রাজনৈতিক প্রভাব ও হুমকির ঊর্ধ্বে উঠে নির্ভয়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। কয়েকটি জেলায় সম্প্রতি সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে এমপি বা অন্য জনপ্রতিনিধিদের বচসা হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে ডিসিরা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনতে চেয়েছিলেন। মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে সাধারণ মানুষের হয়রানির চিত্র তুলে ধরে নিজেদের বিচারিক ক্ষমতাও ফিরে পাওয়ার দাবি জানাতে চেয়েছিলেন ডিসিরা। বলতে চেয়েছিলেন ডিসি বা
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রকল্প তদারকির অধিকতর দায়িত্ব দেওয়ার কথা। আকুতি জানাতে চেয়েছিলেন কৃষিজমি রক্ষায় কিছু করার জন্য। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সেন্সরশিপের কারণে তাঁদের পক্ষে সেসব বলা সম্ভব হয়নি বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। অথচ ডিসি সম্মেলন করাই হয় মাঠপর্যায়ের সমস্যা ও সম্ভাবনা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জানাতে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের তৃণমূল পর্যায়ের অবস্থা জানানোর জন্য এ সম্মেলন আড়াই শ বছরের পুরনো একটি প্ল্যাটফর্ম। সুষম উন্নয়ন বিষয়ে তাঁদের নির্দেশনা প্রদানের অন্যতম ফোরাম হচ্ছে ডিসি সম্মেলন। চলতি বছরের ডিসি সম্মেলন শেষ হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। তিন দিনের এ সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনজন ডিসি ও একজন বিভাগীয় কমিশনার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছিলেন। আরো প্রায় ২০ জন ডিসি আলোচনায় অংশ নিলেও সেটা ছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের মুক্ত আলোচনার অংশ। যে তিনজন ডিসি আনুষ্ঠানিক আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা হলেন রাঙামাটির মো. মোস্তফা কামাল, মাদারীপুরের জি এস এম জাফরউল্লাহ ও পঞ্চগড়ের মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। এ তিনজন আগেই তাঁদের লিখিত বক্তব্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সেই লিখিত বক্তব্যেরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তাঁদের পড়তে দেওয়া হয়নি। পঞ্চগড়ের ডিসির খসড়া লিখিত বক্তব্যে ছিল জনপ্রতিনিধিদের অসহযোগিতার বিষয়টি। তিনি খসড়া বক্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন, ‘মাঠপর্যায়ে জনশৃঙ্খলা রক্ষা ও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্মানিত জনপ্রতিনিধিগণের সমর্থন ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেশের কোথাও কোথাও এর ব্যতিক্রম ঘটেছে, যা মোটেও কাম্য নয়। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন তথা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ যেন নির্ভয়ে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় আইনের প্রয়োগ ও নির্বাচিত সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তুলতে পারে সে জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’ পঞ্চগড়ের ডিসির খসড়া বক্তব্যে উল্লেখ ছিল প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়মের কথা। তিনি উল্লেখ করেন, যেখানে প্রকল্প দরকার নেই সেখানেও প্রকল্প হচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। এসব প্রকল্প নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এসব প্রকল্পের তদারকির দায়িত্ব ডিসি বা ইউএনওর হাতে দেওয়ার সুপারিশ ছিল তাঁর। এ ছাড়া তিনি কৃষিজমি দিন দিন কমে আসার বিষয়টি তুলে ধরে অপরিকল্পিত বসতবাড়ি নির্মাণ বন্ধ করার তাগিদ দেন। তিনি বলেন, ‘সীমিত ভূমি ও অধিক জনসংখ্যার এ দেশে কৃষিভূমি ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে বসতবাড়ি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করা সময়ের দাবি। তাই জরুরি ভিত্তিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভূমি ব্যবহার নীতিমালা এবং সরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে আবাসন নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। আবাসিক, দাপ্তরিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আনুভূমিক সম্প্রসারণের বদলে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণে আমাদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।’ রাঙামাটির ডিসি তাঁর বক্তব্যে আদালতে মামলাজটের চিত্র তুলে ধরে জানান, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের আগে দেশে বিচারাধীন ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার। অন্যদিকে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ছিল ৯ লাখ ২৭ হাজারের বেশি। সে হিসাবে দেশে ২০০৭ সালের পর প্রতিবছর মামলা বৃদ্ধির হার প্রায় ১১ শতাংশ। মামলা বৃদ্ধির এ হার অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা হবে ১৪ লাখ ১১ হাজার এবং ২০৪১ সালে এ সংখ্যা হবে ২৬ লাখ ২১ হাজার, যা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি এ বক্তব্য দেন। তাঁর এ বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলেও যে উদ্দেশ্যে তিনি এ বক্তব্য দিয়েছেন তা প্রকাশ করতে পারেননি। তাঁর বক্তব্যের সেই অংশে ছিল প্রশাসন ক্যাডারের প্রাণের দাবি বিচারিক ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার বিষয়টি। সূত্র মতে, সেন্সরশিপের কবলে পড়া বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘এসকল কাজ ও সুশাসনের স্বার্থে জেলা প্রশাসকগণের কতিপয় আইনগত এখতিয়ার পরিবৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মাঠ প্রশাসনে দুই যুগের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি। তন্মধ্যে অপরাধ আমলে নিয়ে বিচারার্থে প্রেরণ করার এখতিয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আওতায় ন্যস্ত করা বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত জরুরি।’ ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ১৯০(৪) ধারার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই ধারা অনুযায়ী সরকার সুনির্দিষ্ট আদেশক্রমে যেকোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে, যেগুলো তিনি বিচারের জন্য উপযুক্ত আদালতে প্রেরণ করতে পারবেন।’ কেবল একটি পরিপত্র জারি করেই এ আদেশ দেওয়া সম্ভব বলে তিনি দাবি করেন। তাঁর মতে, এ ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন সংশোধনের দরকার হবে না এবং মামলার বিচারকাজ বিচার বিভাগই করবে। এ ছাড়া রাঙামাটির ডিসি পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির তাগিদ দিয়েছিলেন। তিনি জানাতে চেয়েছিলেন, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার অন্যতম প্রধান সমস্যা ভূমি বিরোধ, যার বেশির ভাগই বন বিভাগের সঙ্গে সাধারণ মানুষের। রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় ভূমি জরিপ তথা নকশা ও দাগসূচি প্রণীত না হওয়ায় এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বন বিভাগের সঙ্গে সেখানকার অধিবাসীদের জমি-সংক্রান্ত বিরোধ বহু দিনের। প্রায় প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে বন বিভাগের জমি-সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভূমি জরিপ করে নকশা এবং দাগসূচি প্রণীত হলে ভূমি কমিশন তার কাজ করতে পারবে এবং পার্বত্য অঞ্চলের ২৫ লাখ অধিবাসী ভূমি-সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। এ ছাড়া তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে, এসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনের জন্য নতুন করে ভোটার তালিকা প্রণয়নের প্রয়োজন নেই। কেবল জাতীয় নির্বাচনের জন্য এরই মধ্যে প্রণীত ভোটার তালিকার বিভাজনের মাধ্যমেই এ নির্বাচন করা সম্ভব। জানা যায়, মাদারীপুরের ডিসি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যপরিধি বিস্তৃত হওয়ায় এবং জনগুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ঝুঁকি ভাতার বিষয়টি তুলে ধরতে পারলেও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার কথাটি বলতে পারেননি। তিনি বলতে চেয়েছিলেন. জেলা পর্যায়ে মামলাজট ও দীর্ঘসূত্রতা পরিহারকল্পে এবং স্বল্প সময়ে মামলা নিষ্পত্তিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে সংক্ষিপ্ত বিচারিক ক্ষমতাসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো আমলে নেওয়ার এখতিয়ারের বিষয়টি সুবিবেচনা করা যায়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামটির ডিসি মো. মোস্তফা কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সামনে যে বক্তব্য দেওয়া হবে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কাটছাঁট করতেই পারে। এটা তেমন কোনো সমস্যার পর্যায়ে পড়ে না।’ গত বছর পর্যন্ত ডিসি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত আলোচনার সুযোগ পেতেন ডিসিরা। কিন্তু গত বছর একান্ত আলোচনার সময় ডিসিরা নানা ধরনের বক্তব্য দেওয়ায় এবার একান্ত আলোচনার পরিবর্তে মুক্ত আলোচনার বিধান রাখা হয়, তাও ছিল সীমিত। কারণ আগেই ঠিক করে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সামনে কোন ডিসি কোন বিষয়ে কথা বলবেন।
No comments:
Post a Comment