দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের আয়তন বেড়েই চলেছে। উত্তর-পূর্ব দিকে পলিমাটি জমে দ্বীপটি তার আগের লম্বাকৃতি থেকে বর্তমানে গোলাকৃতি একটি বিশাল চরে পরিণত হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমির হোসেন ভূইয়া নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন দূর-অনুধাবন চিত্রে দেখা গেছে, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটির বর্তমান আয়তন বেড়ে প্রায় আট হাজার হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯১ সালে দ্বীপের আয়তন ছি
ল প্রায় ১,২৫০ হেক্টর। এর পর ১৯৯৩ সালে দূর-অনুধাবন চিত্রে দেখা গেছে এটি তখন বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে চার হাজার হেক্টরে। ভূ-উপগ্রহের (ল্যান্ডস্যাট টিএম) আর্কাইভ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য দিয়েছেন সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমির হোসেন ভূইয়া। তিনি জানান, ১৯৯১, ১৯৯৩ ও ২০১৪ সালে ভূ-উপগ্রহ (ল্যান্ডস্যাট টিএম) থেকে পাওয়া তথ্য তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমানে দ্বীপটির আয়তন অনেকটা স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে। তবে জোয়ারের সময় এটি কিছুটা নিমজ্জিত থাকে বলে তিনি জানান। অধ্যাপক আমির হোসেন ভূইয়া বলেন, তালপট্টি দ্বীপ ও চার পাশে ভূ-রূপাতাত্ত্বিক অবস্থা এবং সংলগ্ন হাঁড়িয়াভাঙ্গা ও রায়মঙ্গল নদীদ্বয়ের পানিতাত্ত্বিক চলপ্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে ভূ-উপগ্রহ থেকে। এর মাধ্যমে পাওয়া তথ্য পরীক্ষা করে ধারণা করা যাচ্ছে এটি (দ্বীপটি) উত্তরে অবস্থিত বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ডের দিকেই মিশে যাবে। সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসের হেগের সালিসি আদালতের যে রায় পাওয়া গেছে তাতে দণি তালপট্টি দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের যে জায়গাটিতে ছিল, তা ভারতের সীমানায় পড়েছে বলে জানানো হয়। অর্থ্যাৎ তালপট্টির মালিকানা হারিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা মামলার ডেপুটি এজেন্ট ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্রবিষয়ক ইউনিটের প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব:) খুরশেদ আলম সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে বলেন, তালপট্টি দ্বীপকে বাংলাদেশের বলে দাবি করলেও অতীতের কোনো সরকার দেশের মানচিত্রে তা নিজেদের বলে দেখায়নি। ভারতের সাথে মামলা দায়েরের পর বিগত মহাজোট সরকার মানচিত্র সংশোধন করে। ওই মানচিত্রে তালপট্টিকে বাংলাদেশের মধ্যে দেখালেও আদালত তা গ্রহণ করেননি ওই দ্বীপটি দীর্ঘ দিন তা মানচিত্রে অনুপস্থিত থাকার অজুহাতে। আর এই কারণে হেগের স্থায়ী সালিসি আদালতের দেয়া রায়ে ওই এলাকা ভারতের অংশে পড়েছে বলে তিনি জানান। তবে ওই সংবাদ সম্মেলনে একই সাথে খুরশেদ আলম আরো বলেন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর জেগে ওঠা ওই দ্বীপ ফের ডুবে যায় ১৯৮৫ সালে। এর পর থেকে আর ওই দ্বীপের অস্তিত্ব নেই। তিনি ওই এলাকার ১৯৮৯ সালের ও গত বছরের ২৪ অক্টোবরের উপগ্রহ চিত্র সংবাদ ব্রিফিংয়ে দেখান, যেখানে কোনো দ্বীপ ছিল না, শুধু পানি দেখা যায়। তিনি ওই সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় একজন গবেষকের উদ্ধৃতি দিয়ে আরো বলেন, ২০০৮ সালে ওই গবেষক বলেছেন, ‘নিউ মুর (ভারতীয়রা তালপট্টিকে নিউ মুর নামে ডাকে) ইজ নো মোর’ (নিউ মুর আর নেই)।’ তবে তালপট্টি নিয়ে ভারতের প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে, ভারতের পাওয়া ছয় হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই পড়েছে দণি তালপট্টি। যেখানে মজুদ রয়েছে ১০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। তারা তাদের রিপোর্টে তালপট্টির অস্তিত্ব রয়েছে এবং দ্বীপটি ভারত পাওয়ার কারণে লাভবান হয়েছে বলে মতামত প্রকাশ করে। এ ব্যাপারে ড. মোহাম্মদ আমির হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, একটি দ্বীপ তৈরি হয়ে থাকে উজান থেকে আসা পলি জমার মধ্য দিয়ে। কোনো দ্বীপের পলি উৎস যদি হয় মহাদেশীয়,তা হলে সে দ্বীপটি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তালপট্টি দ্বীপের পলির উৎস হচ্ছে হিমালয়। তাই হিমালয় যতো ক্ষয় হতে থাকবে পলির স্রোত ততই বাড়বে। পাশাপাশি তালপট্টি দ্বীপ ততই বাড়বে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব হাসানের ‘বাংলাদেশ প্রকৃতি ও সম্পদ’ নামে একটি বইয়ে দেখানো হয়েছে তালপট্টি দ্বীপটির বিভিন্ন সময়ে আয়তন কত ছিল । এতে বলা হয় ১৯৭৩ সালে এটির আয়তন ছিল ৩৫০ একর। ১৯৭৫ সালে এটির আয়তন একটু কমে দাড়ায় ২৮০ একর। ১৯৭৬ সালে তালপট্টির আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪০ একর। আবার ১৯৭৭ সালে এ দ্বীপের আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০ একর। ১৯৭৮ সালে দ্বীপটির আয়তন আরো বেড়ে যায়। তখন এটির আয়তন বেড়ে দাড়ায় ৬১৭ একর। এর পর ১৯৭৯ তে দেখা যায় দ্বীপটির আয়তন ৬১৭ একরেই থাকে। ১৯৮০ সালে দেখা যায় দ্বীপটির আয়তন ৮০০ একর। অধ্যাপক মাহবুব হাসান ওই বইয়ে যুক্তি দিয়ে দেখান দক্ষিণ তালপট্টি ও ভারতীয় ভূখণ্ডের মাঝামাঝি নয়া ুদ্র দ্বীপ এবং রায়মঙ্গলের দিকে উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত দ্বীপ এ তিনটি ভূখণ্ড হাঁড়িয়াভাঙ্গা রায়মঙ্গল নদীর বর্তমান স্রোতপ্রবাহ পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলছে যা এমনকি ভারতীয় জেলেরাও জানে। অধ্যাপক মাহবুব হাসান জানান, এ এলাকা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ভারত সত্যকে গোপন করছে। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ হাঁড়িয়াভাঙ্গা নদীর গতিধারায় অবস্থিত নয় বরং এটা নদীর পূর্ব দিকে ও রায়মঙ্গলের স্রোতধারার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। তিনি জানান, হাঁড়িয়াভাঙ্গার স্রোত বিভক্ত হয়েছে দক্ষিণ তালপট্টির পশ্চিমে জেগে ওঠা ুদ্র দ্বীপের অবস্থিতির জন্য। যদি র্যাডকিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী হাঁড়িয়াভাঙ্গার মধ্যস্রোত ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত হয়ে থাকে তাহলে নয়া দ্বীপ নিয়ে মালিকানা বিরোধ চলতে পারে; দক্ষিণ তালপট্টি নয়। দক্ষিণ তালপট্টি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী সমুদ্র সীমানায়। ১৯৭১-এর প্রণীত ভারতের নৌপথের ছক, যা ব্রিটিশ অ্যাডমিরালটির চার্টে তোলা হয়েছে, তা অবৈধ এবং ভুল বলে অধ্যাপক মাহবুব হাসান তার বইয়ে মন্তব্য করেন। তবে বেসরকারি সংস্থা জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, ভবিষ্যতে দণি তালপট্টি দ্বীপটি জেগে উঠলে বাংলাদেশও তার একাংশ পেয়ে যাবে। তালপট্টির অতীত ইতিহাস : ১৯২৭-২৯ সালে সুন্দরবন জরিপের সময় বিশাল তালগাছ দেখে হাঁড়িয়াভাঙ্গার পূর্বের দ্বীপের জঙ্গলের নামকরণ হয় তালপট্টি। আরো অনেক বছর পর দক্ষিণে নয়া দ্বীপের নাম হলো দক্ষিণ তালপট্টি। গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত রাজনীতি অর্থনীতি জার্নালে দক্ষিণ তালপট্টি-নিউমুর বিতর্ক : একটি ভূ-রাজনৈতিক পর্যালোচনা শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা সর্বপ্রথম দ্বীপটির অস্তিত্বের কথা প্রচার করে। বাংলাদেশের বৃহত্তর খুলনা জেলার কালীগঞ্জ থানাধীন তালপট্টি দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থানের কারণে নতুন দ্বীপটিকে তারা দক্ষিণ তালপট্টি নামে অভিহিত করে। পরে বাংলাদেশের খুলনা জেলা প্রশাসন এবং জরিপ বিভাগ স্বীয় প্রশাসনিক দলিলপত্রে দ্বীপটিকে ওই একই নামে নথিভুক্ত করে। ওই সময় বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছিল। অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণে দ্বীপটির মালিকানা স্বত্ব নিয়ে কোনোরূপ চিন্তাভাবনা করারও সুযোগ পায়নি। কিন্তু ভারত ওই সময় দেরি না করে জেগে ওঠা নুতন দ্বীপটিকে এককভাবে নিজ মালিকানায় নিউমুর নামে অভিহিত করে এবং তা ব্রিটিশ নৌজরিপ কর্র্তৃপক্ষকে অবহিত করে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রপত্রিকাসহ ভারতের সব প্রচারমাধ্যমে দ্বীপটির ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো হয়। এর মধ্যে অনেক বিবরণ ও তথ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি স্থান পায়। কলকাতার সংবাদমাধ্যমগুলোতে দ্বীপকে কখনো নিউমুর বা কখনো পূর্বাশা নামে প্রকাশ করতে থাকে।
No comments:
Post a Comment