ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) সারা দেশ থেকে গড়ে প্রতিদিন চার-পাঁচজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছে। প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই শতাধিক ধর্ষিতার চিকিৎসা দিতে হচ্ছে সেখানে। এ তথ্য ওসিসি থেকে পাওয়া। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫৫৪টি অভিযোগ রুজু হয়েছে। এর
মধ্যে রাস্তা থেকে অপহরণ করে গাড়ির মধ্যে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মামলাও রয়েছে বেশ কয়েকটি। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে সারা দেশে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। তবে অপহরণ করে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে। সমিতির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশেই নারী নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অপহরণের পর নারীদের ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। বিশেষজ্ঞদের এসব পরিসংখ্যান ও মন্তব্যের পাশাপাশি গত বেশ কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণেও দেখা যায়, রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ প্রবণতা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। চলন্ত গাড়িতেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন অনেকে, কাউকে বা হত্যা করে লাশ ফেলা হচ্ছে ডাস্টবিনে, ড্রেনে। কিন্তু অপরাধে জড়িতরা থেকে যাচ্ছে অধরা। পুলিশ এ ধরনের ঘটনার পর তাদের ভাষায় তৎপরতা বাড়ালেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধী শনাক্তের কাজটাই হচ্ছে না। আর যেসব ক্ষেত্রে ভিকটিমের সহায়তায় অপরাধী চিহ্নিত হচ্ছে সেসব ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারে চলছে ঢিলেঢালা অভিযান। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে বিস্তার লাভ করা ভয়ংকর এ অপরাধ নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ ও আতঙ্ক। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঘটনার শিকার হচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গার্মেন্টকর্মী অথবা নিম্ন আয়ের কর্মজীবী নারী, যাদের মধ্যে অনেকেই ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। এদের পাশাপাশি কলেজছাত্রীরাও এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ, এর ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে দেওয়াসহ এ ধরনের অপরাধের বেশ কিছু অভিযোগ স্থানীয় থানার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পেঁৗছেছে। সেসব পর্যালোচনা করে ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্র্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধীদের ক্ষমা নেই। তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনায় রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে নারী নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ধরনের অপরাধে ব্যক্তিগত বিরোধের পাশাপাশি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ও রয়েছে। তাই সবার আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের অপরাধে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে অপহরণ করে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও বেশ কয়েকটি ঘটেছে। গত সপ্তাহেই রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে এক কলেজছাত্রীকে অপহরণ করে নির্যাতন চালানো হয়েছে চলন্ত মাইক্রোবাসের ভেতরেই। এর আগে উত্তরা এলাকায়ই পথচারী তিন নারীকে জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া সম্প্রতি রাজধানীর কমলাপুর, মতিঝিল, সূত্রাপুর, খিলগাঁও, হাজারীবাগ, রামপুরা ও খিলগাঁও এলাকায় আরো ১১ নারীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ রয়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি ক্রমে ভয়াবহ হয়ে উঠছে। থানায় মামলা হলেও আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে একই আসামি বারবার একই অপরাধ করছে। এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রাস্তায় নারীদের চলাচল অনিরাপদ হয়ে উঠবে। কিছু অপরাধীকে গ্রেপ্তারের পর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি নিসারুল আরিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। সম্প্রতি উত্তরা এলাকায় তিন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করার তথ্য মিলেছে। আরো কয়েক নারীকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ ঘটনায় মাদকাসক্ত অপরাধীরা জড়িত বলে তথ্য মিলছে। ধর্ষণের পর হত্যার বিষয়টি সাধারণ নাগরিকদের জন্যও হুমকির কারণ হয়ে উঠছে। ঘটনার পরপরই অপরাধীরা এলাকা বদল করে অন্যত্র চলে যায়, ফলে তাদের খুঁজতে বেগ পেতে হয়। এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযুক্ত অন্যদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সমন্বয়কারী চিকিৎসক বিলকিস বেগম জানিয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচজন নারী দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্ষণের শিকার হয়ে ওসিসিতে আসছে। তাদের অনেকেই রাতে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ঘটনার শিকার হয়। যশোর, সাভার ও ঢাকার কমলাপুরসহ কয়েকটি এলাকায় গাড়িতে ধর্ষণের শিকার বেশ কয়েকজন নারী ওসিসিতে চিকিৎসা নিয়েছে। আইনগত সহায়তাও তাদের দেওয়া হচ্ছে। গত ৩ জুলাই রাত ১১টার দিকে উত্তরায় ঘটে কলেজছাত্রী অপহরণের ঘটনা। এক নিরাপত্তাকর্মীকে খুন করে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টের থেকে ওই কলেজছাত্রীকে অপহরণ করা হয়। তাকে চলন্ত মাইক্রোবাসে নির্যাতন করে ভোরে উত্তরা এলাকাতেই ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। এ ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের পুলিশ এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি। শুধু সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুলিশ সূত্র আরো জানায়, গত ৮ জানুয়ারি সকালে উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ৩/এ সড়কের ১ নম্বর বাড়ির সামনের ডাস্টবিন থেকে বস্তাবন্দি এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে নখের আঁচড় ও গলার ডান পাশে আঘাতের চিহ্ন দেখে তিনি ধর্ষণের পর হত্যার শিকার বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তাঁর পরিচয় উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। আর অপরাধীদের ব্যাপারেও তথ্য মেলেনি। ১২ জানুয়ারি উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের একটি ড্রেনে মেলে আমেনা বেগমের (৩৩) বস্তাবন্দি লাশ। তিনিও একই ধরনের ঘটনার শিকার বলে প্রাথমিক তথ্যে জানা যায়। পরে নানা সূত্রে পুলিশ নিশ্চিত হয়, একটি অপরাধী চক্র তাঁকে অপহরণের পর নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে ঘটনা চাপা দিতে ইট দিয়ে মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করে তাঁকে হত্যা করে। এর আগে গত ১৪ নভেম্বর উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের অন্য একটি বাড়ির পেছন থেকে খাদিজা বেগম (৩১) নামে আরেক নারীর বস্তাবন্দি লাশ পাওয়া যায়। তাঁকেও ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর লাশ একাধিক টুকরা করে ফুটপাতের পাশে ডাস্টবিনে ফেলা দেওয়া হয়। লাশ উদ্ধারের বেশ কিছুদিন পর নিহতরা ওই এলাকায় গৃহকর্মী ছিলেন বলে জানা গেলেও অপরাধী চক্র সম্পর্কে কেউ ধারণা দিতে পারেনি। পুলিশ ধারাবাহিক অনুসন্ধানের একপর্যায়ে প্রযুক্তির সহায়তায় গত ১০ ফেব্রুয়ারি আটক করে মামুন নামের এক যুবককে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদেই মেলে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য। পরে ওহাব নামে আরেক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ১১ ফেব্রুয়ারি মামুন ও ওহাব মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, নারী নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গত এক বছরে ২৮১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ##
No comments:
Post a Comment