ব্রাজিল-জার্মানি সেমিফাইনালের দুটি ট্যাগলাইন এবং দুটিতেই তিনি আছেন। নেইমারকে ছাড়া। নেইমারের জন্য। বিশ্বকাপ ইতিহাসে কোনো খেলোয়াড় না থেকেও কোনো ম্যাচে এমন প্রবলভাবে থাকেননি। আজ ব্রাজিল নেইমারকে ছাড়া মাঠে নামবে। আজ ব্রাজিল নেইমারের জন্য মাঠে নামবে। বাস্তিয়ান শোয়েনস্টাইগারের মনে যা-ই থাক, মুখে বলছেন নেইমারকে তিনিও মিস করবেন। সেরা খেলোয়াড়ের বিপক্ষে খেলাটাই না মজা! যেটি জার্মান মিডফিল্ডারের ম
নের কথা কি না সংশয়ে ভোগার কোনোই কারণ নেই, তা হলো নেইমারকে এভাবে হারিয়ে ফেলাটা জেদ আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞার একটা আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে ব্রাজিল দলে। এই বিশ্বকাপে কত লাখ নেইমারের জার্সি বিক্রি হয়েছে, সেই সংখ্যাটা নিয়ে যে কারোরই কৌতূহল হতে বাধ্য। হলুদ জার্সি মানেই নেইমার। বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার পরও বিক্রিবাট্টায় কোনো ভাটা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। রাস্তায়-শপিং মলে-স্টেডিয়ামে আগের মতোই অসংখ্য ‘নেইমার জুনিয়র’ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গত শনিবার ব্রাসিলিয়ায় আর্জেন্টিনা-বেলজিয়াম কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের অনেকের হাতেই কাগজে লেখা ব্যানার। প্রায় একই কথা লেখা সব কটিতে— Forca Neymar Vai Brasil Rumo Ao Hexa. যেটির বঙ্গানুবাদ—নেইমার শক্ত থাকো। ব্রাজিল এগিয়ে যাও। ষষ্ঠ শিরোপা আসছে। ব্রাজিলিয়ান টেলিভিশনে বারবার দেখানো হচ্ছে পরপর কয়েকটি দৃশ্য—নেইমারের ওপর জুনিগার ঝাঁপিয়ে পড়া। স্ট্রেচারে শুয়ে নেইমারের বেরিয়ে যাওয়া। নেইমারের ভিডিও বার্তা। আবহটা এমন, আজ মাঠে নেইমার যেন ব্রাজিলের অদৃশ্য দ্বাদশ খেলোয়াড়। কিন্তু অদৃশ্য নেইমার কি আর দৃশ্যমান নেইমারের বিকল্প হতে পারেন! বিশ্বকাপের শুরু থেকেই প্রশ্নটা উঠছিল, নেইমারের খারাপ দিনে এই ব্রাজিলের কী হবে? ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের মিডফিল্ডার টোস্টাও ব্রাজিলের প্রথম দুই ম্যাচ দেখেই বলেছিলেন, ‘এই ব্রাজিলের দুটি স্ট্র্যাটেজি। এক. নেইমারকে বল দাও। দুই. নেইমারকে বল দাও।’ আজ কাকে বল দেবে ব্রাজিল? নেইমারের বিকল্প হিসেবে স্কলারি কাকে নামাবেন, সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। সংবাদ সম্মেলনে একটা আভাস পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু স্কলারির সংবাদ সম্মেলন যখন শুরু হবে, বাংলাদেশে তখন প্রায় শেষ রাত। তেরেসোপোলিসে বেস ক্যাম্পে ব্রাজিলের অনুশীলন দেখে সংবাদমাধ্যম উইলিয়ানকেই সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে ধারণা করছে। নেইমারের বিকল্প উইলিয়ান মানে তো থ্রি নট থ্রি রাইফেলকে মেশিনগানের বিকল্প ভাবা। উইলিয়ান তাই আগেই বলে রেখেছেন, ‘নেইমারের সঙ্গে আপনি আর কারও তুলনা করতে পারেন না।’ শিরোপা জয়ের দিক থেকে আজকের দুই সেমিফাইনালিস্টের মাঝখানে আছে ইতালি। তবে শুধু ট্রফি জয়ের হিসাব না করলে ব্রাজিল ও জার্মানিই বিশ্বকাপের সবচেয়ে সফল দুই দল। সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডেও প্রথমেই এই দুটি নাম। এই বিশ্বকাপেই প্রথম দল হিসেবে শততম ম্যাচ খেলেছে জার্মানি। কদিন পরই সেই ‘হান্ড্রেড ক্লাবে’ তাদের সঙ্গী হয়েছে ব্রাজিল। অথচ বিস্ময়কর হলো, এই দুদলের এর আগে মাত্র একবারই দেখা হয়েছে বিশ্বকাপে। ২০০২ ফাইনালে। সেই ফাইনালে ব্রাজিলের জয়ের নায়ক রোনালদো একদমই মনে করছেন না যে, নেইমার নেই বলেই ব্রাজিল শেষ। বরং সগর্বে ঘোষণা করছেন, ‘সেলেসাওরা কখনোই শুধু একজন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করেনি, এখনো করে না, ভবিষ্যতেও করবে না।’ অতীত থেকে উদাহরণও দিয়েছেন। ১৯৬২ বিশ্বকাপের শুরুতেই পেলেকে মেরে বের করে দেওয়ার পরও ব্রাজিল ঠিকই বিশ্বকাপ জিতেছিল। উত্তরসূরিদের উজ্জীবিত করতেই হয়তো অমন বলছেন। ১৯৬২ বিশ্বকাপের দলে পেলেকে হারানোর পরও গারিঞ্চা ছিলেন। দিদি ছিলেন। ভাভা ছিলেন। ২০০২ বিশ্বকাপের অবিসংবাদিত নায়ক রোনালদো সেই টুর্নামেন্টে না থাকলেও রিভালদো থাকতেন। রোনালদিনহো থাকতেন। কিন্তু ব্রাজিলের এই দলে নেইমারের ধারেকাছে আসতে পারেন, এমন কেউই তো নেই। ফ্রেড কীভাবে টানা পাঁচ ম্যাচ খেলে ফেললেন, এরই মধ্যে তা ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের একটা রহস্য বলে বিবেচিত। ফ্রেডের মতো হাল্কেরও এখনো কোনো গোল নেই। প্রথম ম্যাচে উজ্জ্বল অস্কার ক্রমেই বিবর্ণ হয়েছেন। শুধু আক্রমণভাগই তো স্কলারির কপালে ভাঁজ ফেলছে না, দুই হলুদ কার্ডে থিয়াগো সিলভাকে হারিয়ে রক্ষণ নিয়েও তো দুশ্চিন্তা। এতটাই যে, কাজ হবে না জেনেও থিয়াগো সিলভার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য ফিফার কাছে আবেদন করেছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন। যেটিতে সাড়া দিয়ে স্বাগতিকদের সুবিধা দেওয়ার অপবাদ কাঁধে নেওয়ার ঝুঁকি নেওয়ার কোনোই কারণ নেই। ১৯৬২ বিশ্বকাপে চিলির বিপক্ষে সেমিফাইনালে বহিষ্কৃত হওয়ার পরও গারিঞ্চাকে ফাইনালে খেলতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফুটবলে কি আর সেই দিন আছে! এর আগে বিশ্বকাপে এই দুদলের একমাত্র ম্যাচে মাইকেল বালাককে কি দর্শক হয়ে থাকতে হয়নি? জার্মানির ওই দলে বালাক তো ব্রাজিলের এই দলের নেইমারের মতোই ছিলেন প্রায়। নেইমার-থিয়াগো সিলভাবিহীন ব্রাজিলও আজকের সেমিফাইনালে ফেবারিট বলে রোনালদোর যে দাবি, সেটি মাঠে সত্যি বলে প্রমাণ হয়েও যেতে পারে। ফুটবলে তো কত কিছুই হয়! তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নিজেদের মাঠে খেলা ছাড়া আর কোনো কিছুই ব্রাজিলের পক্ষে কথা বলছে না। এই বিশ্বকাপের আগেই ১৯৯০ বিশ্বকাপজয়ী জার্মানি দলের মিডফিল্ডার ইয়ুর্গেন কোহ্লার ঘোষণা করে দিয়েছেন, জার্মানিই হবে চ্যাম্পিয়ন। একমাত্র যে দলটা ঝামেলা করতে পারে, সেটি হলো ব্রাজিল। নেইমার ছিটকে পড়ার পর সেই কোহ্লার ব্রাজিলকেও এখন আর কোনো বাধা মনে করছেন না। গত দুটি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে ফেরার পর এই বিশ্বকাপকে ঘিরে জার্মানির প্রস্তুতি ছিল চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো। বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিজেদের খরচে বেস ক্যাম্প বানিয়েছে তারা। বিলাসবহুল হোটেল, দারুণ সব মাঠ আর অঢেল বিনোদনের সুযোগ-সুবিধাসংবলিত সেই রিসোর্টের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্যাম্পো বাহিয়া’। যেটিতে যেতে হয় ফেরিতে করে। এটি বানাতে কত মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে, জার্মান ফুটবল ফেডারেশন সেটি সুনির্দিষ্টভাবে না জানানোয় জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে বিস্ময়কর সব অঙ্ক নিয়ে। বিশ্বকাপ শেষে এটিকে স্পোর্টস অ্যান্ড নেচার রিসোর্টে রূপ দেওয়া হবে। সঙ্গে থাকবে একটা ইয়ুথ একাডেমিও। ব্রাজিলের জন্য উপহারই বলা যায়। কিন্তু বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিলকে বিদায় করে দিলে সেই উপহারের কি আর কোনো মূল্য থাকবে ব্রাজিলিয়ানদের কাছে?
No comments:
Post a Comment