাকা স্থানান্তরের তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক ৩৪ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২৬ কোটি, ইউসিবিএল ১৮ কোটি, পূবালী ব্যাংক ১৭ কোটি টাকা, বাকি টাকা অন্যান্য ব্যাংক স্থানান্তর করেছে। এই টাকার বড় একটি অংশ মানব পাচারে ব্যবহৃত হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল আশংকা প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক পুরো টাকার লেনদেন নিয়েই সন্দেহ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, ব্যবসায়িক কাজে টাকা দু’দিকেই লেনদেন হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে টাকার একমুখী লেনদেন হয়েছে। যা সন্দেহজনক। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে টাকা বিশেষ করে কক্সবাজার অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু কক্সবাজার অঞ্চল থেকে কোনো টাকা ওই সব জেলায় যায়নি। লেনদেনের অংকগুলো খুব ছোট ছোট। বেশিরভাগ লেনদেনই হয়েছে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। সূত্র জানায়, সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরে মানব পাচারের যে রুট আবিষ্কৃত হয়েছে তার গডফাদাররাই এসব টাকার সুবিধাভোগী ছিল। ওই সব জেলার যেসব নাগরিক অভিবাসী হয়ে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর যেতে আগ্রহী হয়েছেন তারাই প্রয়োজনীয় টাকা কক্সবাজারের বিভিন্ন ব্যাংকে পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া টাকার একটি অংশ চোরাচালানের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সন্দেহ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেভাবে টাকা স্থানান্তর হচ্ছে এতে দেশের আইনশৃংখলাজনিত সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। এসব কারণে প্রতিবেদনে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং নিরাপদ করতে আরও আধুনিক ও নিরাপত্তামূলক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং আইনি কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, এসব ব্যাংকিং পরিচালিত হতে হবে মূল ব্যাংকের মাধ্যমে এবং এর ভালো-মন্দের সব দায় ব্যাংককেই নিতে হবে। প্রতিবেদনে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের বেশকিছু জাল-জালিয়াতির ঘটনা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে মোবাইল ফোনের সিম চুরি করে ব্র্যাক ব্যাংকের একজন গ্রাহকের হিসাব থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে ব্র্যাক ও ইস্টার্ন ব্যাংকে গ্রাহকের টাকা খোয়া যাওয়ার তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সফটওয়্যার কারসাজির মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায়ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এটি এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। একই ধরনের একটি অনিয়ম সিটি ব্যাংকেও ধরা পড়েছে। বিষয়টি এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করছে। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ইউসিবিএলের গ্রাহকদের প্রায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহকের কেওয়াইসি সংরক্ষণ করা হয় না এবং মানা হচ্ছে না টাকা লেনদেনের সীমা। ডাচ্-বাংলা, ইসলামী, মার্কেন্টাইলের মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনেও বড় ধরনের ত্র“টি রয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির কারণে ইতিমধ্যে প্রাইম ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনাকারী ১৯টি ব্যাংকের মধ্যে ডাচ্-বাংলা ও ইসলামী ব্যাংক ছাড়া অন্য ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ তদারকি ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। এর আগে সোনালী ব্যাংকের লন্ডন শাখার সফটওয়্যারে ঢুকে আড়াই লাখ ডলার চুরি করা হয়েছে। যার কোনো গতি করতে পারেনি সোনালী ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অনিয়ম যেহেতু ধরা পড়েছে, সেহেতু একটি বিষয় প্রমাণিত যে আমরা ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, যেসব ব্যাংকে অনিয়ম বা নিয়মের ব্যত্যয় পাওয়া গেছে সেসব ব্যাংককে সর্তক করা হয়েছে। প্রচলিত নিয়ম মেনে ব্যাংকিং করতে না পারায় ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে। তবে আমরা বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রাখছি। যাতে কোনো অনিয়ম হতে না পারে। তার মতে, যেসব অনিয়ম রয়েছে, তা আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। একদিনে তো আর এ সমস্যার সমাধান হবে না। তবে অনিয়ম ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিকাশের মুখপাত্র জাহেদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস নীতিমালা মেনে চলা হয়। এর মধ্যে এজেন্ট কেওয়াইসি ফর্মে ছবির সঙ্গে গ্রাহকের চেহারা মিলিয়ে দেখেন। পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বা অন্যান্য ফটো আইডিতে দেয়া ছবি ও ঠিকানার সঙ্গে কেওয়াইসি ফর্মের ছবি ও ঠিকানা যাচাই করে দেখা হয়। তবে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টটি সক্রিয় করার সময় মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেসে প্রবেশাধিকার পেলে সংশ্লিষ্ট তথ্য আরও কঠোরভাবে যাচাই করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা এখনও রয়েছে। জানা গেছে, প্রচলিত নিয়মানুযায়ী মোবাইল ফোনের একটি সিম দিয়ে একজন গ্রাহক কোনো ব্যাংকে একটি মাত্র অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। কিন্তু এ বিধি মানা হচ্ছে না। একই সিমের বিপরীতে একাধিক অ্যাকাউন্ট খোলার নজির কেন্দ্রীয় ব্যাংক শনাক্ত করেছে। নিয়মানুযায়ী একজন গ্রাহক দিনে এক দফায় সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা অন্য ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করতে পারবেন। দিনে পারবেন ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। গ্রাহকরা লাখ টাকার বেশি স্থানান্তর করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়মানুযায়ী প্রতিটি গ্রাহকের সংক্ষিপ্ত কেওয়াইসি এজেন্টের কাছে থাকতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেওয়াইসি পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কারা লেনদেন করছে তা জানা যাচ্ছে না। যা প্রচলিত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের লংঘন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হিসাব খোলার ক্ষেত্রে সিমের সঠিকতা, গ্রাহকের পরিচয় সম্পর্কেও নিশ্চিত হয়ে নেয়া হয় না। যে কারণে টাকা স্থানান্তরের ঝুঁকি রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ফি বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন নিজেদের বিভিন্ন ফি ও চার্জ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিচ্ছে। তারা এগুলো এখন কাউন্টারে নিচ্ছে না। ফলে গ্রাহক হয়রানি বাড়ছে। বেসরকারি খাতের ইউসিবিএল যানবাহনের বিষয়ে বিভিন্ন ফি মোবাইল ব্যাংকিং ছাড়া ক্যাশে নিচ্ছে না। তাদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পাঠাতে খরচ করতে হচ্ছে হাজারে কমপক্ষে ২৫ টাকা। এ ছাড়া গ্রাহকের নিজস্ব অ্যাকাউন্ট না থাকলেও অন্য অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্যাংকের এজেন্টরা টাকা স্থানান্তরে সহায়তা করছেন। যা নিয়মের লংঘন। প্রতিবেদনে বলা হয়, মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের হিসাব রাখা হয় এজেন্টের কাছে। কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যাংকের কাছে তা থাকে না। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত সুবিধা দিচ্ছে মোবাইল কোম্পানিগুলো। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির জটিলতায় গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা খোয়া যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এ ব্যাপারে ব্যাংক বা এজেন্ট কেউই দায়িত্ব নিচ্ছে না। ফলে এ ক্ষেত্রেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা এমনভাবে পরিচালিত হচ্ছে, এজেন্টের অন্য ব্যবসার সঙ্গে এটি একটি সহযোগী ব্যবসা হিসেবে চলছে। যাতে ব্যাংকের কোনো আমেজ নেই। ফলে এতে টাকা জমা ও তোলার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এসব সমস্যা এড়াতে প্রতিবেদনে কয়েক দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহকের লেনদেনের সমুদয় দায়দায়িত্ব ব্যাংককে নিতে হবে। প্রত্যেক গ্রাহকের কেওয়াইসি নিশ্চিত করতে হবে। গ্রাহকের পরিচিতি নিশ্চিত করতে হবে। সিমের রেজিস্ট্রেশন বা এর সঠিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। লেনদেনের রেকর্ড ব্যাংকের কাছে সংরক্ষণ করতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব বিষয়ে মোবাইল কোম্পানি, ব্যাংক ও সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে নীতি প্রণয়নেরও সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যমান নীতিমালাও সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের বিকাশ ঘটায়, এর মাধ্যমে লেনদেন বাড়ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ কোটি টাকার মতো লেনদেন হচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকার বেশি। গত ডিসেম্বরে বিকাশের মাধ্যমে দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ২৭০ কোটি, ডাচ্-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ৭৫ কোটি, ইউসিবিএলের ইউক্যাশের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা। বাকি লেনদেন হচ্ছে অন্যান্য ব্যাংকের মাধ্যমে। বর্তমানে ২৮টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি ব্যাংক তা চালু করেছে। এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে এ সেবা দেয়া হয়। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এজেন্টের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। গ্রাহক সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। এর মধ্যে সক্রিয় গ্রাহক প্রায় ১ কোটি।
No comments:
Post a Comment