হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমান পরিচালিত গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিং কার্যক্রম জয়েন্ট ভেঞ্চারে যাচ্ছে। দুবাইভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে সম্প্রতি লাইসেন্স খোয়ানো একটি দেশীয় এয়ারলাইন্স এক হয়ে বিমানের সঙ্গে যৌথভাবে এই গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব নিচ্ছে। কাগজপত্রে যৌথ উদ্যোগের কথা বলা হলেও মূলত কাজ করবে বিদেশীরাই। স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান দেখভাল কর
বে মাত্র। এতে বিমান আর্থিকভাবে লাভবান হবে। একই সঙ্গে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্পর্কে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোর যে নেতিবাচক মনোভাব আছে তা কেটে যাবে। বিমান পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, কেভিন বিমানের এমডি থাকাকালীন ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে বসে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছে। বর্তমানে গ্রাউন্ড এবং কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোকে চুক্তি অনুযায়ী যতটুকু সার্ভিস দেয়ার কথা তার এক-দশমাংশ দেয়া হচ্ছে না। অথচ তাদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক রেটে টাকা নেয়া হচ্ছে। গ্রাউন্ড ইকুইপমেন্টের অবস্থাও বেহাল। কার্গোর অবস্থা আরও খারাপ। কেভিন তখন বলেছিল বিমানের স্বার্থরক্ষা করে জয়েন্ট ভেঞ্চার করবে। কারও চাকরি যাবে না, বেতন কমবে না, বিদেশী সংস্থার টাকা দিয়ে সবকিছু আধুনিকায়ন করা হবে। আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে শ্রমিক-কর্মচারীদের। মেয়াদ চুক্তির পর সব ইকুইপমেন্ট বিমানের হয়ে যাবে। বিদেশী সংস্থা যেহেতু মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করবে সেহেতু মুনাফা শেয়ার করবে। তাতে যদি দেখা যায় বিমানের ক্ষতি হবে তাহলে সে জয়েন্ট ভেঞ্চার করা হবে না। পুরো জিনিসটা কমপ্লিট হলে গ্রাউন্ড এবং কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের চেহারা বদলে যেত! কিন্তু সিবিএ নেতারা এটাকে জিম্মি করে যখন তখন আন্দোলনে নামছে। এটা এমন এক জায়গা যে তারা ইচ্ছা করলে পুরো জাতিকে, সরকারকে এবং বিমান চলাচল ব্যবস্থাকে অচল করে দিতে পারে। বিমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্যাপ্টেন (অব.) মোসাদ্দিক আহম্মেদ বলেন, বর্তমানে শাহজালালের যে অবস্থা তাতে গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিং জয়েন্ট ভেঞ্চারে করা ছাড়া বিকল্প নেই। এটা সম্ভব হলে বিমান বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি আয় করতে পারবে। পাশাপাশি শাহজালালের গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিং নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি ও বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের যে অভিযোগ রয়েছে সেটা দূর হবে। তিনি বলেন, জয়েন্ট ভেঞ্চারে গেলে বিমানের পাশাপাশি বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও লাভবান হবে। কোনো কর্মচারী ছাঁটাই করা হবে না। উন্নত যন্ত্রপাতি আনা হবে। ম্যানুয়ালি কাজের পরিবর্তে সবকিছু ডিজিটালাইজড হয়ে যাবে। এতে শ্রমিকদের কষ্টও কমে যাবে। জানা গেছে, সুইসপোর্ট নামের সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৃহৎ একটি কোম্পানি বেশ কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দিয়ে শাহজালালের গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা বলেছিল। প্রধানমন্ত্রী ওই চিঠিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু বিমানের সিবিএ নেতাদের আন্দোলন ও সরকারি দলের এক প্রভাবশালী এয়ারলাইন্স ব্যবসায়ীর (বর্তমানে এওসি নেই) হস্তক্ষেপে বিষয়টি বেশিদূর গড়ায়নি। গত বছরের মাঝামাঝি কেভিন স্টিল যখন বিমানের এমডি ছিলেন তখন তিনি গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিং বিমানের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার করার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আরএফআই (রিকোয়েস্ট ফর ইন্টারেস্ট) আহ্বান করেছিলেন। ওই দরপত্রে সুইসপোর্টসহ বিশ্বের ৫টি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। কিন্তু বিমানের দরপত্র যাচাই-বাছাই কমিটি কৌশলে মাত্র দুটি দরপত্র রেসপন্সিভ করে। ওই দুটি কোম্পানি হল দুবাইভিত্তিক ডানাটা ও টার্কিসভিত্তিক কোম্পানি সিভেলি। জানা গেছে, ওই প্রভাবশালী এয়ারলাইন্স ব্যবসায়ীর সঙ্গে দুবাইভিত্তিক কোম্পানি ডানাটার গভীর সুসম্পর্ক আছে। তারাই ডানাটার স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, ঢাকা-১০ আসনের এমপি ফজলে নূর তাপস, রিজেন্ট এয়ার লাইন্সের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রীর এয়ারলাইন্স ব্যবসায়ী শিল্পপতি জামাতার নাম ভাঙিয়ে কার্যাদেশ পাওয়ার জন্য জোর তদবির চলছে। তবে তাদের নেপথ্যে রেখেই কাজ সারার চেষ্টা চলছে। তাদের নাম ভাঙিয়ে শীর্ষ মহলে তদবির হচ্ছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট কাজগুলো অনেক দূর এগিয়েছে। এখন শুধু বাকি আছে বিমানের সিবিএ নেতাদের সমর্থন। এই সমর্থন আদায়ে ইতিমধ্যে বিমান ম্যানেজমেন্ট শর্তসাপেক্ষে সিবিএ নেতাদের তিনটি দাবি বাস্তবায়নেরও ঘোষণা দিয়েছে। শর্ত হিসেবে গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিং জয়েন্ট ভেঞ্চারে করার বিষয়ে নিঃশর্ত সমর্থন চেয়েছে সিবিএর কাছে। শ্রমিক লীগ সমর্থিত বিমান সিবিএ ইতিমধ্যে বিমানকে এ বিষয়ে মৌন সমর্থন দিয়েছে। বলেছে, যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কাজে রাজি থাকেন তাহলেই তারা জয়েন্ট ভেঞ্চারে যেতে রাজি আছেন। তবে বিষয়টি চূড়ান্ত করার আগে তারা বিমানের সবগুলো শ্রমিক সংগঠন, বাপা, বিওএ (বিমান অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন), কেভিন ক্রু অ্যাসোসিয়েশন, প্রকৌশল শাখার শ্রমিক সংগঠনের মতামত নেয়ার কথা বলেছেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে বিমান শুধু এই দুটি শাখায় লাভ করছে। চলতি বছর বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং থেকে পাঁচশ’ কোটি এবং কার্গো হ্যান্ডলিং থেকে ৪৩০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। লাভজনক বিভাগ দুটি যদি তাদের হাতছাড়া হয় তাহলে তাদের পথে বসা ছাড়া বিকল্প থাকবে না। কাজেই জয়েন্ট ভেঞ্চারে যেতে হলে সবার আগে বিমান কি পাবে তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের শংকা জয়েন্ট ভেঞ্চারের নামে কৌশলে গোটা বিমানকে যাতে কেউ হাতিয়ে নিতে না পারে সেটা দেখতে হবে। বিমান শ্রমিক লীগ সভাপতি ও সিবিএ নেতা মসিকুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি চান তাহলে বিমানের স্বার্থে তারা শর্ত সাপেক্ষে জয়েন্ট ভেঞ্চারে যেতে রাজি আছেন। তবে তার আগে জয়েন্ট ভেঞ্চার বিষয়টি কি? এর মাধ্যমে বিমানের কি উপকার হবে? শ্রমিক-কর্মচারীদের কি উপকার হবে, এর টার্ম অব কন্ডিশন কি হবে, কিভাবে চুক্তি হবে, সেখানে বিমানের স্বার্থ কতটুকু সংরক্ষিত থাকবে এটি প্রকাশ্যে প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিমানের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখাতে হবে। এরপরই সবাই যদি মনে করে এটি লাভজনক হবে তাহলে আমরা রাজি। আর যদি লাভজনক না হয় তাহলে এটা আমরা মানব না। মসিকুরের প্রশ্ন শুধু লাভজনক দুটি সেক্টর নিয়ে কেন জয়েন্ট ভেঞ্চার হবে? পুরো বিমানই লোকসানি প্রতিষ্ঠান। কাজেই পুরো বিমানকে নিয়ে জয়েন্ট ভেঞ্চার করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না কেন? তার মতে, এমন কোনো জয়েন্ট ভেঞ্চার করা যাবে না যারা সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হবে। দেখা যাবে জয়েন্ট ভেঞ্চারের চুক্তিতে এমন ফাঁকফোকর করে রাখা হয়েছে যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা একসময় পুরো বিমানের মালিকানা চেয়ে বসবে। কিংবা শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই শুরু করবে। তিনি বলেন, প্রয়োজনে এর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও ভালো মানের কনসালটেন্ট নিয়োগ করা যেতে পারে। অপর একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে বেহাল অবস্থা শাহজালালের গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে। দুটি বিভাগের ঘাটে ঘাটে অনিয়ম-দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। হচ্ছে চুরি, লুটপাট আর চোরাচালান। সব মিলিয়ে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০০টি ফ্লাইট উড়োজাহাজ ওঠানামা করছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এই অবস্থায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। সিভিল এভিয়েশন ও বিমানবন্দরের এই বেহাল অবস্থায় দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্স ব্যবসায়ীরা আতংকিত ও হতাশ। তারা বলেছেন, এই ব্যবসায় মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছেন তারা। কিন্তু বিমানবন্দর ও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের নানা হেঁয়ালিপনায় এই সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বিষয়টি নিয়ে এ সেক্টরের বিনিয়োগকারীরা সরকারকে নানাভাবে অবহিত করলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ১৯৯৭ সালে ওয়াশিংটনভিত্তিক ফেডারেল এভিয়েশন অথরিটি শাহজালাল বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক মান (স্ট্যান্ডার্ড) দ্বিতীয় শ্রেণী করে। গত ১৮ বছরেও নানা চেষ্টা তদবির করেও মান উন্নয়ন করতে পারেনি শাহজালাল কর্তৃপক্ষ। দুবাইভিত্তিক একজন এভিয়েশন ব্যবসায়ী বলেন, শাহজালাল বি-ক্যাটাগরি হওয়ায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখানে বেশি টাকা বিনিয়োগ করার সাহস পাচ্ছে না। তিনি বলেন, সম্প্রতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে সংস্কার করা হয়েছে। সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে আপগ্রেডেশন অব শাহজালাল নামে একটি প্রজেক্টের কাজ চলছে। পিপিপির আওতায় রাডার প্রজেক্ট করা হবে। এ অবস্থায় গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের মান আন্তর্জাতিক মানের করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে বিমানের কাছে নিখুঁত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করার মতো আধুনিক সিস্টেম নেই। যার কারণে যাত্রীদের লাগেজসহ অন্যান্য ব্যাগেজ পেতে নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ইমিগ্রেশন পদ্ধতিও আধুনিক ও দ্রুত নয়। এখানেও যাত্রীদের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রানওয়েতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবসা নেই। রানওয়ের অ্যাপ্রোচ লাইটগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। এসব লাইটের অর্ধেক ঠিকমতো জ্বলে না। মাঝেমধ্যেই লাইট চুরি হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোর পক্ষ থেকে লিখিতভাবে রানওয়েতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করার কথা বলা হলেও তা করা হচ্ছে না। কার্গো ভিলেজের অবস্থা খুবই খারাপ। বড় কোনো কার্গো উড়োজাহাজ এলে সেটিকে কার্গো ভিলেজে রাখা যায় না। রাখতে হয় ভিভিআইপির সামনে। এতে উড়োজাহাজ জট লেগে থাকে। এয়ারফ্রেইট কার্গো কমপ্লেক্স ও কার্গো ভিলেজ এখন চুরি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্য। এখান থেকে পণ্য ছাড়াতে ৬০ ঘাটে ঘুষ দিতে হয়, অন্যথায় কোনো পণ্য নড়ে না। বাংলাদেশ বিমান, কুরিয়ার সার্ভিস আর কাস্টমসের একটি সিন্ডিকেট এই ঘুষ-বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সাধারণ ব্যবসায়ীরা এর নাম দিয়েছেন ঘুষ, চুরি আর দুর্নীতির বন্দর। সেক্টর দুটিকে ঘিরে বিমান সিবিএ একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। এখান থেকে তারা চাঁদাবাজি করছে। সিবিএর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া যায় না। কথায় কথায় তারা আন্দোলন, ধর্মঘট ডেকে বিমানবন্দর অচল করে দিচ্ছে। এতে প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। জয়েন্ট ভেঞ্চারে গেলে সিবিএর এই অনৈতিক রাজত্ব থাকবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএমএ খায়ের। তিনি বলেন, বিদেশী কোনো কোম্পানির সঙ্গে বিমান যদি জয়েন্ট ভেঞ্চারে গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে যায় তাহলে ৬ মাসে বিমান লাভজনক হবে। দুবাই বিমানবন্দরের আদলে পরিণত হবে শাহজালাল।
No comments:
Post a Comment