Thursday, July 10, 2014

প্রাথমিক কাজ শুরু:যুগান্তর

বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। পদ্মার পাড়ে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া চন্দ্রেরবাড়ি এলাকায় ৫৯ হেক্টর জমি সেতু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আবাসন, গবেষণা ও নির্মাণ কাজের সরঞ্জামাদি রাখার জন্য শেড তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
পাশাপাশি হাতে নেয়া হয়েছে মূল সেতু নির্মাণে মাটি পরীক্ষা ও সার্ভে কার্যক্রম। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এসব কাজের মধ্য দিয়ে মূলত পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ কাজের সূচনা হল। ১৭ জুন সরকারের সঙ্গে এ সেতু নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ১১ দিনের মধ্যে সেতু নির্মাণ স্থল নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছে সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। তবে সেতুর অপর প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরায় প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের কার্যক্রম শুরু করতে দেখা যায়নি। আর টিমেতালে চলছে পদ্মা সেতুর সংযোগ স্থাপনে দুটি এপ্রোস সড়ক নির্মাণ কাজ। লৌহজংয়ে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ মাওয়া সংযোগ সড়ক এবং শিবচর ও জাজিরা উপজেলায় প্রায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার সংযোগ (এপ্রোচ) সড়ক নির্মাণে গুটিকয়েক শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি ভারি যন্ত্রপাতির সহযোগিতায় বালু-মাটি ভরাটের কাজ চলছে। গত ছয় মাসে এ দুই সড়কে মাটি ফেলার কাজ হয়েছে গড়ে ২৫ ভাগ। তবে সেতু বিভাগের দাবি, মাটি ভরাট কাজের অগ্রগতি আরও বেশি হবে। লৌহজংয়ের মাওয়া, মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকায় সরেজমিন ঘুরে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব চিত্র। পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের অগ্রগতির বিষয়ে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যুগান্তরকে বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। আশা করছি শিগগিরই কাজ দৃশ্যমান হবে। কবে নাগাদ হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেবল কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। মোবিলাইজেশন করতে একটু সময় লাগবে। তখনই সব কিছু দৃশ্যমান হবে। মূল সেতু নির্মাণে ১৭ জুন চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। চুক্তি অনুযায়ী, ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। আগামী চার বছরের মধ্যে মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। শুধু মূল সেতুর জন্য চায়না মেজর ব্রিজ ব্যয় ধরেছে ৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা রাখা হয়েছে ডলারের দামের তারতম্য ও উপকরণের মূল্যের তারতম্যের কারণে। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে মোট চুক্তি মূল্যের ২৫ দশমিক ৬০ শতাংশ বা ৩ হাজার ১০৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা দেশীয় অর্থে ও ৭৪ দশমিক ৪০ শতাংশ বা ৯ হাজার ২৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় (ডলারে) পরিশোধ করতে হবে। ২০১৮ সালে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। পদ্মা নদীর উপরে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল সেতুর উপরতলায় ৪ লেন বিশিষ্ট সড়ক পথ এবং নিচের তলায় রেলপথ থাকবে। এছাড়াও সেতুতে গ্যাস পাইপলাইন, অপটিক ফাইবার ক্যাবল এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন থাকবে। সেতুর আনুষঙ্গিক অবকাঠামোর মধ্যে আরও থাকবে দুটি টোল প্লাজা, দুটি সার্ভিস এরিয়া, ৬টি ছোট-বড় সেতু, ১৪টি কালভার্ট, ৭টি আন্ডারপাসসহ উভয় পাড়ে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪ লেন বিশিষ্ট এপ্রোচ রোড থাকবে। চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি মূল সেতু নির্মাণের কাজ পেয়েছে। জুলাই থেকে মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে- যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তরফে এমন ঘোষণা দেয়া হয় অনেক আগেই। পদ্ম সেতু নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থান ঘুরে পাওয়া গেছে এর আংশিক সত্যতা। লৌহজংয়ের মাওয়ায় জমি বুঝে নিয়েছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। তবে মূল সেতু নির্মাণের দৃশ্যমান কোনো কাজ দেখা যায়নি। প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর এক প্রান্ত লৌহজংয়ের মাওয়া এবং অপর প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা। বুধবার মাওয়ায় সরেজমিন দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর নির্মাণে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ ইউনিয়নের শিমুলিয়া চন্দ্রেরবাড়ি এলাকায় ৫৯ হেক্টর জমিতে কাঁটাতারের সীমানা দেয়ার কাজ করছেন দেশীয় শ্রমিকরা। তবে ওই জমিতে কোনো ধরনের স্থাপনা এবং নির্মাণ সামগ্রী দেখা যায়নি। জমির একদিকে পদ্মা নদী ও অপর দিকে রয়েছে কাঁচা সড়ক। অনেক দিন আগে এই জমিতে বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। সেখানে সবুজ ঘাস জন্মেছে। ওই জমি ব্যবহার করে ওই গ্রামের বাসিন্দারা নদী থেকে পানি এনে থাকেন। তাদের জন্য বিকল্প পথ তৈরি হয়নি। জমি থেকে মূল সড়ক পর্যন্ত কোনো পাকা পথ দেখা যায়নি। এই জমি ঘিরে কাঁটাতারের সীমানা নির্মাণের কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রমিকরা জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জায়গায় বেড়া দেয়ার কাজ করছেন। এর বেশি কিছু জানাতে পারেননি তারা। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল সেতু নির্মাণের অংশ হিসেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী, কর্মকর্তাদের আবাসন ও গবেষণার জন্য এই জমিতে শেড নির্মাণ শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজ এই কুমারভোগ থেকেই শুরু হলÑ মন্তব্য সেতু বিভাগের কর্মকর্তাদের। মূলত এখান থেকে নির্মাণ কাজ পরিচালনা ও মনিটরিং করবে বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ২৮ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি প্রতিনিধি দল ওই জমি পরিদর্শন করার পর তাদের এই জমি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা আরও জানান, পদ্মা সেতুর কাজ দৃশ্যমান হওয়ার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নিজেদের আবাসন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, যাতায়াত ব্যবস্থা তৈরি করার পরই মূল সেতুর কাজে হাত দেবেন। তবে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, নিজস্ব আবাসন ও গবেষণাগার নির্মাণের পাশাপাশি মাটি পরীক্ষা এবং সার্ভে কার্যক্রম শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেতুর অপরপ্রান্ত জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচর ঘুরে মূল সেতু নির্মাণের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। সরেজমিন আরও দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ চলছে লৌহজংয়ের মাওয়া এবং মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরায়। দুই সড়ক নির্মাণে হালকা ও ভারি উভয় ধরনের মেশিনের সাহায্যে বালু-মাটি ভরাট করা হচ্ছে। দুই সড়কের মাটি ভরাট কাজের গড় অগ্রগতি ২৫ থেকে ৩০ ভাগ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, মাটি ভরাটের কাজের অগ্রগতি ২০ থেকে ২২ ভাগ। ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে মাওয়ায় প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘের সংযোগ সড়ক কাজের উদ্বোধন হয় গত বছরের ১২ নভেম্বর। তবে মূল কাজ শুরু হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। আড়াই বছর মেয়াদে ২০১৬ সালের জুন মাসে চার লেনের এ সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাওয়া সংযোগ সড়কে দেখা গেছে, মাওয়া চৌরাস্তার সংলগ্ন এলাকায় দুটি ভারি মেশিন দিয়ে মাটির কাজ চলছে। মাটি ডাবানোর মেশিন সয়েল কম্পাক্টরের মাধ্যমে কম্পন সৃষ্টি করে রাস্তা নির্মাণ কাজ চলছে। একটু দূরেই এক্সক্লেভেটারের সাহায্যে মাটি ভরাট কাজ চলছে। এছাড়া দু’জন শ্রমিক বালু-মাটি সমান করার কাজ করছেন। আলাপকালে এসব শ্রমিক জানান, মাটি ভরাটের জন্য বেশ কিছু মেশিন আনা হয়েছে। প্রথম দিকে এসব মেশিন বেশি ব্যবহার হলেও বর্তমানে কাজের গতি কম। ওই সব মেশিন নির্দিষ্ট একটি স্থানে রেখে দেয়া হয়েছে। এছাড়া পদ্মার পাড় হয়ে মাদারীপুরের শিবচর এলাকায় দেখা যায়, নদীর পাড় থেকে শুরু করে একাধিক স্থানে বালু, পাথরের বিশাল স্তূপ। সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজের জন্য এসব আনা হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। শিবচর ও জাজিরায় ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘের সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ চলছে। ট্রাক, এক্সক্লেভেটারসহ অন্যান্য মেশিনের সাহায্যে বালু-মাটি ভরাটে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। কয়েক জন শ্রমিককে বালু-মাটিতে পানি দিতে দেখা গেছে। নদী থেকে ড্রেজিং করে বালু এনে প্রকল্প এলাকায় ফেলা হয়েছে। আলাপকালে এসব শ্রমিক জানান, বালু-মাটি ডাবাতে পুরো রাস্তায় পানি দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাজিরা সংযোগ সড়কে মাটি ভরাট কাজের অগ্রগতির হার ২৫ থেকে ২৭ ভাগ। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য ৫টি পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের পথে রয়েছে। এসব প্রকল্পে নানা ধরনের বৃক্ষরাজির মাধ্যমে সবুজায়ন করার কাজ চলছে। সরেজমিনে শিবচর পুনর্বাসন কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মিলল ফলের অসংখ্য গাছ। সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো হয়েছে। নিয়মিত এসব গাছের পরিচর্যা করা হচ্ছে। একই চিত্র দেখা গেছে, লৌহজংয়ের দুটি আবাসন প্রকল্পে। মাওয়ায় প্রায় সাত হাজার গাছ লাগানোর কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা আরও জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির যেসব অংশে কোনো স্থাপনা থাকবে না সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হচ্ছে। জাজিরা কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের বাফার জোট ও অস্থায়ী পুনর্বাসন এলাকায় ২১ হাজারের বেশি গাছ লাগানোর কার্যক্রম চলছে। পরিবেশ কার্যক্রমের আওতায় সেতু ঘিরে সবুজায়ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে।  

No comments:

Post a Comment