দেশের প্রায় অর্ধশত ছোট রাজনৈতিক দলের বেশির ভাগই আরো ছোট হয়ে আসছে দিন দিন। এসব দল সাইনবোর্ডসর্বস্ব ও এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। ছোট কয়েকটি দলের দৈনন্দিন কিছু কর্মকাণ্ড থাকলেও অন্যগুলোর নেই। মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে বেশির ভাগ ছোট দল। তাদের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কোনো কর্মসূচিই চোখে পড়ে না। তবে কোনো কোনো ছোট দলের বড় নেতাকে আবার নিয়মিত দেখা যায় টেলিভিশনের টক শোতে। এসব দলের একমাত্
র বড় নেতা ছাড়া অন্য কোনো নেতার পরিচয়ই জানে না সাধারণ মানুষ। এমন অনেক দল রয়েছে যাদের দলীয় কার্যালয় পর্যন্ত নেই। কয়েকটি দল ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা ব্যবহার করলেও বেশির ভাগ ঠিকানাই আসলে দলীয় নেতাদের বাসার। কোনো কোনো দল আবার কোনো রকমে পরিচয় টিকিয়ে রেখেছে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দু-একজন নেতা ছাড়া কোনো কর্মী নেই এমন দল রয়েছে এক ডজনের বেশি। কিছু বামপন্থী দল নিয়মিত মিছিল-মিটিং করলেও সাংগঠনিক বিস্তার বা বিকাশ নেই তাদের। বরং দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে দলগুলো। তাদের অবস্থা এমন যে জাতীয় নির্বাচনে কিছু কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা অংশ নিলেও বড় নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন না ভোট না পাওয়ার ভয়ে। এর বাইরে অনেক ছোট দল আছে যারা নির্বাচনেই অংশ নেয় না। তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দুটি ছোট দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব পেয়েছে আওয়ামী লীগের বদান্যতায়। ছোট দলগুলোর এ ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার জন্য কয়েকটি কারণকে বড় করে দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাজনীতিকরা। এসবের মধ্যে আছে নেতৃত্বের দুর্বলতা, বড় নেতাদের পদ আঁকড়ে রাখার চেষ্টা, জনসম্পৃক্ততার অভাব, রাজনৈতিক আদর্শ-উদ্দেশ্য জনগণের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে না পারা, বড় দলের লেজুড়বৃত্তি এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় দলগুলোর প্রাধান্য ও দুর্বৃত্তায়ন। ছোট দলগুলোর কয়েকজন নেতা আবার তাঁদের প্রসার না হওয়ার পেছনে গণমাধ্যমের অসহযোগিতার অভিযোগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের দেশে যেসব রাজনৈতিক দলের কথা শুনি- যেমন, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (জেপি), মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি। এসব দল রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। এর পরও তারা টিকে আছে। এসব ছোট দল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তাদের ওপর নজরদারি করা উচিত। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন নেবে কিন্তু নির্বাচন করবে না- এটা বড় ধরনের অনিয়ম। এসব রাজনৈতিক দলের সত্যিকার অবস্থা কী, তা খুঁজে বের করা উচিত।' দেশের রাজনৈতিক দুর্দশার জন্য তিনি ছোট দলগুলোকেও দায়ী করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, এ ধরনের দলগুলো প্রকৃতপক্ষে লক্ষ্যচ্যুত। নিবন্ধন নেওয়া-দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কঠোর হলে হঠাৎ করেই দল গঠন করা এবং একটি সাইনবোর্ডের মালিক বনে যাওয়ার সংস্কৃতি থাকবে না। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার তৃতীয় রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ নেন কয়েকটি ছোট দলের কয়েকজন বড় নেতা। তাঁদের মধ্যে আছেন গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিকল্প ধারার প্রধান ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, এলডিপির প্রধান অলি আহমদ, জেএসডির আ স ম আব্দুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া এগোয়নি। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে নিজেদের ভেতরে চরম অমিলের কথা। কয়েকটি ছোট দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত ঐক্যপ্রক্রিয়া চালু রাখার চেষ্টা করেন মাহমুদুর রহমান মান্না। সে চেষ্টাও সফল হয়নি। এ বিষয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি কাজ করতে গিয়ে দেখেছি মানুষ তৃতীয় শক্তির উত্থান চায়। কিন্তু আমাদের ভেতরের কিছু দুর্বলতা আমাদের বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে।' ছোট দলগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বছরের পর বছর পার করলেও সাংগঠনিক বিস্তার নেই এসব দলের। রাজনৈতিক মাঠে কোনো কর্মকাণ্ডই নেই। নামসর্বস্ব তারা। কমিটমেন্টেও ঘাটতি রয়েছে। মান্না আরো বলেন, 'দলগুলো ছোট, ফলে তৎপরতাও কম। তা ছাড়া অনেক দল প্রান্তিক হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির তৎপরতা যেমন মানুষ খুঁজে বেড়ায়, তেমনি এসব দলের তৎপরতা মানুষ আগ্রহ নিয়ে খোঁজে না। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়ন ভীষণভাবে গ্রাস করেছে। ফলে ছোট দলগুলো লড়াই করে টিকে থাকতে পারছে না। তবে মানুষ নতুন কিছু চায়।' ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক আদর্শ-উদ্দেশ্য জনগণের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে না পারা, সাংগঠনিক শক্তি বিকশিত করতে না পারা, নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় দলগুলোর প্রাধান্য থাকায় ক্ষুদ্র দলগুলো জায়গা করে নিতে পারে না। প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী বলেন, 'আমাদের দেশে বড় দল, ছোট দল কারোরই কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। বড় দলগুলোরও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। শুধু বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হতে পারে না। দেশের জন্য, সমাজের জন্য কর্মকাণ্ড প্রকৃতপক্ষে বড়-ছোট কোনো দলের মধ্যেই নেই। বিস্তরভাবে ছোট দলগুলো কাজ করবে সে পরিবেশ-পরিস্থিতিও দেশে নেই।' তিনি বলেন, 'ছোট রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড চোখে না পড়ার পেছনে মিডিয়া দায়ী। মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি বড় দলগুলোর পেছনে।' কোরেশী আরো বলেন, 'বড় দল, ছোট দল কথা নয়, রাজনীতির সামগ্রিক স্বাস্থ্য রুগ্ণ। এটা কাটিয়ে উঠতে না পারলে অবস্থা আরো খারাপ হবে।' জানতে চাইলে জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যেই আমাদের জন্ম। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে থাকার কারণে আমাদের মতো দলগুলো টিকতে পারছে না।' তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাপী আদর্শিক পরিবর্তনের ধারা, দল ভাঙা ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। মিডিয়ার বৈরী আচরণও আমাদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। তবে চেষ্টা চলছে এগিয়ে যাওয়ার। আশা করি সুফল পাব।' কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেন, 'এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আমি এখন একটি লেখা নিয়ে অনেক ব্যস্ত।' এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনও। অভিযোগ আছে, গত পাঁচ বছরে রাজনৈতিক-সামাজিক বিভিন্ন সংকট দেখা দিলেও সেসব নিয়ে মাঠে-ময়দানে দেখা যায়নি ন্যাপের মোজাফফর আহমেদ, গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জেএসডির আ স ম আব্দুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী, বিকল্প ধারার ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও এলডিপির অলি আহমদকে। তবে টেলিভিশন টক শো, বিবৃতি ও ফ্যাঙ্, ই-মেইলে তাঁদের বক্তব্য ছিল চোখে পড়ার মতো। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে চাননি ড. কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর রব ও কাদের সিদ্দিকী। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ৪৫টি সংগঠন রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন নেয়।
No comments:
Post a Comment