Wednesday, July 9, 2014

এফডিআর মুনাফায় জালিয়াতি:যুগান্তর

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে থাকা প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার তহবিল সরকারি-বেসরকারি ৪০টি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত রাখার ক্ষেত্রে মুনাফায় বিরাট জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফার চেয়ে কম মুনাফায় টাকা জমা রেখে গত পাঁচ বছরে বন্দরের ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ১১০ কোটি টাকা। এ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যাংক ও বন্দর কর্মকর্তা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। মুনাফার অতিরিক্ত টাকা সংশ্লিষ্টরা পে-স্ল
িপের মাধ্যমে তুলে নিয়ে নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক তদন্তে বন্দরের তহবিলের মুনাফায় এই জালিয়াতির ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেদনটি কমিটি সম্প্রতি নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দেয়। এই জালিয়াতিতে শুধু বন্দর কর্তৃপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সরকারও বঞ্চিত হয়েছে বন্দর থেকে বাড়তি রাজস্ব আয় থেকে। যুগ যুগ ধরে এই জালিয়াতি চলে আসছে। বন্দরের নিজস্ব অডিট, সরকারের নিরীক্ষা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিজস্ব তদন্তেও এই ঘটনা ধরা পড়েনি। এখন পর্যন্ত কমিটির হিসাবে গত ৫ বছরে তহবিলের মুনাফা বাবদ ৬৫ কোটি টাকা ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্যের মতে, প্রকৃত হিসাবে এই ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ১১০ কোটি টাকা হবে। গত ২০ বছরে এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩০০ কোটি টাকার বেশি। মুনাফায় জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে এই কমিটি গঠনের পর থেকেই একটি মহল প্রবল চাপ প্রয়োগ করে। যাতে কমিটি কাজ করতে না পারে। দুই বছর ধরে তদন্ত করেও কমিটি একটি দায়সারা প্রতিবেদন দিয়েছে। যাতে বন্দরের তহবিলের মুনাফা জালিয়াতি করায় কাউকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়নি। ক্ষতির পরিমাণও নিরূপণ করার ক্ষেত্রেও তহবিলের সব হিসাব বিবেচনায় নেয়া হয়নি। কমিটির কার্যপরিধিতে এ বিষয়গুলো ছিল না বলে তারা এই জালিয়াতির সঙ্গে কারা জড়িত সে বিষয়ে কোনো তদন্ত করেনি। ফলে বন্দরের তহবিল ব্যবহার করে বেআইনিভাবে যারা লাভবান হয়েছেন তারা আড়ালেই থেকে গেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিটির একাধিক সদস্য যুগান্তরের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, কমিটিকে হাত-পা বেঁধে নদীতে সাঁতার কাটতে দেয়া হয়েছে। যে কারণে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা যায়নি। তারা এই ঘটনার বিশদ তদন্ত দাবি করেছেন। এটি হলে আরও অনেক দুর্নীতির ঘটনা বেরিয়ে আসবে। জড়িতদেরও শনাক্ত করা সম্ভব হবে। তাদের মতে, যেসব ব্যাংক বেআইনি সুবিধা দিয়েছে তাদের ব্যাপারেও তদন্ত হওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি না হলে আরও এসব অপরাধ ঘটবে। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকেও এর তদন্ত হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির আহবায়ক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বর্তমানে অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে) মোঃ আলাউদ্দিন যুগান্তরকে জানান, পাঁচ বছরের হিসাব পরীক্ষা করে ৬৫ কোটি টাকার ক্ষতি চিহ্নিত করা হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়ে কারা জড়িত তা তদন্ত করা কমিটির টার্মস অব রেফারেন্সে ছিল না। তবে যেসব ব্যাংকের শাখা বা কর্মকর্তা এতে জড়িত তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কম সুদে অর্থলগ্নির পেছনে অনেকের ব্যক্তিগত ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা থাকতে পারে। এ লক্ষ্যে অনেক নিয়মনীতিও পরিবর্তন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য ও যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিল বিভিন্ন ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী আমানত (এফডিআর) হিসেবে রাখা হয়। এতে ব্যাংকের যে মুনাফা তার চেয়ে কম মুনাফা দেয়া হতো। ব্যাংক কর্মকর্তা ও বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মিলে ওই বিশাল অংকের তহবিলের মুনাফা নিয়ে জালিয়াতি করে নিজেদের পকেট ভারি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই জালিয়াতির মাধ্যমে অনেক ব্যাংকার ও বন্দর কর্মকর্তা অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। এ প্রসঙ্গে কমিটির অন্যতম সদস্য বিআইডব্লিউটিসির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) মুজিবুর রহমান জানান, একই দিনে বিভিন্ন ব্যাংকে একেক রকম সুদ হারে অর্থ লগ্নি করে পাঁচ বছরে ৬৫ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি চিহ্নিত করা হলেও পর্যায়ক্রমিক হিসাব ধরা হলে তা ১১০ কোটি টাকার ওপরে হবে। ব্যাংক অফিসিয়ালি কম সুদে চুক্তি দেখায়, কিন্তু পে-স্লিপে বাড়তি অর্থ শোধ করে। এখানে বাড়তি অর্থ ব্যক্তিগতভাবে কারও কাছে গেছে কিনা তা তদন্ত করা হয়নি টার্মস অব রেফারেন্সে ছিল না বলে। আমাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে নতুন করে আরও ব্যাপক তদন্ত করা যায়। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তদন্ত করে এসব ঘটনার সঙ্গে কারা কিভাবে জড়িত এবং কে কি পরিমাণে সুবিধা নিয়েছেন তার সবই বের করা সম্ভব। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের আয়ের কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা প্রতি মাসে কোনো না কোনো ব্যাংকে জমা রাখছে মেয়াদি আমানত (এফডিআর) হিসাবে। আবার যেসব হিসাবের মেয়াদ পূর্তি হয়েছে তা ভাঙিয়ে ২০০ বা ৩০০ কোটি টাকা করে এফডিআর আকারে রাখছে অন্য বা একই ব্যাংকে। দেখা গেছে, একই সময়ে একই দিনে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর খোলার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সুদ হার উল্লেখ করা হয়েছে। আমানতের বিপরীতে একই দিনে কোনো ব্যাংকে ১০ শতাংশ সুদ, কোথাও সাড়ে ১০ শতাংশ সুদ বা অন্য কোনো ব্যাংকে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে টাকা জমা রাখা হয়েছে। এমনকি একই দিনে একই ব্যাংকে এফডিআরের সুদে পার্থক্য দেখা গেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে হিসাব খোলার ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগসাজশে এসব অনিয়মের মাধ্যমে বন্দর কর্তৃপক্ষের আর্থিক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, বেসরকারি খাতে অনেক ব্যাংক হওয়ায় তহবিল সংগ্রহে অস্বচ্ছ প্রতিযোগিতা চলছে। বড় অংকের তহবিলের বিপরীতে তারা বেশি সুদ দিচ্ছে। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানের তহবিল বেশি তাদের নির্দিষ্ট ব্যাংকে টাকা জমা রাখার ক্ষেত্রে নানা ধরনের উপঢৌকন ও সুবিধা দিচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় বাড়তি তহবিল সংগ্রহে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার বাইরে গিয়েও নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা গ্রাহককে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর সুদের হারের যে ঘোষনা দেবে এর চেয়ে কম বা বেশি কোন গ্রাহককে দিতে পারবে না। কিন্তু ব্যাংকগুলো এই বিধি মানছে না। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিশেষে আমানতের সুদ হার কম-বেশি করার অভিযোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মাঝে মধ্যে আসছে। আমরা ব্যবস্থাও নিচ্ছি। এ বিষয়টিও অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা যাবে। সূত্র জানায়, মুনাফার টাকা প্রকৃত হিসাবে কম এলেও বাস্তবে তা নয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে যারা ব্যাংকে এফডিআর রাখার সিদ্ধান্ত দেন এবং কার্যকর করেন তাদের পে-স্লিপের (ভাউচার) মাধ্যমে গোপনে ১ থেকে দেড় শতাংশ সুদের টাকা নগদে বা অন্য কোনো পন্থায় পরিশোধ করা হয়। এভাবে তহবিল ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট বন্দর কর্মকর্তারা প্রতি মাসে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গোপনে আয় করছেন কয়েক কোটি টাকা। এছাড়া রয়েছে নানা ধরনের উপঢৌকন, বিদেশ সফরের খরচ জোগানো এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের ব্যাংকে ভালো পদে চাকরি দেয়ার প্রলোভন। একটি সাধারণ জরিপে দেখা গেছে, গত ২০ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে যারা চেয়ারম্যান, সদস্য (অর্থ), প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাসহ তহবিল ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তাদের নিকটজনরা ৩৩টি বেসরকারি ব্যাংকে আকর্ষণীয় পদে চাকরি পেয়েছেন। যাদের অধিকাংশই এখনও কর্মরত আছেন। এদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বন্দরের তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে শোনা গেলেও তা আগে খুব একটা আমলে নেয়া হয়নি। কিন্তু একই মন্ত্রণালয়ের অন্য সংস্থা যখন রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে এফডিআর হিসাব খুলেছে ১৩ শতাংশ বা ১২ শতাংশ সুদে, তখন একই ব্যাংকে চট্টগ্রাম বন্দর হিসাব খুলেছে ১০ শতাংশ বা সাড়ে ১০ শতাংশ সুদে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) ৩ বছর আগে যখন ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট প্রকট ছিল তখন ১৪ শতাংশ সুদে হিসাব খুলেছে, বন্দর কর্র্তৃপক্ষ তখন হিসাব খোলে মাত্র সাড়ে ১০ শতাংশ সুদে। একই ব্যাংকে একই সময়ে আমানতের হিসাবে সুদের হারের এত বেশি পার্থক্য হওয়ার বিষয়টি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নজরে এলে ২০১২ সালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করে জালিয়াতির ঘটনা আবিষ্কার করে। তদন্ত কমিটির আহবায়ক ছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ আলাউদ্দিন। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন বিআইডব্লিউটিসির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) মোঃ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) আতাউর রহমান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল এবং সদস্য সচিব চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান অর্থ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোঃ হাবিবুর রহমান। কমিটি তদন্ত কাজ শুরু করার পর নানাভাবে চাপ আসতে থাকে। ‘বন্দরের কাজ সুদের ব্যবসা নয়, দেশের সেবা করা’ এ ধরনের কথা বলেও তদন্ত কাজকে বিঘিœত করার চেষ্টা করা হয়। প্রায় দু’বছর পর ২১ মে এই কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনটি এতই দায়সারা যে, কম সুদে অর্থ লগ্নি করায় বন্দরের ৬৫ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হলেও এর পেছনে কি ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, কোন সালে কোন কোন কর্মকর্তা এই দুর্নীতিতে জড়িত তার কোনো কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কমিটির কাছে যে হিসাব দাখিল করেছে তা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬০৩ কোটি ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬৮০ টাকা তহবিলের মধ্যে সরকারি ব্যাংকে ছিল ৪ হাজার ৩৩৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং বেসরকারি ব্যাংকে ছিল ১ হাজার ২৬৩ কোটি ৫২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৮০ টাকা। ২০১০-১২ অর্থবছরে ৫ হাজার ৭০১ কোটি ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬৮০ টাকার মধ্যে সরকারি ব্যাংকে ৪ হাজার ৪৩৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং বেসরকারি ব্যাংকে ১ হাজার ২৫৬ কোটি ৫২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৮০ টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৪ হাজার ৩০ কোটি ১৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকার মধ্যে ৩ হাজার ১৯৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার সরকারি ব্যাংকে এবং ৮৩৩ কোটি ৬৯ লাখ ৯৪ হাজার বেসরকারি ব্যাংকে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪২১ কোটি ৮০ লাখ ৫৪ হাজার টাকার মধ্যে ২ হাজার ৭০১ কোটি ৫০ লাখ টাকার সরকারি ব্যাংকে এবং ৭২০ কোটি ৩০ লাখ ৫৪ হাজার টাকা বেসরকারি ব্যাংকে জমা ছিল। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২ হাজার ৮৭৬ কোটি ৫৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা আমানতের মধ্যে ২ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা জমা ছিল সরকারি ব্যাংকে এবং ৬৪২ কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ছিল বেসরকারি ব্যাংকে। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শুধু কাছাকাছি সময়েই নয়, একই তারিখে বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন সুদে তহবিল রাখায় ২০১১-১২ অর্থবছরে বন্দরের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৫ কোটি ৪৮ লাখ ৮৭ হাজার ১৭৫ টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে এই ক্ষতির পরিমাণ ১২ কোটি ১৭ লাখ ৮৪ হাজার ৫৫০ টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে একই প্রক্রিয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৯ কোটি ৮৯ লাখ ৭ হাজার ১০০ টাকা। কম সুদে আমানত রাখায় ২০০৮-০৯ অর্থবছরের ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ৬ লাখ ৬৪ হাজার ৩০০ টাকা। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এই ক্ষতি ১৭ কোটি ১১ লাখ ৩৪ হাজার ৫৪০ টাকা। এভাবে ওই পাঁচ বছরে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ কোটি ৭৩ লাখ ৭৭ হাজার ৬৬৫ টাকা। এই তদন্তে বন্দরের সমুদয় আমানতের হিসাব নেয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়নি বাজারভিত্তিক সুদের হারকেও। ফলে ক্ষতির এই হিসাবকে অনেকেই কাগুজে ও বাস্তবতাবর্জিত বলে মন্তব্য করেছেন। বন্দরের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রকৃত হিসাবে কম সুদে আমানত রাখায় গত ২০ বছরের হিসাব ধরলে ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা দুর্নীতির এই চক্রটিকে উদঘাটন করতে অবিলম্বে এ বিষয়ে বিশদ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে চট্টগ্রাম বন্দরের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী করা হয়েছে বিনিয়োগ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে। যে পাঁচ বছরের হিসাব তদন্ত করে ৬৫ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি চিহ্নিত করা হয়েছে এর জন্য দায়ী করা হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল নিজাম উদ্দিনসহ পূর্ববর্তী আরও ৩ জন চেয়ারম্যান, সদস্য অর্থ পদে দায়িত্ব পালনকারী ৬ জন, প্রধান অর্থ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালনকারী ৫ জন এবং হিসাব বিভাগের উপ-প্রধান থেকে হিসাব সহকারী পর্যন্ত আরও ১০ জনকে। কমিটির সদস্য বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) আতাউর রহমান জানান, কমিটির কাজ প্রথমে আগ্রহ নিয়ে শুরু করলেও পরে দেখা গেছে অনেকের অনাগ্রহ। কমিটির বৈঠক হয়েছে ৬-৭ মাস পরপর। দেখা গেছে, সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক এফডিআরের বিপরীতে ১৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। তখনও বন্দর ১০ বা সাড়ে ১০ শতাংশ সুদে টাকা লগ্নি করেছে। এভাবে ৬৫ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি চিহ্নিত করা হলেও পর্যায়ক্রমিক হিসেবে ধরলে ক্ষতির পরিমাণ ১১০ কোটি টাকার বেশি হবে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর বিশাল অংকের তহবিল ব্যবস্থাপনায় থাকলেও সরকারি নিরীক্ষা বা অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ থেকে নিয়মিতভাবে এ ব্যাপারে কোনো তদারকি করা হয় না। বাইরের অডিট কোম্পানিকে বছরে ৬০ হাজার টাকা ফি দিয়ে দায়সারা অডিট করানো হলেও এতে কোনো অনিয়ম শনাক্ত হতো না। প্রতি বছরের শিটে শুধু সংখ্যার পরিবর্তন ঘটত। লেনদেনে কোনো অনিয়ম বা আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি তারা উল্লেখ করেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল জানান, এফডিআরে সুদ কম নিয়ে যে ৬৫ কোটি টাকার ক্ষতি চিহ্নিত করা হয়েছে তা বছরওয়ারি পর্যায়ক্রমিক হিসাব করলে এর পরিমাণ ১১০ কোটি টাকার ওপরে হবে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন ব্যাংকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বর্তমানে এফডিআর রয়েছে ৬ হাজার ৪শ’ কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও জনতা ব্যাংকে এককভাবে রাখা অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার মতো। এ দুটি ব্যাংকে টাকা একবার বিনিয়োগ করার পর আর কখনও তা তোলা হয়নি। বিভিন্ন হিসাবের মেয়াদ পূর্তির পর তা আবার নতুন করে মুনাফাসহ জমা রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা একে একটি বড় ঝুঁকি হিসেবে মনে করছেন। তাদের মতে, হলমার্ক কেলেংকারির মতো বিশাল অর্থের জোগান এসব অলস তহবিল থেকে দেয়া হয়েছে।  

No comments:

Post a Comment