প্রমত্তা পদ্মায় লঞ্চডুবির ছয় দিনের মাথায় কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন উদ্ধার সংশ্লিষ্টরা। গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে উদ্ধারকারী জাহাজ কাণ্ডারী-২ এ থাকা অত্যাধুনিক যন্ত্র সাইড স্ক্যান সোনার নদীতে একটি মেটালিক রেক বা ধাতব বস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। ওই বস্তুটি পিনাক-৬ লঞ্চ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিষয়টি এখনই নিশ্চিত করতে পারছেন না উদ্ধার সংশ্লিষ্টরা। উদ্ধারকারীরা বলছেন, গত ছয় দিন পর এম
ন কিছু একটা পাওয়া গেছে এতেই অনেকটা আশার আলো দেখছেন তারা। তবে সেটা চোখে না দেখা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। তারা বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ও নদীতে প্রবল স্রোত থাকায় ওই বস্তুটিকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সেটি পরিপূর্ণভাবে শনাক্ত করতে সব ধরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ দিকে গতকাল আরো তিনটি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। লাশগুলোর পরিচয় না পাওয়ার কারণে এবং তাদের সন্ধানকারী হিসেবে কাউকে না পেয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। এর আগে গত শুক্রবার বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছিল ১২টি লাশ। কন্ট্রোলরুম সূত্রে জানা গেছে, গতকাল পদ্মার ভাটি অঞ্চল থেকে আরো ছয়টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে মোট ৪৬ জনের লাশ উদ্ধার হলো। যেভাবে শনাক্ত হলো বস্তুটি : শনিবার নৌবাহিনীর কমান্ডার এম এম মঞ্জুরুল করীম চৌধুরী বলেন, গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে আসা কাণ্ডারী-২ নামে উদ্ধারকারী জাহাজের মনিটরে একটি সিগন্যাল পাওয়া যায়। এরপর তারা সিগন্যালটি পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। উদ্ধারসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি মিটিং করে সেটিকে সাববটম প্রফাইলার নামে অন্য একটি যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা শুরু করেন। পরদিন অর্থাৎ গতকাল সকালের পর তারা নিশ্চিত হন যে এটি একটি ধাতব বস্তু, যা পানির ১৬ ফিট নিচে থেকে অবস্থান করছে। মঞ্জুরুল করীম আরো বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ও নদীতে তীব্র স্রোত থাকায় বস্তুটি স্থির হয়ে পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। তবে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, বস্তুটি পদ্মা নদীর মাওয়াঘাট থেকে এক কিলোমিটার দূরে এবং পাড় থেকে ছয় থেকে ৭০০ মিটার দূরত্বে ভাটির দিকে অবস্থান করছে। অর্থাৎ এটি দুর্ঘটনাস্থলের খুব কাছে রয়েছে। কবে নাগাদ বস্তুটি স¤পূর্ণভাবে শনাক্ত করা যাবে বা উদ্ধার করা যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনই তা বলা যাচ্ছে না। আবহাওয়া ও নদীর আচরণের ওপর অনেকটা নির্ভর করবে। কাণ্ডারী-২ এর কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, শনাক্ত হওয়া বস্তুটি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের দিক দিয়ে ডুবে যাওয়া লঞ্চের সমান হবে। তবে সেটি কোনো ট্রলারও হতে পারে। আবার মাওয়াঘাট সূত্র জানায়, কয়েক দিন আগে ওই স্থানে মাটিভর্তি একটি ট্রলার ডুবে যায়। যেটি আজো উদ্ধার করা হয়নি। কাণ্ডারী-২ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্ধারকারী জাহাজ কাণ্ডারী-২ এ অত্যাধুনিক কিছু যন্ত্র রয়েছে। যার মধ্যে একটি সাইড স্ক্যান সোনার। এটির কাজ হচ্ছে কোনো কিছু শনাক্ত করা। অর্থাৎ আলট্রাসনোগ্রামের মতো স্ক্যান করে ছবি তোলা। এই মেশিনের মাধ্যমে কোনো বস্তু পাওয়া গেলে পরে সেটি কী ধরনের বস্তু তা শনাক্ত করতে ব্যবহার করা হয় সাববটম প্রফাইলার। ওই সূত্র জানায়, এই বস্তুটির সন্ধান পাওয়ার পর বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখন কম্পিউটার দ্বারা বস্তুটির গ্রাফিক্স তৈরি করা হবে। এরপর সেটিকে অপর একটি মেশিনে আটকে দিতে হবে, যাতে করে বস্তুটি অন্যত্র সরে যেতে না পারে। তারপর ডুবুরি পাঠিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর উদ্ধারকার্যক্রম চালানো হবে। অপর একটি সূত্র জানায়, শনাক্ত হওয়া বস্তুটি পিনাক-৬ না হলে উদ্ধারকাজ পরিত্যক্ত করা হতে পারে। কারণ হিসেবে ওই সূত্র জানায়, এই নিয়ে ছয় দিন ধরে একটি লঞ্চ শনাক্তের কাজ চলছে। বিগত সময়ে আমরা সাধারণত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ইকুইপমেন্টের কাজ করেই ডুবে যাওয়া লঞ্চ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না, যে কারণে এই অভিযান আর দীর্ঘায়িত হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম বলেন, খুঁজে পাওয়া বস্তুটি শনাক্তের পাশাপাশি অন্যান্য উদ্ধারকাজও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অন্য জাহাজ দিয়ে ভাটিতে ৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা সার্চ করা হচ্ছে। ৪৬ লাশ উদ্ধার : পুলিশের সাবকন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়েছে, এ পর্যন্ত মোট ৪৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল উদ্ধার করা হয়েছে ছয়টি লাশ। তিনটি লাশ শনাক্ত হওয়ায় ও তাদের আত্মীয়দের পাওয়ায় সেগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, এই উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে শনাক্ত হয়েছে ২৮ জন, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে ১৫ জনকে। এ ছাড়া কন্ট্রোল রুমে সর্বশেষ নিখোঁজের তালিকায় ৬৭ জনের নাম রয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার দিন জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ৪৯ জন। নয়া দিগন্তের নোয়াখালী সংবাদদাতা মুহাম্মদ হানিফ ভুইয়া জানান, গতকাল শনিবার দুপুরে মেঘনা নদীর নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বয়ারচরের চেয়ারম্যানঘাট এলাকার টাংকিরঘাটের কাছ থেকে ভাসমান একটি লাশ উদ্ধার করেছে হাতিয়া থানা পুলিশ। মেঘনা নদীতে ভাসমান একটি লাশ দেখে এলাকাবাসী চেয়ারম্যানঘাট পুলিশ ক্যাম্পে খবর দেন। খবর পেয়ে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। গলিত এ লাশের পকেটে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। লাশটি দেখে মনে হয় এটি কয়েক দিন আগে মারা গেছে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী মৃত ব্যক্তি আহাম্মদ খান, বাবা ইব্রাহীম খান, গ্রাম ভদ্রকান্দা, উপজেলা ভাঙ্গা, জেলা ফরিদপুর। মৃত ব্যক্তির বয়স ৪০-৪২ বছর হবে। পুলিশ ও এলাকাবাসীর ধারণা এটি মুন্সীগঞ্জের মাওয়াঘাটে লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত কোনো যাত্রীর লাশ। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন আরো ৩টি লাশ : আমাদের শিবচর প্রতিনিধি ডি এম হাবিবুর রহমান জানান, স্বজন না পাওয়ায় গতকাল শিবচর পৌর কবরস্থানে আরো তিনটি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। দাফনের আগে লাশের শরীর থেকে ডিএনএ টেস্টের জন্য প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এর আগে গত শুক্রবার বাদ জুমা ১২টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। এ দিকে গতকালও পাঁচ্চর স্কুলের চারপাশে ভিড় জমাচ্ছেন স্বজনেরা। তাদের কান্œায় ভারী হয়ে উঠছে এলাকার বাতাস। তারা স্কুলমাঠে থাকা প্রতিটি লাশ খুঁজে দেখছেন এটি তার স্বজনের কি না। শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল হোসাইন জানান, হাইস্কুল মাঠের নির্মিত ক্যাম্প সূত্র জানায়, গত ছয় দিনের লাশগুলো পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। লাশের গন্ধে এলাকার মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। এ দিকে এখানে লাশ রাখার মতো প্রয়োজনীয় হিমঘর বা মর্গ নেই। তার ওপর মৃতের কোনো স্বজনও পাওয়া যাচ্ছে না, যে কারণে লাশগুলো দাফন করা হচ্ছে। তবে দাফনের আগে প্রতিটি লাশের শরীর থেকে ডিএনএ টেস্টের জন্য আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই লাশগুলোর সব ডকুমেন্ট শিবচর উপজেলা পরিষদ অথবা এসপির কার্যালয়ে রাখা হবে। কোনো স্বজন লাশের সন্ধানে এলে তার ডিএনএ টেস্ট করার পর দুইটি ম্যাচ করলে বোঝা যাবে এটি তার আত্মীয় কি না। ডিএনএ টেস্টের জন্য জেলা সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। ওই টিমের সদস্যরা সব আলামত সংগ্রহ করছেন। ইকবাল হোসাইন আরো বলেন,ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রতিটি লাশ দাফন করা হবে। লাশের সন্ধানে আসা স্বজনদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছে স্থানীয় মাদবরেরচর ইউনিয়ন যুব সমাজ নামের একটি সংগঠন। তারা ইলিশ মাছ খিচুড়ি ও খাবার পানি সরবরাহ করছে। তবে সংগঠন থেকে জানানো হয়েছে, লাশের সন্ধানে আশা স্বজনেরা কেউ খাবার নিতে চাইছেন না। তারা শুধুই কাঁদছেন। তারপরও শরীর ঠিক রাখতে খাবারের প্রয়োজন রয়েছে। তাই জোর করেই তাদের খাবার দেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য গত ৪ আগস্ট সোমবার বেলা ১১টার দিকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাওরাকান্দি ঘাট থেকে ২৫০ জনের অধিক যাত্রী বোঝাই করে মাওয়াঘাটের উদ্দেশে রওনা দেয় পিনাক-৬ লঞ্চ। পথিমধ্যে মাওয়ার দেড় কিলোমিটার দূরে পদ্মার ঘূর্ণায়ন স্রোত ও ঢেউয়ের তোড়ে পিনাক-৬ লঞ্চটি ডুবে যায়। কাণ্ডারি-২-এর উদ্ধারকাজ সাময়িক বন্ধ এ দিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে মাওয়ার পদ্মায় ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ উদ্ধারকার্যক্রম সাময়িক স্থগিত রেখেছে অনুসন্ধানী জাহাজ কাণ্ডারি-২। শনিবার রাত ১০টার পর থেকে উদ্ধারকার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। কাণ্ডারি-২-এর কমান্ডার এম এম মঞ্জুরুল করীম চৌধুরী রাত ১১টার দিকে বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, শনিবার রাত সাড়ে ৯টার পর বৈরী আবহাওয়ার কারণে পদ্মা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। এতে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে পদ্মার বুকে। স্রোতের গতিবেগও অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শনিবার রাত ১০টার পর থেকে উদ্ধারকার্যক্রম সাময়িক স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারো উদ্ধারকার্যক্রম শুরু করবে কাণ্ডারি-২। এ দিকে অনুসন্ধানী জাহাজ কাণ্ডারি-২-এর মতো অন্যান্য উদ্ধারকারী জাহাজও তাদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে নোঙর করে রেখেছে দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক ফজলুর রহমান।
No comments:
Post a Comment